বহুকাল আগে হাতে একটা বই এসে পড়েছিল। কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাথ থেকে কিনেছিলাম। কার্ডবোর্ডে বাঁধানো সুন্দর প্রচ্ছদের বইটির নাম আজ আর মনে নেই। তবে সেটি ছিল আসানসোলের কয়লাখনি অঞ্চলের পটভূমিতে উপন্যাস। সে-ও বছর পঁচিশ আগের প্রকাশকাল, অর্থাৎ উপন্যাসের সময়কাল আশি থেকে নব্বই দশকের। সে উপন্যাস ছিল কোলিয়ারির কুলি-শ্রমিক, তাদের পরিবার, তাদের জীবনচর্যা নিয়ে। অনেকদিন পর অতনু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কালোয় আলোয়’ বইটি আমাকে সেই উপন্যাসটির কথা মনে করিয়ে দিল।
বিহার (অধুনা ঝাড়খণ্ড) লাগোয়া খনি শহরের মধ্যবিত্ত পাড়ায় ছোট থেকে গায়ে গা ঘেঁষে বড় হওয়া একদল অভিন্নহৃদয় বন্ধুর হরেক অভিজ্ঞতা গল্পকেও হারা মানায়। জীবনপথের বাঁকে বাঁকে তারা আঁধার জগতের নানা বর্ণের হরেক চরিত্রের মুখোমুখী, যাদের দুর্জয় সাহসিকতা, অপরিমেয় নিষ্ঠুরতা ওসিউরে ওঠা হিংস্রতার অভিঘাত শরীর–মন অসার করে দিতে পারে, আবার কারও কারও অনন্য বন্ধুপ্রীতি, সহৃদয়তা ও মানবকিতার ছটা চোখ ধাঁধিয়ে দিতে পারে। এমনই ছ’টি রুদ্ধাশ্বাস বৃত্তান্ত এক মলাটে। প্রায় সব ক’টিতে ‘কমন ক্যারেক্টার’ লায়লা, বলতে গেলে কেন্দ্রীয় চরিত্র। একদা দুর্দম মাফিয়া ডন শিখ যুবকটির হৃদয় থেকে উৎসারিত সহমর্মিতার ফল্গুধারায় সিঞ্চিত সমস্ত বৃত্তান্ত।
ব্যাপার হল, বইটি হাতে পাওয়া এবং পড়া শুরুর আগেই বইটি সম্পর্কে জেনে গিয়েছিলাম। সোশ্যাল মিডিয়ায় এই বইটি নিয়ে বেশ কিছু লেখা আমার চোখে পড়েছে। তাছাড়া, এই boitantra.in পোর্টালেই অতনু নিজে একটি লেখায় ওর এই উপন্যাস লেখার উদ্দেশ্য জানিয়েছে। এটা ঠিক যে আজকাল সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে কোনও বই বাজারে আসার আগেই তার আদ্যপ্রান্ত প্রকাশ হয়ে পড়ে। তাতে একটা সুবিধা হয়, বইটি সম্পর্কে একটা ধারণা করে নিয়ে, সেটা কেনার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। সে কারণে অবশ্য লেখকের প্রতি, লেখকের ওই উপন্যাসটির প্রতি পাঠকের প্রত্যাশা বেড়ে যায়। সে প্রত্যাশা পূরণ করতে পারা লেখকের একটি বড় চ্যালেঞ্জ। অর্থাৎ, বইটি নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারের সময় লেখকের সততা খুব প্রয়োজন। বইটি সম্পর্কে সঠিক তথ্যই দেওয়া কর্তব্য, কখনওই যেন বইয়ের বিবরণ পাঠকের আগ্রহ সৃষ্টি করতে গিয়ে অতিরঞ্জিত না হয়ে যায়। লেখককে মনে রাখতে হবে, পাঠক যদি মনে করেন তিনি প্রতারিত হয়েছেন, তিনি লেখককে কোনও আদালতের কাঠগোড়ায় তুলবেন না, তাঁর সম্পর্কে তৈরি হওয়া ধারণা থেকে তাঁকে বর্জন করবেন। এটা একজন লেখকের জন্য অত্যন্ত ক্ষতির। বইয়ের সোশ্যাল মিডিয়া প্রচারে অবশ্য লেখকের একটি সুবিধা আছে, বই-বৃত্তান্ত পড়ে পাঠক আগ্রহী না হলে তিনি বইটি কিনবেন না। সবার সব বিষয়ে লেখা ভাল লাগবে, তেমনটা হয় না। অনাগ্রহী পাঠকের বইটি সম্পর্কে হতাশা সৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা পাবেন লেখক।
আমার তো অতনুর বই-বৃত্তান্ত পড়েই ‘কালোয় আলোয়’ নিয়ে প্রবল আগ্রহ হয়েছিল। তার প্রধান কারণ অনেকগুলো, –প্রথমত, বইটির পটভূমি বাংলা-ঝাড়খণ্ড লাগোয়া কোলিয়ারি এলাকা, দ্বিতীয়ত হল সেখানকার মাফিয়া রাজত্বের অকথিত কাহিনী– যা আশপাশের এলাকায় গুঞ্জরিত হয়, কিন্তু স্পষ্ট হয় না। খনির অতল থেকে যেন সেই অন্ধকার জগতে রাজারানীদের তুলে আমার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছন অতনু। আমি অবাক হয়ে তাদের দেখছি। তাদের সঙ্গে কথা বলছি। তাদের সঙ্গত করছি। তারা আমার কাঁধে হাত রেখে বলছে, –অবাক হোচ্ছ দোস্ত!
কোন তালিকায় ফেলা যায় অতনুর এই বইটিকে?
সাহিত্য শব্দটি অত্যন্ত কঠিন। সব লেখনি যে সাহিত্য হতে হবে এমন মানে নেই। ‘কালোয় আলোয়’ সাহিত্য পদবাচ্য হবে কিনা, তা নিয়ে আমার বেশ সন্দেহ রয়েছে। অতনু আরও সময় নিয়ে লিখলে হয়তো এটা আরও ভাল সাহিত্য হতে পারতো। আবার হয়তো অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে উঠে আসা লেখনিও বহু সময় কালাজয়ী উপন্যাসের স্বীকৃতি পেয়েছে।
‘কালোয় আলোয়’ একটি নিখাদ বন্ধুত্বের গল্প। সমাজ স্থির করে দেওয়া মানদণ্ডে অসম শ্রেণির ক’জন যুবক কী প্রগাঢ় বন্ধুত্ব। বছর তিরিশ আগের মফস্বঃলে ঠিক যেমন বন্ধুত্বটা আমরা সবাই চাইতাম। একজন অন্যজনের জন্য জান লড়িয়ে দেওয়া এবং… হয়তো, আমার ধারণা ভুলওহতে পারে, পশ্চিমবঙ্গের সেই সময়কার রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে যুবাদের সবসময় শ্রেণি আর সিস্টেমের বিরুদ্ধে বৈপ্লবিক মনোভাব– এসবকিছু ছড়িয়ে রয়েছে অতনুর এই বইটার ছত্রে ছত্রে। ‘কালোয় আলোয়’ আসানসোলের মাফিয়া-ব্যবসায়ী-নেতাদের আবছায়া জুনিয়ার চালচিত্র। একেবারে শুরুতে নাম বিস্মৃত হওয়া বইটির সমকালেরই পটভূমি এখানেও। কোলিয়ারির শ্রমিকদের শোষণের অন্যদিকে আরেকটা জগত উন্মোচন হয়েছে বইটিতে। শোষণের যন্ত্রণা থেকে যাকে কিন্তু একবারও বিচ্ছিন্ন করা যায় না। অতনুর অনিচ্ছাতেই ‘কালোয় আলোয়’একটা দুর্দান্ত থ্রিলার হয়ে উঠেছে।
আজকাল বাংলা বইয়ের লেখকরা খুব ক্রাইম থ্রিলার লেখার দিকে ঝুঁকেছেন। খাসা একটা নাম দিয়ে, জব্বর প্রচ্ছদ বানিয়ে বাজারে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। প্রথমদিকে দু’-একটা বইয়ের ভাল কাটতিও হয়েছিল। মনে রাখতে হবে সেই সময় ব্যোমকেশ-ফেলুদা-কাকাবাবু-শবর সিরিজ চলছিল বাংলা সিনেমায়। ফলে ক্রাইম থ্রিলার নিয়ে পাঠক মহলেও একটা কৌতূহল হয়েছিল। সেটা আর খুব বেশি আছে বলে মনে হয় না। কারণ, অধুনা ক্রাইম থ্রিলারগুলির বেশিরভাগই ‘কাল্পনিক’। অতনুর ‘আঁখো দেখি’ উপন্যাসের দেবু, রুনু, ছ’ফুটি, মনোহর, লায়লা, লোডুরা কী জীবন্ত! অতনুর সময়চিত্রগুলো দ্রুত টেনে নিয়ে যায় একেবারে শেষের পাতায়।
‘কালোয় আলোয়’ একটা বিশেষ সময়ের দলিল। আমরা এমন লেখা খুবই কম পেয়ে থাকি। তাই বারবার এণন বইয়েরই জয়জয়াকার হয়। অতনুর প্রায় তিন দশকের সাংবাদিক জীবন। হঠাৎই লিখে ফেলেছিলেন ‘লায়লায় উপন্যাস’। ফেলে আসা দিনের কিছু ছিন্ন ছবি, কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা। সেটাই বইয়ের আকার পেয়েছে আরও সমৃদ্ধ হয়ে। লেখার জন্য লেখা নয়, অতনু যে ভাবার ঘোরে লিখেছেন, সেখানেই ‘কালোয় আলোয়’ আলাদা।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন