চাইলেই যে হঠাৎ করে অফিস থেকে বেরোতে পারবেন এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই৷ কিন্তু আজকে বড়বাবুকে একবার বলতেই তিনি রাজি হয়ে গেছেন৷ ছুটি দিয়ে দিয়েছেন৷ কোনও জেরা ছাড়াই৷ নির্ঘাৎ কোনও কারণে মন উত্ফুল্ল ছিল৷ অযথা ঘাঁটাতে চাননি৷ টিফিনের সময় কাঁধে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন সাধনবাবু৷
আজকের দিনটা ভীষণ স্পেশাল হতে চলেছে৷ বুক দুরু-দুরু করলেও একটা নিষিদ্ধ অ্যাডভেঞ্চারের রোমাঞ্চ হচেছ৷ এখনও টিপটপ থাকতে পছন্দ করেন সাধনবাবু৷ বেরোবার আগে অফিসের বাথরুমে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেরই মনে হচিছল, আজ একটু বেশি হয়ে গেছে৷ বাস থেকে নেমে শার্ট ঠিক করে নিলেন৷ ডালাহৌসির বাসগুলোতে ভীষণ ভিড় হয়৷ লোকের ঠেলাঠেলিতে সব লন্ডভন্ড হয়ে যায়৷কাঁধের ব্যাগ সামলে পকেট থেকে রুমাল বের করে চশমা খুলে মুখ মুছলেন৷ তারপর হাঁটা লাগালেন৷
নিমতলা শ্মশানঘাটের পাশে গঙ্গার গা ঘেঁষে সিমেণ্টের নক্শিপ্রাচীর ঘেরা মার্বেল বাঁধানো চাতালে এসে বসলেন সাধনবাবু৷ এই চাতালটা অনেককাল আগে তৈরি৷ একদিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর আরেকদিকে প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের আবক্ষ৷ তাঁদের এখানে দাহ করা হয়েছিল৷ তাই স্মৃতিরক্ষা৷ জন্মদিন আর মৃত্যুদিনে স্মৃতিতর্পণ হয়৷ বড় বড় বট আর অশ্বত্থ গাছের ছায়ায় ঢেকে থাকে চাতাল৷ গঙ্গার মৃদু, ঠান্ডা হাওয়া আসে৷ মন জুড়িয়ে যায়৷ জায়গাটা তাঁর অনেকদিনের পরিচিত৷ গত তিরিশ বছরে খুব পরিবর্তন হয়নি৷
পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে সময় দেখলেন সাধনবাবু৷ অঞ্জুর আসতে এখনও বেশ অনেকটা সময় বাকি৷ আগে হাতে একটা পুরনো অ্যংলো-সুইসের ঘড়ি পরতেন৷ দম দেওয়া ঘড়ি৷ অনেকদিন চলেছিল সেটা৷ খারাপ হয়ে যাওয়ার পর আর সারাননি৷ নতুন আরেকটা কেনারও দরকার হয়নি৷ এখন স্মার্টফোনেই সময় মাপার কাজ চলে যায়৷ আর এটাই তাঁর সময়ের সঙ্গে তালমিল রাখার যন্ত্রও৷
শান্তি-অশান্তি বিষয়টা সাধনবাবুর যখন বোধগম্যেই আসেনি, শুনেছিলেন, সুখ স্বপনে শান্তি শ্মশানে৷ স্বপ্ণে সুখটা অবশ্য ততদিনে বুঝে গিয়েছিলেন৷ সকালে ঘুম ভাঙলে পায়জামার দাগ লুকোতে গামছা চাপা দিয়ে বাথরুমে ছুটতে হত৷ পরে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় সেই নিয়ে কত ঠাট্টা-মস্করা৷ কার স্বপ্ণে কে আসে, সেই নিয়ে তক্কাতক্কি৷
ততদিনে তিনতলার রেবার প্রেমে হাবুডুবু খেতে শুরু করেছেন সাধনবাবু৷ রেবা বয়সে বছর দু’য়েকের বড়৷ অবশ্য সে প্রেমের মেয়াদ ছিল একটা গরমের ছুটি৷ মা ঘুমিয়ে পড়লে শুনশান দুপুরবেলা বাড়ির ছাদে রেবার সঙ্গে প্রেম চলত৷ নারী-রহস্যের পর্দা উঠত৷ আগের বছর ফাইনাল পরীক্ষার পর স্কুলের ছুটিতে ছাদে বসেই লুকিয়ে লুকিয়ে ‘সচিত্র কোকশাস্ত্র’ শেষ হয়ে গেছে৷ পুরনো বই-কাগজের দোকান থেকে এক বন্ধু কিনেছিল৷ তারপর হাতে হাতে ঘুরেছে৷ বিবর্ণ কাগজের বইটা চিলেকোঠায় লুকানো ছিল৷ বৃষ্টির জলে সেটার হাল আরও খারাপ হয়ে যায়৷ তাও তার মূল্য বিন্দুমাত্র কমেনি৷
সাধনবাবু মাঝেমাঝেই সেই রেবাকে বলতেন, তাঁকে কোথাও খঁুজে পাওয়া না গেলে সে যেন নিমতলা শ্মশানে চলে যায়৷ সেখানে পাওয়া যাবে৷ ছাড়াছাড়ির আগেটায় চরম মান-অভিমানের পালা চলার সময় সাধনবাবু শ্মশানে এই জায়গায় এসে চুপচাপ বসে থাকতেন৷ একা৷ ভাবতেন, রেবা তাঁর খোঁজে আসবে৷ রেবা আসেনি৷
সাধন রায়, ৫১৷ সরকারি অফিসের কেরানি৷ আদ্যোপান্ত মধ্যবিত্ত মানসিকতার মধ্যে বড় হয়েছেন৷ কৈশোর-যৌবনে সেই মানসিকতা ছেড়ে বেরিয়ে আসার জন্য বাপের সঙ্গে অনেক বিপ্লব করেছেন৷ কিন্ত্ত সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হার মেনে নিজেকেই সেই মানসিকতায় গড়েপিটে নিয়েছেন৷
শ্মশানের এই জায়গাটা কিশোর বয়স থেকেই সাধনবাবুর খুব প্রিয়৷ একবার তাঁর এক বন্ধু লুকিয়ে গাঁজা টানতে এখানে নিয়ে এসেছিল৷ সেই থেকেই জায়গাটা ভাল লেগে গেছে৷ গাঁজা টানার পর ভীষণ খিদে পায়৷ পেট ভরে লিট্টি খেতেন৷ আর কর্পোরেশনের কলের জল৷ বন্ধুদের সঙ্গে কিংবা একা, মাঝে-মধ্যেই মন ভাল না লাগলে সাধনবাবু এখনও চলে আসেন৷ বাঁধানো চাতালে বসে থাকেন৷ একা৷ ‘শান্তি স্বপনে’টা বোঝার চেষ্টা করেন?
বাঁধানো বারান্দার পাশেই ইলেকট্রিক চুল্লি৷ মড়া পোড়ার গন্ধ আসে৷ তার পাশেই কাঠের চিতার ব্যবস্হা৷ মাঝেমাঝে কাঠ পোড়ার ধোঁয়া আসে হাওয়ায়৷ চোখ জ্বালা করে৷ এই বারান্দা সব সময় অবশ্য নিরিবিলি থাকে না৷ মাঝে-মাঝে শ্মশানযাত্রীরা এখানে এসে বসে৷ পরিজনরা কান্ন্াকাটি করে৷ ইনিয়েবিনিয়ে কতকিছু বলে৷ কেউ কেউ আকাশের দিকে তাকিয়ে দার্শনিকের মতো কথা বলে, চিতাতেই সব শেষ৷ বুক নিংড়ানো দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে৷ কেউ কেউ মেতে থাকে ব্যক্তিগত, গার্হস্হ্য আলোচনা বা পরচর্চায়৷ কেউ কেউ সিমেণ্টের বেঞ্চে বাবু হয়ে বসে মদের বোতল খোলে, গাঁজায় টান দেয়৷
শ্মশানের পাশেই ভূতনাথের পুরনো মন্দির রয়েছে৷ আর তার জন্য এখানে যত রাজ্যের ভবঘুরেদের আড্ডাও৷ পুজো দিতে আসা ভক্তরা তাদের লুচি, আলুর তরকারি খাওয়ায়৷ অনেকের অনেকরকম মানসিক থাকে৷ ফলে গেলে নরনারায়ণ সেবা৷ চক্ররেলের লাইনের গা ঘেঁষে ফুলের দোকান, পুজোর ডালার দোকানের মাঝে মাঝে রয়েছে চা-কচুরি-শিঙাড়ার দোকানও৷ তাদের হাতে হিসাব করে টাকা দিয়ে দিলে, তারাই ভবঘুরে, ভিখারিদের লাইনে দাঁড় করিয়ে শালপাতার ঠোঙায় করে লুচি-তরকারি দিয়ে দেবে৷ কয়েক খেপ খেলেই দিনের মতো পেট ভরে যায়৷
তাই এই বারান্দায় মাঝে মাঝে দু’একটা ভবঘুরেও এসে বসে থাকে৷ তারা অবশ্য কোনও গোলমাল করে না৷ নিজেরা নিজেদের মতো ভাবের ঘোরে থাকে৷
প্রথম প্রথম এই সব নিয়ে সাধনবাবুর খুব কৌতূহল হত৷ সবার সব কথা, সব ভাবভঙ্গি ভীষণ উত্সাহ নিয়ে শুনতেন, লক্ষ করতেন৷ এখন সবকিছু গা সওয়া হয়ে গেছে৷ খোঁজটা আসলে শান্তির৷
রেবার বাবার ছিল রেলের চাকরি৷ প্রেমটা ভেস্তে যাওয়ার মাস তিনেক পর ওর বাবা রায়পুরে বদলি হয়ে যান৷ রেবারা এখান থেকে চলে যায়৷ খুব রাগ হয়েছিল সাধনবাবুর৷ দেখা করা দূরে থাক, রেবা অন্তত কোনও বন্ধুর হাত দিয়ে একটা দু’লাইনের চিঠিও তো লিখে রেখে যেতে পারত! তারপর রেবার সঙ্গে আর কখনও যোগাযোগ হওয়ার কোনও সম্ভাবনা ছিল না৷
একালে কারও হারিয়ে যাওয়ার জো টুকু নেই৷ ইচছা করলে কাউকে খঁুজে বের করা কোনও কঠিন ব্যপার নয়৷ রেবাকেও ইচছা করলে খঁুজতে পারতেন সাধনবাবু৷ পাত্তা পেলে আবার হয়তো একথায়-সেকথায় সেই কিশোরবেলার ছাদের প্রেমের কথা তুলতে পারতেন৷ পারেননি৷ আসলে সেই ভদ্র প্রৌঢে়র সমস্যা৷ ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ার ভীষণ ভয়৷
সাধনবাবু আবার পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করলেন৷ লকসি্নে অবন্তিকার ছবি৷ আনলক করার আগে কিছুক্ষণ সেভাবেই ফোনটা ধরে থাকলেন৷ ছবিটা ওঁদের তেরো বছরের মেয়ে সুকন্যার তোলা৷ মোবাইলের ক্যামেরায়৷ ছবিতেই অবন্তিকার চোখের দিকে চেয়ে শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল সাধনবাবুর৷ এই চাউনিটা খুব কঠিন৷ যেন ভিতরটা দেখতে পায় অবন্তিকা৷ কিচছুটি গোপন করা যায় না ওর থেকে৷ আসলে সাধনবাবুরই বউয়ের কাছে ধরা পড়ে যাওয়ার ভীষণ ভয়৷ বউয়ের বাইরে আর কোনও নারীকে কল্পনা করতেও যেন বড় অপরাধী ঠেকে নিজেকে৷ অবন্তিকা জানবে৷ রাগের মাথায় জোরে জোরে জিজ্ঞাসাবাদ করবে৷ মেয়েটা জানবে৷ ছিঃ ছিঃ, লজ্জার শেষ থাকবে না৷ ওই, ভদ্র প্রৌঢে়র সমস্যা৷
মোবাইল আনলক করে হোয়াটসঅ্যাপ খুললেন সাধনবাবু৷ অঞ্জুর ডিপিটা বেশ৷ এখনও যেন পঁচিশে আটকে রয়েছে৷ একমিনিট গঙ্গার দিকে চেয়ে অঞ্জুর এখনকার বয়সটা হিসাব করার চেষ্টা করলেন সাধনবাবু৷ পঁয়তাল্লিশ৷ তারমানে একেবারে অবন্তিকার সমবয়সি৷ আরে হঁ্যা, কখনও তো মনে আসেনি, অঞ্জু আর অবন্তিকার জন্মবছর একই!
ছবিতে অবন্তিকাকে খুব সুন্দর লাগছে৷ ছবিটা শিমলায় তোলা৷ গতবছরই নাকি ওখানে বেড়াতে গেছিল৷ বরের ফুড-চেনের ব্যবসা৷ প্রচুর পয়সা৷ বছরে দু’বার বেড়াতে যাওয়া বাঁধা৷ লোকটা নাকি খুব মদ খায়৷ একবার বসে গেলে সহজে সেখান থেকে ওঠানো মুশকিল৷ তারপর একেবারে বেহেড হয়ে যায়৷ অঞ্জুর কাছেই শোনা৷ সে আক্ষেপ করেছিল, না কি অহঙ্কার করেছিল, ঠিক বুঝতে পারেননি সাধনবাবু৷ উনি অমনটা পারেন না৷ সিগারেটে টানটুকুও যে অবন্তিকা মেপে দিয়েছে৷ তার বাইরে খেতে হলে মিথ্যা বলতে হয়৷ অবন্তিকা নিশ্চয়ই ধরে ফেলে৷ তবে কথা বাড়ায় না৷ তবে মদের ব্যাপারটা লুকানো ততটা সহজ নয়৷ তাই বাধ্য ছেলের মতো মদ থেকে দূরেই থাকতে হয়৷ ভদ্র প্রৌঢে়র সমস্যা৷
শোভাবাজারের সরু গলির পুরনো আমলের বাড়ি ছেড়ে সাধনবাবুও অনেকদিন হল বেলেঘাটার ডাক্তারপাড়ায় বাড়ি করে চলে এসেছেন৷ তবু দিনের বেলাতেও অন্ধকার থাকা সিঁড়ি পেরিয়ে তাঁদের দোতলার ঘরের চুন খসা দেওয়ালের ড্যাম্পের গন্ধ এখনও নাক থেকে যায়নি৷ বালিশ-বিছানাতেও সঁ্যাতসেঁতে গন্ধ লেগে থাকত৷ মাঝেমধ্যেই মা ছাদে গিয়ে বালিশ-তোশক রোদে দিতেন৷
শোভাবাজারে থাকার সময় হেঁটেই নিমতলার শ্মশানে চলে যাওয়া যেত৷ বেলেঘাটায় চলে যাওয়ার পর আর ঘন ঘন আসা হয় না৷ তাছাড়া সংসার আর চাকরির জাঁতাকলে পড়ে নিজের জন্য সময়টুকু বের করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ দৈনন্দিন হাজারো সমস্যা৷ তবু স্মৃতি হাতড়াতে কখনও কখনও চলে আসেন৷ চুপ করে বসে থাকেন এই চাতালে৷ একা৷
অঞ্জুর হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজগুলো পড়লে হারানো যৌবন ফিরে আসে সাধনবাবুর৷ পুরনো ঘা খঁুচিয়ে রক্তাক্ত করার অভ্যাস ছিল অঞ্জুর৷ এখনও আছে৷ ফোনে বিশেষ কথা হয় না৷ তবে হোয়াটসঅ্যাপে চ্যাটিং চলে৷ নিয়মিত৷ কবে কোথায় কোন কথা দেওয়া-নেওয়া হয়েছিল থেকে শুরু৷ এরপর কোথায় ঝগড়া করে মাঝ রাস্তায় ফেলে এসেছিলেন, সব মনে করে করে এখনও জবাবদিহি করে অঞ্জু৷ সাধনবাবু একটু অপ্রস্ত্ততে পড়ে গেলেও মন্দ লাগে না৷ কুড়ি বছর আগের সেই সাধনবাবু তো এখন আর নেই৷ তিনি এখন অনেক পরিণত৷ খুব ভেবে চিন্তে উত্তর দেন৷
অঞ্জু একদিন তো লিখিয়ে ছেড়েছিল যে, ‘তোমাকে ভালবাসি’৷ প্রথমে এড়িয়ে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন সাধনবাবু৷ লিখেছিলেন, ‘পরস্ত্রীকে ভালবাসতে নেই’৷ কিন্ত্ত তাতে অঞ্জুকে দমানো যায়নি৷ মেসেজটা পাঠিয়েই তত্ক্ষণাত্ মুছে ফেলেছিলেন সাধনবাবু৷ ধক্-ধক্ করে হূত্পিণ্ডটা যেন লাফিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছিল৷
পরস্ত্রীর সঙ্গে এমন প্রেমালাপে কুণ্ঠিত হন সাধনবাবু৷ কিন্ত্ত নেশা চেপে গেছে৷ দিনের একটা বিশেষ সময় মিনিট পাঁচেক চ্যাট না করলে বোর লাগে৷ কাজের খেই হারিয়ে যায়৷ এই সময়টা অঞ্জুর স্বামী অফিসে থাকে৷ মেয়েও স্কুলে৷ নিশ্চয়ই রান্ন্া-খাওয়া সেরে বিছানায় গড়াতে গড়াতে চ্যাটিং করে অঞ্জু৷ মাথার ভিজে চুল মেলে দেয়৷ কল্পনা করেন সাধনবাবু৷
অঞ্জু একদিন দুপুরে সাধনবাবুর আবদারে মোবাইলে একটা সেলফি তুলে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে দিয়েছিল৷ বিছানায় আধশোয়া৷ নাইটি পড়া৷ ক্লিভেজ দেখা যাচিছল৷ সন্ধ্যায় বাড়ি ঢোকার আগে পর্যন্ত বাসে, অটোতে বসে কয়েকশো বার সেই ছবি দেখেছেন৷ দরজায় পৌঁছে ডিলিট করে দিয়েছেন৷ সাবধানের মার নেই৷ দূর শালা, ভদ্র প্রৌঢে়র এই এক সমস্যা৷ যদি বউয়ের কাছে ধরা পড়ে যাই...৷ ভয়টা যাই যাই করেও যায় না৷
কেরানির চাকরিতে জীবনটা বিবর্ণ হয়ে গেছে সাধনবাবুর৷ যেমনভাবে ভাবা ছিল, ঠিক তেমনটা হয়নি৷ সকাল হতেই নাকে-মুখে ডাল-ভাত গুঁজে বেরিয়ে পড়তে হয়৷ বাস-অটো পালটে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা পেরিয়ে যায়৷ ঘরে ঢুকলেই মেয়ের স্কুলের-কোচিংয়ের হাজার অভিযোগ৷ বায়না৷ রাতে বিছানায় শোয়ার পর কানের কাছে বউয়ের লক্ষ অভিযোগ৷ ছুটির দিনে দক্ষিণেশ্বরে পুজো দিতে যাওয়া বা কোনও কোনও দিন রেস্টুরেণ্টে খেতে যাওয়া৷ শেষ কবে দূরে কোথাও বাইরে বেড়াতে যাওয়া হয়েছে, দু’মিনিট না ভাবলে মনে করা কঠিন৷ অফিসে ছুটি মেলে তো তখনই মেয়ের স্কুলে পরীক্ষা৷ সব মিলে গেল তো হঠাত্ বউয়ের শরীর খারাপ৷ কিংবা বয়স্ক শাশুড়ি হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন৷ এরমধ্যে আবার পঁয়তাল্লিশ বছরের বউকে মাঝে-সাঝে অনিচছাকৃতভাবে শারীরিক সুখ দিতে হবে৷ না বলা চলবে না৷ বউয়ের কাছে সেটা চরম লজ্জার৷ ভদ্র প্রৌঢে়র সমস্যা৷
সাধনবাবু মাস ছয়েক আগে এই স্মার্টফোনটা কিনেছেন৷ তার আগে সাধারণ একটা বোতাম টেপা ফোন ছিল৷ অবন্তিকার হাতে অবশ্য তার আগেই স্মার্টফোন উঠেছে৷ তা উনি স্মার্টফোন নেওয়ার পর অফিসের এক অল্পবয়সি মেয়ে সহকর্মী ফেসবুক ডাউনলোড করে অ্যাকাউণ্ট খুলে দিয়েছে৷ ছ’মাসেই তরতর করে একশোর বেশি বন্ধু হয়ে গেছে৷ সাধনবাবু মাঝে মাঝে হাসেন৷ ঠিক তাঁদের যুবকবেলার পত্রমিতালির মতো৷ উদারমনা মহিলা বন্ধু চেয়ে কাগজে বিজ্ঞাপন বেরত৷ পত্রের গণ্ডি ছাড়িয়ে সে মিতালি কোনও কোনও সময় অনেক পাতালে নেমে যেত৷ সাধনবাবু শুনেছেন৷
তবে এই ফেসবুকের জন্য কলেজবেলার অনেক বন্ধুকে খঁুজে পেয়েছেন বটে৷ একদিন অফিসে টিফিন টাইমে ফেসবুকে খুঁজতে বসেছিলেন অঞ্জুকে৷ পাওয়া গেছিল৷ একটা নয়, চারটে অঞ্জু৷ আশ্চর্য মেয়ে৷ ফেসবুকে বিয়ের আগের পদবিতে, পরের পদবিতে, আগের-পরের পদবি জুড়ে বিভিন্ন্ অ্যাকাউণ্ট৷ সাধনবাবু সবগুলো নেড়েচেড়ে দেখেছেন, অ্যাকটিভ আছে অবশ্য একটিই৷ পরে জেনেছিলেন, বারবার পাসওয়ার্ড ভুলে যায়, আর তাই নতুন নতুন অ্যাকাউণ্ট খোলে৷ না, অঞ্জুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাননি সাধনবাবু৷ মাসখানেক প্রতিদিন কয়েকবার করে অ্যকাউণ্টগুলো খুলে খুলে শুধু অঞ্জুর ছবি দেখেছেন৷ পর্দার আড়ালে লুকিয়ে জানলা দিয়ে প্রতিবেশিনীকে দেখার মতো৷ আজকাল বেশ কবিতা লেখে অঞ্জু৷ সে যে এত কাব্যিক তা আগে সাধনবাবুর জানা ছিল না৷ সাধনবাবু মনে মনে ভাবেন, তাঁর আঘাতেই কি অঞ্জুর কবি সত্তাটা এমন বাইরে বেরিয়ে এসেছে? কবিতাগুলো সবই হতাশাব্যঞ্জক৷ অনেক সময় সাধনবাবুর মনে হয়, অঞ্জু তাঁকে গাল দিতেই এই সমস্ত কবিতা লেখে৷
চারিদিকের জগত্টা কত বর্ণময়৷ দুর্গাপুজোর ভাসানে ছেলেছোকরাগুলো কেমন ডিজের সঙ্গে নাচতে নাচতে যায়৷ সাধনবাবু ইচছা করলেও পারেন না৷ চক্ষুলজ্জা৷ ভদ্র প্রৌঢে়র সমস্যা৷ লালপাড় শাড়ি পরা বউদিরা রাস্তার মাঝে কোমর দুলিয়ে নাচে৷ সাধনবাবু পাশে ঘেঁষতে পারেন না৷ সংযম৷ ভদ্র প্রৌঢে়র সমস্যা৷ বাসে লেডিজ সিট ফাঁকা থাকলেও ক্লান্ত সাধনবাবু বসতে পারেন না৷ চক্ষুলজ্জা৷ ভদ্র প্রৌঢে়র সমস্যা৷ অফিসের অল্পবয়সি মেয়ে সহকর্মীরা কফি শপে যেতে চাইলে মাথা দোলান৷ কেচছার ভয়৷ ভদ্র প্রৌঢে়র সমস্যা৷ রাত একটা পর্যন্ত অবন্তিকা বিছানায় শুয়ে উল্টোদিকে পাশ ফিরে হোয়াটসঅ্যাপে চ্যাটিং করে৷ প্রবল কৌতূহল হলেও জানতে চান না, ওপারে কে৷ শান্তি, শান্তি৷ ভদ্র প্রৌঢে়র সমস্যা৷
তবু মাঝে মাঝে সাধনবাবুরও এই ভদ্রমানুষের মেকি মুখোশটা ছেড়ে বেরিয়ে আসতে প্রবল ইচছা করে৷ একটু অভদ্র হলে ক্ষতি কী? কোন মহাভারত অশু হবে? অবদমিত ইচছাগুলো বিদ্রোহ ঘোষণা করে বাইরে বেরিয়ে আসতে চায়৷
একদিন মন খুব শক্ত করে অঞ্জুর ফেসবুক অ্যাকাউণ্টে ঢুকে একটা মেসেজ ছেড়ে দিয়েছিলেন সাধনবাবু৷
‘কেমন আছো?’
খুব ক্ষুদ্র অথচ প্রাক্তন প্রেমিকাকে পাঠানো অত্যন্ত গভীর একটি বার্তা৷
দিন দু’য়েক পর জবাব এসেছিল, ‘কেমন আশা করো?’
মাঝের সময়টা খুব দীর্ঘ মনে হয়েছে সাধনবাবুর৷ সেই প্রথমবারই একটি জিজ্ঞাসা ছিল৷ এরপর থেকে ওটা করেছে অঞ্জু৷ তাঁকে জবাবদিহি করতে হয়েছে মাত্র৷ ফোনে সরাসরি কথা হয়েছে একবারই৷ তাও মিনিট পাঁচেকের জন্য৷
প্রথম প্রথম ফেসবুক মেসেঞ্জারেই কথা চলত৷ পরে হোয়াটসঅ্যাপে৷ মাস তিনেক পর আরেকটু সাহস সঞ্চয় করে অঞ্জুকে দেখা করার প্রস্তাবটাও দিয়ে বসেন সাধনবাবু৷ প্রথমেই অবশ্য রাজি হয়নি অঞ্জু৷ অনেক বাহানা করেছিল৷ চরম মানসিক দোটানার মধ্যেও তাকে রাজি করাতে পেরেছেন সাধনবাবু৷ অঞ্জু যেদিন রাজি হয়েছিল, সাধনবাবুর বয়স যেন কুড়ি বছর কমে গেছিল৷ তিনি নিজেই বুঝতে পারছিলেন, চনমনে ভাবটা৷ আশ্চর্য এবং সহজাত অভিনয় গুণে সেই উত্ফুল্লিত মেজাজটা অবন্তিকার কাছে বেমালুম চেপে রাখতে পেরেছিলেন ভদ্র প্রৌঢ় সাধনবাবু৷
গঙ্গার পশ্চিমপাড়ে সূর্যটা নেমে এসেছে৷ এতক্ষণে অঞ্জুর এসে যাওয়ার কথা৷ সাধনবাবুর মনে হল একবার ফোন করেন৷ ফোনবুক খুলেও কী ভেবে বন্ধ করে দিলেন৷ হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ করবেন বলে খুলেই দেখলেন অঞ্জু অনলাইন রয়েছে৷ দুপুরেও অনলাইন ছিল৷ এখনও কার সঙ্গে রয়েছে? সাধনবাবু আর মেসেজ করলেন না৷ ব্যাক করতে গিয়েই চোখ পড়ল অবন্তিকার ডিপিটার দিকে৷ অঞ্জুর নামের ঠিক নিচেই৷ অবন্তিকাও অনলাইন৷ সাধনবাবু বার কয়েক অঞ্জু আর অবন্তিকার ডিপি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেন৷ যেন তুল্যমূল্য বিচার৷ শেষে ফোন লক করে চুপ করে বসে রইলেন গঙ্গার দিকে চেয়ে৷ অঞ্জু তবে এল না!
সম্বিত্ ফিরল ফোনের রিংটোনে৷ কখন অন্ধকার নেমে গেছে খেয়ালই করেননি সাধনবাবু৷ শ্মশানের সামনের রাস্তায় আলোগুলো জ্বলে গেছে৷ আবছায়া আলো এসে পড়েছে চাতালে৷ চোখ কচলে পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করলেন৷ অবন্তিকা ফোন করেছে৷
–‘কি গো, কোথায়? অফিস থেকে বেরোওনি এখনও?’
–‘এই বেরোলাম৷’ ঢোক গিলে বলে কান থেকে ফোনটা নামিয়ে সময় দেখলেন সাধনবাবু৷ আটটা বাজতে যায়৷ অন্যদিন এতক্ষণে বাড়ি পৌঁছে যান তিনি৷ গঙ্গার পাড়ে এসে কীভাবে সময়টা গড়িয়ে গেছে, বুঝতে পারেননি৷ আবার ফোন কানে ধরে বললেন, ‘একটু জরুরি কাজ পড়ে গেছিল৷ দেরি হয়ে গেল৷’
ওপারে বেশ কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ৷ সাধনবাবুর ভয় হল৷ অবন্তিকার কাছে ধরা পড়ে যাননি তো৷ খুব মৃদু স্বরে বললেন, ‘হ্যালো–
ওপারে অবন্তিকা, ভাল লাগছে না৷
–‘কেন? কী হয়েছে?’
–‘কিছু হয়নি...এমনি ভাল লাগছে না৷ তাড়াতাড়ি এসো৷’
ফোনেও অবন্তিকার নিশ্বাসের শব্দে ওর মন বুঝতে পারেন সাধনবাবু৷ কিছুক্ষণ চুপ থেকে সেটাই ঠাওর করার চেষ্টা করলেন৷ খুব ধীর গলায় বললেন, ‘আসছি৷’
ফোন পকেটে রেখে বুক ভরে নিশ্বাস নিলেন সাধনবাবু৷ তারপর দ্রূত পায়ে মেন রাস্তার দিকে এগোতে লাগলেন৷ একটা ট্যাক্সি ধরে নিতে হবে৷
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন