দুর্গম, কিন্তু অনতিক্রম্য নয়...

সনাতন

অনেকটা পথ পেরিয়ে আসার পর এই গাছটার নীচে দাঁড়ালেই পিঠনের দিকে কেন যেন চোখ চলে যায়। সব কবিই এই অবধি আসার পর পিছু ফিরে চায়। স্বয়ং রবি ঠাকুরও সম্ভবত এই অবধি পৌঁছে পিছন পানে চেয়ে লিখে ফেলেছিলেন, ‘আজ হতে শতবর্ষ...’।

কবিতা। কিন্তু কাব্য নয়। অন্তরের গভীর অন্তস্থল থেকে উঠে আসা গুটিকয় কথা।

কবি সমীর মজুমদার কাব্যজগতে পরিচিত নাম। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তাঁর কবিতা বহুদিন ধরে পড়ছি। তাঁর গুনমুগ্ধদের তালিকায় শুধু কবিবন্ধুরাই নয়, সাধারণ পাঠকও আছেন। তবে কিনা, কবি সমীরের বইয়ের সংখ্যা খুব বেশি নয়। যেন আটপৌরে গেরস্থের শোকেশে সাজানো মাটির পুতুল হতে তাঁর ঘোর অনীহা। তবে গুটিকয় কবিতা সঙ্কলন চিনিয়ে দিয়েছে, সমীর জাত কবি।

যেমন আমার হাতে এখন রয়েছে ‘অধিদেবতার হাসি’ কবিতার সঙ্কলন বইটি। সমীরের একক কাব্যগ্রন্থ। আমার প্রথম পঙক্তিটি আসলে সেই কাব্যগ্রন্থের প্রথম ‘কবিতা’। গৌড়চন্দ্রিকা ছাড়াই এমনভাবে কোনও কাব্যগ্রন্থ শুরু হতে আমি বিশেষ দেখিনি। আমি বারবারই দেখেছি কোনও প্রবীণ, বিশিষ্ট কবি কাব্যগ্রন্থের ভূমিকা লিখে দিয়েছন। কবির নিজের কাব্যগ্রন্থটি সম্পর্কে দু’-এক কথা লেখা হয়। আমি তো এমনও দেখেছি বিখ্যাত কবিদের ভূমিকার উল্লেখ করে নতুন ‘কবি’দের বইয়ের বিজ্ঞাপনও হয়ে থাকে। সেদিক থেকে সমীর আমাকে নিরাশ করেছে। কাব্যগ্রন্থটির নামকরণের সার্থকতা খেঁাজার ভার দিয়ে কবি যেন আমার পরীক্ষা নিতে বসেছে! তেমনই, যেমনটা সচরাচর হয়ে থাকে, বুককভারের পিছনের পাতায় কবির ছবি-সহ সংক্ষিপ্ত জীবনালেখ্য থাকে। সমীর সেটাও করেননি। কবির আত্মগোপন করার এই ইচ্ছাও আমাকে অবাক করেছে।

আসলে এই দর্শনটা আমি সমীরের কবিতাতেও যেন খঁুজে পাচ্ছি।

‘মানুষযত খ্যাতি ও প্রতিপত্তি উপার্জন করে,

ততো তার হৃদয় ভরে ওঠে বিষে’

সমারের কাব্যগ্রন্থের তৃতীয় কবিতা। শিরোনামহীন কবিতা। সমীরের এই কাব্যগ্রন্থে মোট চৌঁত্রিশটি কবিতা আছে। কোনওটিরই নাম নেই। প্রায় তিন ডজন কবিতা একএকেটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ, কিন্তু সবগুলোই একসূত্রে গাঁথা। একে অপরের অত্যন্ত আপন।

কবিদের তো রাগ থাকবেই, সমাজ-সংসারের উপর। প্রচিলিত রীতি-নীতি-প্রথার উপর। কিন্তু তার বুকে থাকে অগাধ প্রেমও। সমীরের কবিতায় অবশ্য প্রেম কম। শব্দবন্ধে শুধু রাগ উগড়ে দেওয়া! ভুল বললাম। কাব্যগ্রন্থের নির্যাসটাই প্রেম। পাঠককে খুঁজে নিতে হবে।

আসলে সমীরের ষষ্ঠ কবিতাটির শিরোনাম হতে পারে ( হতে পারে এই জন্য বললাম, সেটা ঠিক করা একান্তভাবে কবির নিজের অধিকার) ‘অধিদেবতা হাসি’।

দুই পঙক্তির কবিতা।

‘যতবার ছিন্ন হই, অনাহারে কাঠ হই, অসুখে পড়ি, শরণ নিই অধিদেবতার, দেখি, তাঁর মুখে ঝুলে আছে একটুকরো মৃদু হাসি।’

আমি দ্বিতীয় তথা শেষ পঙক্তিটি বলব না।

একটা জায়গাতেই সমীরে এই কাব্যগ্রন্থের দুর্বলতা–কবিতা গুলি চয়নে আরও যত্ন নিতে হত। তাছাড়া, কেন বুঝলাম না, সমীর ওঁর বেশিরভাগ কবিতাতে অতিবেশি ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করেছে। একেক সময় মনে হয়েছে, কবিতা অতি আধুনিক করতে ইচ্ছাকৃতভাবে ইংরেজি শব্দ ব্যবহারের জন্যই কবিতাটি সমীরকে পেয়েছে। আমি বলছি না যে বাংলা কবিতায় বিদেশি শব্দ অমার্জিত, তবে অধিক ব্যবহার বৈসদৃশ্য। হয়তো এটাই আর কিছুদিন পর আধুনিক কবিতার পাঠকরা গ্রহণ করবেন। সেদিক থেকেও মোটের উপর একটি নতুন আঙ্গিকের কাব্যগ্রন্থ আমাদের উপহার দিয়েছেন সমীর।

অধিদেবতার হাসি

সমীর মজুমদার

ছোঁয়া

দাম ৬০ টাকা

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন