মানস ভাণ্ডারী
‘গভীর রাতের আতঙ্ক’ শীর্ষক গ্রন্থটি উপমন্যু রায়ের পাঁচটি উপন্যাসের সংকলন। উপন্যাসগুলি স্বতন্ত্র হলেও এগুলি তাঁর একটি বিশেষ সিরিজের অন্তর্ভুক্ত। ঘটনাগুলিও যেন একসূত্রে বদ্ধ। পাঁচটি উপন্যাসেই হাজির কেন্দ্রীয় ও মুখ্য চরিত্র অরণ্য এবং তুহিন। উপস্থিত থাকে আরও একজন, সে এক রহস্যময়ী মানবী— জেনি। যদিও সে যে প্রকৃত পক্ষে এই পৃথিবীর কেউ নয়, পাঠক সহজেই তা বুঝতে পারেন তার আশ্চর্য স্বীয় কার্যাবলীর চমকপ্রদ কারণে। যদিও এই অশরীরী বা ভিনগ্রহের বাসিন্দা মনে হওয়া জেনি কখনও কখনও অরণ্যর প্রতি আচরণে রক্তমাংসের হয়ে ওঠার স্বাক্ষর রেখেছে।
অতীন্দ্রিয়, আপ্রকৃত বিষয়ের প্রতি মানুষের কৌতূহল ও আকর্ষণ চিরদিনের। মৃত্যু, আত্মা, পরলোক, এলিয়েন, অশরীরী, অলৌকিকতা, কল্পবিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়গুলি নিয়ে রচিত সাহিত্য তাই প্রায় সর্বদাই পাঠকপ্রিয় হয়ে ওঠে। লেখক উপমন্যু রায় অনেকদিন থেকেই এ বিষয়ে চর্চা করছেন। তাঁর লেখালেখির মূলত বিষয় এগুলিই। গত কয়েক বছরে তিনি একের পর এক লিখতে থাকেন ‘মৃত জ্যোৎস্নার পৃথিবী’, ‘রাত যখন নীল’, ‘নামানুষী রাত তখন’, ‘সন্ধের পরে’, ‘রাত একটা চল্লিশ’, ‘মুখোমুখি মৃত্যু যখন’, ‘তারা আসছে’ শীর্ষক উপন্যাসগুলি। বর্তমান গ্রন্থটি এইগুলির প্রথম পাঁচটি উপন্যাসের গ্রন্থিবদ্ধ অবয়ব।
গ্রন্থটির অন্যতম উজ্জ্বল বৈশিষ্ট্য— এখানে চরিত্র হিসাবে বিভিন্ন উপন্যাসে হাজির হয়েছেন প্রফেসর শঙ্কু, মিসির আলি এবং প্রফেসর চ্যালেঞ্জার। সত্যজিৎ সৃষ্ট শঙ্কু, কিংবা হুমায়ূন আহমেদের মিসির আলি বাঙালি পাঠকের কাছে অজানা নয়। তাঁরা যথেষ্টই প্রিয় ও পরিচিত। উপমন্যু পাঠকদের কাছে আরও হাজির করেছেন স্যার আর্থার কোনাল ডয়েলের প্রফেসর চ্যালেঞ্জার নামক আশ্চর্য চরিত্রটিকেও। শার্লক হোমসের স্রষ্টা ডয়েল গোয়েন্দা উপন্যাসের বাইরেও অন্য অনেক বিষয় নিয়ে কাজ করেছেন এবং তাঁর লেখনীতে প্রফেসর চ্যালেঞ্জার নামের বিখ্যাত চরিত্রটি সৃষ্টি হয়েছে। এই চরিত্রটিকে ডয়েলের দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ড, দ্য পয়জন বেল্ট, দ্য ল্যান্ড অফ মিস্ট, হোয়েন দ্য ওয়ার্ল্ড স্কিমড, দ্য ডিসইনটিগ্রেশন মেশিন নামের বিখ্যাত উপন্যাসে পাওয়া যায়। উপমন্যু রায়ের অভিনব ভাবনায় এই চরিত্রগুলি তাঁর উপন্যাসে হাজির হয়েছে স্বতন্ত্র ভূমিকায়।
অরণ্য এবং তুহিন, অভিন্নহৃদয় এই দুই যুবক, যদিও তারা ভিন্ন পেশায় যুক্ত, তাদের সর্বত্র জুড়ে থাকা পাঁচটি উপন্যাসের শরীরে। অরণ্য তার জীবনযাপনে নানান বিচিত্র ও রহস্যময় ঘটনার মুখোমুখি হয়। ছুটে আসে তুহিন। জেনি। কখনও শঙ্কু, মিসির আলি অথবা চ্যালেঞ্জার। আশ্চর্য সব ঘটনার ঘনঘটা এবং রহস্যময়তায় উপন্যাসের কাহিনি এগিয়ে চলতে থাকে।
পাঁচটি উপন্যাসই সুরচিত। বর্ণনা এবং বাক্যগুলির সুনির্মাণ ও সরলতা এনে দেয় পরিচ্ছন্ন মনোরম এক স্বাদ। অতিকথনবিহীনতা বৃদ্ধি করে কাহিনির গতি, ফলত ক্লান্তিহীন পাঠক দ্রুত এগোতে থাকেন। কখনও তীব্র কৌতূহল, রুদ্ধশ্বাস ঘটনাপ্রবাহ, চমকপ্রদ ও বিস্ময়কর বিষয়ের চুম্বক–আকর্ষণে পাঠককে মুগ্ধ করে লেখক নিয়ে যেতে থাকেন গ্রন্থটির শেষ পৃষ্ঠার দিকে। অজস্র আশ্চর্য ঘটনা ও বিষয়ের উপস্থিতি, চরিত্রগুলির কার্যকলাপ প্রভৃতির সঙ্গে নানান তথ্য তৃপ্ত করে পাঠককে। প্রফেসর শঙ্কু, মিসির আলি কিংবা প্রফেসর চ্যালেঞ্জারের জীবনের আশ্চর্য ঘটনা, অভিযান ও আবিষ্কারের ঝলকগুলি বিষয় হয়ে যখন ঢুকে পড়ে উপন্যাস–শরীরে, সেগুলি তখন পাঠকের কাছে অতিরিক্ত প্রাপ্তিই শুধু নয়— তাঁরা সমৃদ্ধও হন সেইসব চরিত্র, বিষয় এবং ঘটনার অভিজ্ঞতায়।
পরাবাস্তব, প্যারাসাইকোলজি, অ্যানসিয়েন্ট এলিয়েন প্রভৃতি বিষয়ে আগ্রহী উপমন্যু রায়ের এই উপন্যাসগুলি প্রকৃতই জমজমাট এবং সফল বলা যায়। বাংলা সাহিত্যে অবশ্যই নতুন এক সংযোজন এই ভিন্নতর প্রয়াস। বিশ্বখ্যাত লেখকদের বিখ্যাত ও বিশিষ্ট চরিত্রের এমত সমাবেশ ইতিপূর্বে কখনও দৃষ্ট হয়নি।
গভীর রাতের আতঙ্ক
উপমন্যু রায়
মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রা: লি:
মূল্য ৩৫০ টাকা
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন