গত আগস্টের ঘটনা। আফগানিস্তান নামে দেশটিতে তখন সবে ভাবা শুরু হয়েছে যে দুই দশক পর ফের তালিবান মাথা তুলতে চলেছে। কারণ, মার্কিন সরকারের সঙ্গে তখন তালিবানের ‘শান্তি’ আলোচনা চলছিল। আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা চলে যাওয়ার সম্ভাবনা যত স্পষ্ট হচ্ছিল, ততই স্পষ্ট হচ্ছিল তালিবানি শাসন ফেরারও।
সেই সময়, ৪ আগস্ট দক্ষিণের শহর চোরায় ঢুকে কবি ও ইতিহাসবিদ আবদুল্লাহ আতেফির বাড়িতে প্রবেশ করে তালিবান যোদ্ধারা। প্রথমে হাত-পা বেঁধে, সারা রাত নির্যাতন চালিয়ে এবং শেষে গুলি করে আবদুল্লাহ আতেফিকে হত্যা করা হয়। আতেফির অপরাধ কী, কেউ জানে না। তিনি কবিতা লিখতেন, ইতিহাসচর্চা করতেন, শিল্প-সাহিত্যের কথা বলতেন, সৌন্দর্যের কথা বলতেন। সম্ভবত এসবই ছিল তাঁর অপরাধ। তবে তাঁকে হত্যার কথা স্বীকার করেনি তালিবান।
এ সপ্তাহের শুরুর দিকে টিভির পর্দায় ভেসে ওঠা কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় বিপুলভাবে ছড়িয়ে পড়া বিভীষিকাময় একটি দৃশ্ব্য দেখে সারা বিশ্ব কেঁপে গিয়েছে। বিশ্ব রাজনৈতিক ইতিহাসের ভয়াবহতম ছবিগুলির অন্যতম একটি হয়ে রইল ছবিটা। কাবুলের হামিদ কারজাই বিমানবন্দরের রানওয়েতে ক্রমশ গতি নিচ্ছে মার্কিন সেনার একটি বিমান। তার চাকার কভারের উপর বসে দেশ ছাড়তে মরিয়া কিছু লোক। বিমানটির সঙ্গে সঙ্গেই দৌড়চ্ছে বেপরোয়া জনতা। যদি পাইলটের একটু দয়া হয়...তাদেরকেও তুলে নেওয়া হয় বিমানে! এই দৃশ্ব্যই প্রমাণ করে আফগানিস্তানের প্রকৃত পরিস্থিতি কী। সেখানে মানুষ কতটা অসহায়, অনিশ্চতার মধে্য রয়েছে।
তালিবানের মতো শাসকদের সবচেয়ে বড় ভয় হল কলম। কারণ, যুগে-যুগে প্রমাণ হয়েছে ‘অসির চেয়ে মসির জোর বেশি’। কাজেই এক্ষেত্রেও তালিবান শক্তির সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে লেখক-সাহিতি্যকরা। তাই হয়তো শুরুতেই তাঁদের মনোবল ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা ছিল আবদুল্লাহ আতেফির হত্যাকাণ্ড।
বেস্ট সেলার ‘দ্য কাইট রানর’-এর আফগান-মার্কিন লেখক খালেদ হোসেইনি আফগানিস্তানের আধুনিক ইতিহাসের হৃদয়বিদারক অধ্যায়ের সঙ্গে ভীষণ পরিচিত। দ্য কাইট রানার ছাড়াও তাঁর অন্য উপন্যাসগুলিতে আফগানিস্তানের মাটিতে চলা দশকের পর দশক ধরে চলতে থাকা যুদ্ধ, উপজাতি সংঘাত, অভ্যুত্থান এবং দুর্নীতির দ্বারা বিধ্বস্ত একটি দেশের উত্থান -পতনকে সমৃদ্ধভাবে চিত্রিত করেছে। হোসেইনি বছর কয়েক আগে ক্যালিফোর্নিয়া থেকে আফগানিস্তানের যুদ্ধে বাস্তুহারা আফগানদের প্রতি সংহতি জানাতে একটি ফাউন্ডেশন গঠন করেন।
হোসেইনির পরিবার এবং বন্ধুরা এখনও রয়েছেন আফগানিস্তানে। তাঁরা বলেন, তালিবানদের নিয়ন্ত্রণে তাঁদের যে পরিণতি হবে, তা ভেবেই তাঁরা আতঙ্কিত। হোসেইনি বলেন, “এরা এমন একটি গোষ্ঠী যারা ২০ বছর ধরে পরিকল্পিতভাবে আফগানদের উপর নিষ্ঠুরতা ও সন্ত্রাস চালিয়েছে, হাসপাতাল, রাস্তাঘাট এবং স্কুল উড়িয়ে দিয়েছে, অগণিত আফগানদের হত্যা করেছে, তাদের মধ্যে অনেক সাধারণ গ্রামবাসী, নারী ও শিশু। এখন আবার তারা ফিরে এসেছে। তারা বলছে যে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। এটি বিশ্বাস করা খুব কঠিন। আমি সাধারণ আফগানদের জন্য খুবই উদ্বিগ্ন। আমি জাতিগত সংখ্যালঘুদের জন্য, সাংবাদিকদের জন্য, যারা কাজ করছে সেই মানবাধিকার কর্মীদের জন্য উদ্বিগ্ন। কিন্তু বিশেষ করে আমি সেই নারী ও মেয়েদের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন যাদের অধিকার ক্ষুণ্ণ করা হয়েছে, এবং গত ২০ বছরের সব প্রাপ্তিগুলি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।”
গত ২০ বছর ধরে আফগানিস্তান সম্পর্কে সত্যিই একটি আনন্দদায়ক বিষয় হল, আফগানিস্তান একটি অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী এবং মুক্ত সংবাদপত্র উপভোগ করেছে। আফগান নেতাদের নিয়মিতভাবে টেলিভিশনে সমালোচনা করা হত, আফগান টেলিভিশনে রাজনৈতিক বিতর্ক এবং সংলাপ খুব প্রাণবন্ত এবং একাধিক দিক থেকে ছিল। সুতরাং তালিবানরা এই সময় কেমন আচরণ করছে সে সম্পর্কে এটি একটি উপস্থাপনা হবে। কী বলছে আফগান সাংবাদমাধ্যম? আপনি কি জানেন, তারা কি সত্যিকারের উপায়ে প্রতিবেদনগুলি প্রকাশ করতে সক্ষম নাকি তালিবানরা মূলত রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করবে এবং সেই বিধিনিষেধ আরোপ করবে?
পরপর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর আফগানিস্তানের বিভিন্ন অংশে শিল্প-সংস্কৃতি অঙ্গনে নেমে এসেছে বরফশীতল নীরবতা। থমথমে মুখ আর আতঙ্কিত চেহারা নিয়ে ঘরের মধ্যে মুখ গুঁজে বসে আছেন শিল্পী-সাহিতি্যকরা। সব সময় শঙ্কা, এই বুঝি নিজের পালা এল! বাড়ি থেকে শিল্পসাহিত্যের সব বই লুকিয়ে ফেলা হচ্ছে। দেয়াল থেকে নামিয়ে ফেলেছি শিল্পকর্মগুলি। এসব রাখা সাধারণ আফগানদের জীবনের জন্য এখন খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। তালিবানরা এগুলো একদম সহ্য করতে পারে না। ঘরের ভেতর এসব দেখামাত্র তারা সেই পরিবারের সবাইকে গুলি করে মেরে ফেলতে পারে। এই ভীতিকর সময়ে সৌন্দর্যসাধকেরা যখন নিপীড়নের মুখোমুখি, সে সময় আফগানিস্তানের লেখক-শিল্পী-সাহিত্যিকেরা কী-ই বা করতে পারেন?
নিজস্ব প্রতিনিধি
সূত্র : সংবাদ সংস্থা ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম। ছবি: প্রতিকী
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন