পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়
আমাদের সাহিত্যে, বিশেষত গল্প-উপন্যাসে গ্রামের কথা ঘুরেফিরেই এসেছে। গ্রামীণ জীবন, মানুষের দুঃখের বারোমাস্যা, উন্মুক্ত প্রকৃতি– এসব ফুটে উঠেছে শব্দ-তুলিতে। গ্রামের কথা শরৎচন্দ্র লিখেছেন। লিখেছেন বিভূতিভূষণ-তারাশঙ্কর। আগে পরে আরও অনেকের লেখাতেই তা এসেছে। সবার দেখার চোখ এক নয়। কেউ লিখেছেন গ্রামীণ জীবনের রুক্ষ্মতা-রূঢ়তা। কেউ বা ছায়া-শীতল স্নিগ্ধতা। এসব নিয়ে বিস্তর কেতাবি-আলোচনাও হয়েছে। বাংলা সাহিত্যের গ্রামীণ জীবন নিয়ে যতই লেখা হোক না কেন, কেউই খগেন্দ্রনাথ মিত্রের কথা তোলেননি। তিনি বিস্মৃত।
খগেন্দ্রনাথ মিত্র। গ্রামীণ জীবন, মানুষজন, যাঁর কলমে আশ্চর্য জীবন্ত, শুধু ‘ছোটোদের লেখক’ বলে তাঁকে আমরা আড়ালে রেখেছি! ছোটোদের লেখাকরা বরাবরই উপেক্ষিত। সাহিত্যের মূল স্রোতে তাঁদের ঠাঁই নেই। সাহিত্যের ইতিহাসও তাঁদের কথা লেখা হয় না। ছোটোদের সাহিত্যে যে শুধুই ছোটোদের নয়, রয়ে যায় বড়দের ভাবনার অনেক রসদ, সেই সত্যটিকে আমরা বুঝতে চাই না। বালকপাঠ্য সাহিত্য বালকজনের কাছেই শুধু সীমাবদ্ধ থাকবে কেন? বালকবয়েসে বালকজন তা এক রকমভাবে পড়বে, ভাববে। পরিণত বয়েসে পুনরায় পড়তে গিয়ে আবার অন্যরকম মনে হবে। ঠিক তেমনই অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার খগেন্দ্রনাথ মিত্রর ‘ভোম্বল সর্দার’ পড়তে গিয়ে। প্রথম পড়েছি সেই সুদূর অতীতে, আমার স্কুলবেলায়। তারপর আরও কয়েকবার। এক অদ্ভুত ভাল লাগা। প্রাপ্তির আনন্দে মন কানায় কানায় ভরে ওঠে। তাই ব্যস্ততার ফাঁকফোকরে, একটু সময় পেলেই ভোম্বলকে বন্ধু হিসাবে পেতে ইচ্ছে করে। খুব সম্প্রতি সেই সখ্য আবার ঝালিয়ে নেওয়া গেল। নতুন করে পড়লাম খগেন্দ্রনাথ মিত্রের ‘ভোম্বল সর্দার’ ।
খগেন্দ্রনাথ মিত্র ছোটোদের কথা ভেবে ছেলেভোলানো সাহিত্য রচনা করেননি। মাটির সঙ্গে, মানুষের সঙ্গে তাঁর গভীর সংযোগ ছিল। পরিণত বয়সে এই উপন্যাসটি ফিরে পড়তে গিয়ে তা নতুন করে উপলব্ধি করলাম। মাটির সঙ্গে সংযোগ ও ভালবাসা রয়েছে বলেই হয়ত একসময় এ বইয়ের রুশ-অনুবাদ স্কুলে স্কুলে পড়ানো হতো রাশিয়ায়। ভাবা যায়!
খগেন্দ্রনাথ মিত্র তরুণ-বয়েসে বাঘাযতীনের সংস্পর্শে এসেছিলেন। ছাত্রাবস্থায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন অসহযোগ আন্দোলনে। দেশের প্রতি নিখাদ ভালবাসা ছিল বলেই ‘ভোম্বল সর্দার’-এর মতো উপন্যাস লিখতে পেরেছিলেন! দেশকে না ভালবাসলে শব্দে শব্দে গ্রামের ছবি এমন মরমী ও স্পর্শময় হয়ে উঠতো না। ‘ভোম্বল সর্দার’ ফিরে পড়তে গিয়ে একথা বারবারই মনে হয়েছে। একালের ছোটোরা ঘোরতর বাস্তববাদী। তারা এখন আর মনে মনে ‘অপু’ হয় না , ‘অমল'’ হয় না , ‘ভোম্বল’ হয় না। ছেলেবেলায় ‘ভোম্বল সর্দার’ পড়তে পড়তে মনে মনে আমিও তার সঙ্গী হয়ে গিয়েছিলাম। সেই সুখস্মৃতি ফিরে পাওয়া যে কত বড়ো প্রাপ্তি, কতখানি আনন্দের, তা আবারও বুঝলাম, কদিন আগে!
চারখণ্ডের ‘ভোম্বল সর্দার’-এর পরতে পরতে রয়েছে গ্রামবাংলা। প্রকৃতি ও মানুষ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। প্রকৃতির অনুষঙ্গে মানুষ, মানুষের অনুষঙ্গে প্রকৃতি –প্রায় প্রতিটি অনুচ্ছেদে রয়েছে এমন দৃষ্টান্ত। দ্বিতীয় খণ্ড থেকে একটুকরো তুলে দেওয়া যেতে পারে,–
ভোম্বল ছইয়ের মুখে বসে দেখতে লাগল, নদীর দুই তীরে সেই ভাঙাপাড়, সবুজ গ্রাম, ঘাট থেকে পথ উঠে গেছে গ্রামের দিকে, ঘাটে চাষিবউরা স্নান করছে, কাঁথা-কাপড় কাচছে, ছেলেরা স্নান করতে করতে তোলপাড় করছে। নদীতে সেই দু-একখানি নৌকার আনাগোনা, সেই রৌদ্র-জলের ঝলমলনি, আকাশে সেই মেঘ সূর্য ও দু’একটি পাখি।
আমরা শহরে বড় হয়েছি, ভোম্বলের চোখ দিয়ে নতুন করে যেন গ্রামকে চিনি। লক্ষ্য করি, ‘দ্বাদশীর চাঁদ আকাশে ঝকঝক করছে। গ্রামের গাছপালা ফিকে জ্যোৎস্নায় চিকচিক করছে।’ শব্দ নিয়ে অবনঠাকুর শুধু নন, ছবি আঁকতেন খগেন্দ্রনাথও। নিখুঁত বর্ণনা, শব্দের পর শব্দ বসে তৈরি হয়েছে নিটোল ছবি। দেখার চোখটি ভারি পরিষ্কার। কত চোখজুড়োনো খুঁটিনাটি বর্ণনা। ডিটেলের আশ্চর্য কারুকাজ। মুগ্ধ হয়ে পড়তেই হয়। শুধু মুগ্ধতা নয়, দুঃখকাতরতাও আছে। ভোম্বলের কত দুঃখ! বাবা নেই ,মা নেই। থাকে কাকা-কাকিমার সঙ্গে। খড়ির গণ্ডিতে যেন আবদ্ধ। একঘেয়ে সেই জীবনে মন বসাতে পারেনি। ঘর ছেড়ে পথে নেমেছে। বিলাস বৈভবের কোনও স্বপ্ননগরীতে নয়, যেতে চায় ইস্পাত-লোহার টাটানগরে। গ্রামীণজীবন ও মানুষজন চিনতে চিনতে ভোম্বল এগিয়েছে লক্ষ্যপূরণের পথে। দীর্ঘ পথ, বিচিত্র অভিজ্ঞতা। ছেলেবেলার মতো এই বয়েসেও তার যাত্রাপথে নতুন করে শামিল হয়ে পড়ি আমি । সে এক মহার্ঘ অনুভূতি, তা যদি বণ্টন করা যেত জনে জনে, মনে মনে , তাহলে কী ভালই না হত!
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন