রামকিঙ্করের মুখ



সুমন্ত্র মুখোপাধ্যায়

মনটা ভাল নেই শ্যামসুন্দরের।

লেখার চেষ্টা করছেন, কিন্তু লেখা আসছে না। মাথায় ঘুরছে, কিন্তু কলমের ডগায় এসে জট পাকিয়ে যাচ্ছে। গত কয়েকদিন অনেকবার চেষ্টা করছেন লেখাটা নিয়ে বসার। কিন্তু লিখতে গেলেই, মনে পড়ে যাচ্ছে অবহেলা মাখানো রামকিঙ্করের মুখখানি। এরপরেই শ্যামের মনে ঝড় উঠছে। যা লিখবেন ভেবেছিলেন, তা গলার কাছে এসে কুণ্ডলী পাকিয়ে যাচ্ছে।

আসলে রামকিঙ্করের মুখের মধ্যে একটা অদ্ভুত মায়া লক্ষ্য করেছিলেন শ্যামসুন্দর। তাই ছেড়ে আসার সময়, মন চায়নি। অনেক কষ্ট করে রামকিঙ্করের হাত ছাড়িয়েছিলেন। উঠে পড়েছিলেন গাড়িতে। তারপর থেকে কেমন যেন একটা গুমোট তাঁর জীবনে। চোদ্দ বছর বিয়ে হয়েছে তনিমার সঙ্গে। কিন্তু কোনও দিন তাঁর প্রশ্নের কোনও উত্তর দিতে ভোলেনি শ্যাম। তবে, গত কয়েকদিন সব ওলট-পালট হয়ে যাচ্ছে।

–তোমার কী হয়েছে ? জিজ্ঞাসা করেন তনিমা।

–না কিছু না। উত্তর দেন শ্যামসুন্দর। বলেন, এক কাপ চা দিতে পারবে।

তনিমা বলেন, বসো এনে দিচ্ছি।

একটু হালকা হয় শ্যামের মন। চা করতে রান্নাঘরে যান তনিমা। চোদ্দ বছরের বিবাহিত জীবনে শ্যামসুন্দর ও তনিমা নিঃসন্তান। শ্যামসুন্দর বসু কলকাতার অন্যতম একটি বড় দৈনিকের চিফ পলিটিক্যাল এডিটর। আর তনিমা পড়ান কলেজে। সংসারে অভিধানে অভাব বলে কোনও শব্দই নেই তাঁদের। কিন্তু রামকিঙ্করের কথা মনে পড়লেই নড়ে যায় শ্যামের মন। চল্লিশ বছরের জীবনে অনেক অভিজ্ঞতা। কিন্তু রামকিঙ্কর যেন অন্যমাত্রা।


শিবকাশি। দেশের দক্ষিণ ভাগের এক প্রান্তিক জনপদ। বাজি তৈরিই এখানে জীবনের বাজি। সেই বাজি জিততেই বছর দশেক আগে বাংলা ছেড়েছিলেন রামজীবন সমাজদার। বাঁকুড়ার ভিটে ছেড়ে চলে এসেছিলেন ভিন রাজ্যে। এক দশক পরেও অবশ্য রামজীবনের জীবন সেই তিমিরেই। সেদিনও দিনমজুর, আজও তাই।

মেট্টাখোল। এই শ্রমিক মহল্লাতেই থাকেন রামজীবন। হোগলাপাতার ছয় বাই চারের ঘরে রামজীবনের সংসার। স্ত্রী সুধা তাঁর সঙ্গেই কাজ করেন বাজি কারখানায়। রোজ সকালে দুটি মুখে দিয়ে রামকিঙ্করের জিম্মায় সবকিছু ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন বাজি তৈরির কাজে। সারাদিন কত কাজ। বাজির মশলা তৈরি থেকে খোলের মধ্যে তা ঠেসে ঢোকানো। দীপাবলি তো বটেই, দেশে ভোটবাদ্যি বাজলে আবার কাজ দ্বিগুণ হয়। তখন নাওয়া-খাওয়া মাথায় ওঠে তাঁদের। কারণ, যত বেশি বাজি, তত বেশি টাকা।

এমনিতে সারাদিনে রোজ একশো কুড়ি টাকা। একবার একদিনে চারশো টাকা উপার্জন করেছিলেন রামজীবন। মনটা সেদিন আনন্দে ভরে গিয়েছিল। বাড়ি ফিরে সুধার হাতে সেই টাকা তুলে দিয়েছিলেন। আর একটা খবর তাঁকে শুনিয়েছিলেন সুধা। রামকিঙ্করের আসার খবর। সে দিন থেকেই রামজীবনের বড় ভরসা রামকিঙ্কর।

চার বছর আগে এক শ্রাবণ মাসে রামকিঙ্করের জন্ম। শিবকাশির এক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সুধার কোল আলো করেছিল রামকিঙ্কর। পুত্র সন্তানের জন্মে সহকর্মীদের লাড্ডু খাইয়েছিলেন রামজীবন। হঠাৎ করে তাঁর চোখে ভেসে উঠেছিল বাঁকুড়ায় তাঁদের দওয়ার ছবি। তিনি স্পষ্ট দেখেছিলেন সমাজদারদের উঠোন ভরেছিল নতুন অতিথিকে দেখতে। এ-তো স্বপ্ন! তাঁর মতো গরিবের এই স্বপ্ন বাস্তবের জমিতে অলীক। তা-ই রামকিঙ্কর আসার পর রামজীবনের জীবনে সুখের মেয়াদও ছিল বড় অল্প।

রামকিঙ্কর যেদিন হামা টানতে শিখল, সেদিনই সুধা বুঝে গেলেন, ছেলে বড় হচ্ছে এবার একা ছাড়ার সময় হয়েছে। একরত্তি রামকিঙ্করকে বাড়িতে রেখেই রামজীবনের সঙ্গে ফের কারখানা যেতে শুরু করলেন সুধা। দু বছর পর সুধার কোল আলো করল সুতপা। সেদিন দাদা রামকিঙ্করের মুখে এক তৃপ্তি দেখেছিলেন সুধা।

–মা, বোন আমার কাছে থাকবে। আদো গলায় আবদার করেছিল রামকিঙ্কর। ছেলের কথা শুনে আনন্দে ভেসেছিল সুধার চোখ। একরত্তি ছেলেটা কে সামলাবে ভেবেই তাঁর দিন-রাত এক হয়ে যায়, আর দু বছরের ছেলে কিনা বলে বোনের দায়িত্বে নেবে। সুধাকে বোঝায় রামজীবন। আসলে দিন দরিদ্রদের সংসারে এটাই নিয়ম। রামকিঙ্করের জন্মের পর একবার বাঁকুড়া ফিরে যাওয়ার কথা ভেবেছিলেন রামজীবন। কিন্তু বাস্তব হয়নি। কারণ, তাঁদের রোজগারে ফিরে যাওয়া বিলাসিতা। নিজের ভিটেতে ফিরতে অনেক টাকা লাগবে, সেই অঙ্কটা কষতে বুক কেঁপেছিল রামজীবনের।

বাবা-মা কারখানায় বেরিয়ে গেলে বোন সুতপাকে নিয়েই সময় কাটে চার বছরের রামকিঙ্করের। সবসময় আগলে রাখে বোনকে। মহল্লার বাকি ছোটরা যখন খেলার মাঠে বল পেটায়, তখন সুতপাকে পাহাড়া দেয় দাদা রামকিঙ্কর। একদিন দরজার সামনে বসে হঠাৎ করে রামজীবনের মনে পড়ে যায় একটা পুরোন কথা। সুতপা তখনও হয়নি। একবার রামকিঙ্করকে কোলে করে মেলায় নিয়ে গিয়েছিলেন। একটা খেলনা গাড়ি দেখে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল রামকিঙ্কর। ছেলের পছন্দে সেদিন সায় দিতে পারেননি বাবা। কারণ, খেলনা গাড়ি কেনার সামর্থ তাঁর ছিল না। কী মনে হয়েছিল, কে জানে... উপরের মাড়িতে সদ্য দুটি দাঁত নিয়ে বাবার দিকে থাকিয়ে হেসেছিল রামকিঙ্কর।


–কী গো তুমি ফিরবে না।

–এই তো শেষ লাইন লিখছি। একটু পরেই চলে আসব।

এক বিরল রোগে আক্রান্ত গোটা দেশ। দিনের পর দিন বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। মৃত্যু মিছিল বিশ্বজুড়ে। আর দিনে দিনে শ্যামসুন্দরের জন্য চিন্তা বাড়ছে তনিমার। প্রায় চোদ্দ দিন পর আজ অফিস গিয়েছেন শ্যামসুন্দর। হাতে অনেক কাজ। আজ তাঁকে অনেক কপি ছাড়তে হবে। এরমধ্যে পাঁচবার ফোন করেছেন তনিমা। আসলে হায়দরাবাদে শ্যামের আটকে পড়ার পর থেকেই উদ্বেগ বেড়েছে তনিমার। লক্ষ্য করছেন তাঁর চেনা মানুষটি কেমন অচেনা হয়ে যাচ্ছেন...সারাদিন-ই কেমন অন্যমনস্ক, উদাসীন। কিন্তু বাষট্টি দিন আগেও এমনটা ছিলেন না শ্যামসুন্দর।

অতিমারিতে স্তব্ধ কলকাতা। শুনশান রাজপথ। ম্যান্ডিভিলা গার্ডেন্সে কোকিল ডাকলে নাকি তা শোনা যাচ্ছে হাতিবাগান থেকে। আর সন্ধে নামতেই শুরু কার্ফু। এই অবস্থায় চোদ্দদিন পর অফিস গিয়েছেন শ্যামসুন্দর। তাঁদের কাগজের অফিস বন্ধ নয়। বরং এখন সবচেয়ে বেশি কাজ। তবে, আজ শ্যামসুন্দর ঠিক করেছে বাড়ি ফিরেই লেখাটা নিয়ে বসবেন। রাত দশটায় অফিসের কাজ শেষ করে তাঁর গাড়ি ছুটল নিউআলিপুরে ফ্ল্যাটের দিকে। রাতে ভাল করে স্নান সেরে খাবার টেবলে বসলেন শ্যামসুন্দর।

–তোমার কী হয়েছে বল তো ? প্রশ্ন করেন তনিমা।

–কই কিছু না তো। মৃদু উত্তর শ্যামের।

–শ্যাম আমি তোমাকে লক্ষ্য করছি এই ক’দিনে তুমি কেমন একটা যেন বদলে গেছো। কী হয়েছে তোমার?

শ্যাম বুঝতে পারে তনিমা আজ মরিয়া। রামকিঙ্কর..., –উত্তর দেন শ্যামসুন্দর।

–কে রামকিঙ্কর ? প্রশ্ন করে তনিমা।

–চার বছরের একটা ছোট্ট ছেলে। যে আমার পৃথিবীকে বদলে দিয়েছে। জবাব দেন শ্যামসুন্দর। আমি ওর ওই চোখ কিছুতেই ভুলতে পারছি না তনু। সবসময় মনে হচ্ছে রামকিঙ্কর আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এখনও কানে বাজছে, আমাকে নিয়ে যাবে তোমার সঙ্গে। দেখ আমার বাবা-মা আর হাঁটতে পারছে না। কিন্তু আমি হাটতে পারব তোমার সঙ্গে। আমাকে নিয়ে যাবে....।

কীভাবে হাঁটবে ছেলেটা! পায়ের দু’টি পাতাই দগদগ করছে পুড়ে গিয়ে। অতিমারি থেকে জীবন বাঁচাতে তীব্র গরমে বাবা-মার সঙ্গে বাঁকুড়া ফিরছিল চার বছরের ছেলেটা। সেই সুদূর শিবকাশি থেকে। প্রায় আড়াই হাজার কিলোমিটারের রাস্তা, এই চার বছরেই পার করতে চেয়েছিল পায়ে হেঁটে।


তিন দিন হয়ে গেল। সুতপার জ্বর কিছুতেই কমছে না। চিন্তা বাড়ছে সুধার। শ্রমিক মহল্লার স্বাস্থ্যকেন্দ্রে মেয়েটাকে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু ডাক্তারবাবু বেশি কিছু বলতে পারেননি। সামান্য কটা ওষুধ দিয়েই সুতপাকে দেখে দিয়েছিলেন। সুধা লক্ষ্য করেছিলেন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেন অতিমাত্রায় ভিড়। বাচ্চা থেকে বুড়ো সবাই এসেছে জ্বর নিয়ে। কোনও রকমে সুতপাকে নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন সুধা। দু’দিন ওষুধ খাওয়ানোর পর হঠাৎ সুধা অনুভব করল কেমন যেন ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে কোলের মেয়েটা। ভোরবেলা বোনকে জড়িয়েই ঘুমচ্ছে রামকিঙ্কর। গত তিনদিন বোনের অসুখে ছেলেটার ভাল করে খাওয়া হয়নি। বাইরে খাটিয়ায় শুয়ে রামজীবন। মেয়ের গায়ে হাত দিয়ে সুধা বুঝতে পারল, সব শেষ হয়ে গিয়েছে। তাঁর কান্নায় ঘুম ভাঙল রামজীবনের। তিনিও ছুটে এলেন ঘরের ভিতরে। তখনও বোনকে জড়িয়েই শুয়ে রামকিঙ্কর।

সুতপার মৃত্যু মেনে নিতে পারেনি রামকিঙ্কর। মেনে নিতে পারেনি সংসারের সর্বনাশ। কারখানার কাজ হারিয়ে আজ জীবনের সব বাজি শেষ রামজীবনের।

ঘরে চাল-ডাল যা ছিল সব শেষ হয়ে গিয়েছে। এদিকে, ক্রমশ ফাঁকা হচ্ছে মহল্লা। জীবন বাঁচাতে শ্রমিকরা একে একে ফিরছে নিজ বাড়িতে। কেউ থাকেন মহারাষ্ট্রে। কেউ আবার উত্তরপ্রদেশে। ধীরে ধীরে তেল শূন্য হয়ে যাচ্ছে সুধার সংসার। তাই সাঁঝে আর বাতি জ্বলে না রামজীবনের ঘরে। ঘটি-বাটি যা আছে গুছিয়ে না-ও সুধা। আমরা কাল সকালেই বেরবো। রামজীবনের কথা শুনে বুক কাঁপে সুধার। রামজীবনের কথার প্রতিবাদ করেন সুধা। বলেন, ‘এইটুকু ছেলেকে নিয়ে কী করে অতটা পথ যাব। রেল-গাড়ি সব বন্ধ। এতটা রাস্তা পেরিয়ে।’ সুধার কথা কানে নেন না রামজীবন। শুধু বলেন, ‘গুছিয়ে না-ও আমরা কালই বেরবো।’

–হ্যালো তনু, আমার সুটকেসটা গুছিয়ে দাও। দিবাকরকে পাঠিয়েছি, ও গিয়ে নিয়ে আসবে। আমি আজ রাতের ফ্লাইটে হায়দরাবাদ যাচ্ছি। ফিরতে দিন সাতেক সময় লাগবে। প্রায় এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে গেলেন শ্যামসুন্দর। তনিমা এমন ফোন আগেও পেয়েছে। তাই এখন আর আলাদা কোনও টেনশন হয় না। ফোন ছাড়তেই দরজায় বেলের আওয়াজ শুনতে পেলেন তনিমা। দরজা খুলে দেখল ড্রাইভার দিবাকর দাঁড়িয়ে আছেন। রাতেই ফ্লাইটে খবরের সন্ধানে হায়দরাবাদ উড়ে গেলেন শ্যামসুন্দর। শহর ছাড়ার আগে এক বিরল রোগের কথা তিনি জেনে গিয়েছেন। কারণ, তাঁদের খবরের কাগজের প্রথম পাতায় বেশ ফলাও করে ছাপা হচ্ছিল ওই রোগের কথা। চিন থেকে জন্ম নেওয়া ওই রোগকে ঘিরে কলকাতার রোয়াকের আড্ডায় অনেক ঠাট্টা, তামাসাও হচ্ছে। তবে সেই রোগও যে কাউকে ছাড়বার পাত্র নয়, তা ততদিনে বুঝিয়ে দিয়েছে। থমকে গিয়েছে বিশ্ব অর্থনীতি। আমেরিকা, ইতালির মতো দেশ ততদিনে ধরাশায়ী। আর ঝুঁকি না নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই রোগকে অতিমারি বলে ঘোষণা করেছে।

হায়দরাবাদে প্রথম পাঁচটা দিন ভালই কাটল শ্যামের। অফিস ও তনিমার সঙ্গে সবসময় যোগাযোগ আছে। এরমধ্যেই খবর আসছিল ভারতেও দ্রুত ছড়াচ্ছে এই রোগ। বিশেষ করে বিদেশ থেকে যাঁরা আসছেন, তাঁদের বেশির ভাগ এই রোগে আক্রান্ত। কাজ সেরে হোটেলে ফিরে কপি পাঠাচ্ছিলেন শ্যামসুন্দর। টেলিভিশনে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ শুনে মাথাটা খানিকক্ষণের জন্য আটকে গেল। মোবাইল বেজে উঠতেই স্ক্রিনে ভেসে উঠল তনিমার ছবি।

–তুমি কীভাবে ফিরবে? তনিমার প্রশ্নে বেশ বিব্রত শ্যাম। প্রায় পঁচিশ বছরের কর্মজীবনে, এমন দিন তিনিও দেখেননি। ঠিক ফিরে আসব তনু, তুমি একটু ধৈর্য্য ধর। দেখবে ঠিক ফিরে আসব। তনিমাও জানেন, শ্যামের ফেরার পথ সব বন্ধ। নিজের সব সোর্সকে ফোন করতে শুরু করলেন শ্যামসুন্দর। ভোর তিনটে পর্যন্ত ফোনের পর নিট ফল দাঁড়াল শূন্য। এদিকে যে কাজে হায়দরাবাদে আসা, সেই কাজও থমকে গেল। নিরুপায় শ্যামসুন্দরের আস্তানা নিজামের শহরের এক পাঁচতারার ঘর। দিন কাটতে চায় না। রাস্তায় বেরতো পারছেন না। ওদিকে, কলকাতায় তনিমা একা। তারমধ্যে তাঁদের নিউআলিপুরের ফ্ল্যাটের খুব কাছেই রোগের প্রকোপ বাড়ছে। গোটা কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় রোজই বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা।


–চল সুধা আমরা হাঁটা শুরু করি। রামজীবনের কথা সায় ছিল না সুধার। তবুও, রামকিঙ্করের জীবন বাঁচাতে এই ঝুঁকিটাই নিয়েছিলেন। কখনও মায়ের কোলে, আবার কখনও বাবার কোলে করে মাইলের পর মাইল পেরিয়ে এল একরত্তি রামকিঙ্কর। খাবার বলতে রাস্তার ধার থেকে পাওয়া জল। আর বিস্কুটের প্যাকেট। আর চোখের সামনে অনেক কিছু দেখা। কিন্তু এ ভাবে কত পথ ? উত্তর নেই রামজীবনের কাছে। তিনি শুধু জানেন, তাঁরা পরিযায়ী। বাঁচতে হলে এ ভাবেই চলতে হবে। প্রায় কুড়ি ঘণ্টা পথ হাঁটার পর আটকে যাচ্ছে রামজীবনের পা। শুকিয়ে যাচ্ছে সুধার শরীর। আর এই বিশ ঘণ্টায় অনেক কিছু দেখে ফেলেছে ছোট্ট রামকিঙ্কর। আর খুব অল্প হলেও বুঝতে পারছে এই পৃথিবী তার দুনিয়ার মতো নয়। নরম মাটি নেই, আছে রুক্ষ বালি-পাথর। যার উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তার পায়ের তলা এখন জ্বলছে। দগদগ করছে তার দুটি পায়ের পাতা।

–আমি আর চলতে পারছি না। পিছন থেকে রামজীবনের জামা আঁকড়ে ধরেন সুধা।

–দয়া কর। আমি আর হাঁটতে পারছি না।

ঘুটঘুট করছে অন্ধকার। রাস্তার পাশ দিয়ে হুশ হুশ করে চলে যাচ্ছে লরি। সেই লরির মাথায় তাঁদের মতো আরও হাজার হাজার পরিযায়ী। রাস্তার ধারা একটা ফাঁকা জলের পাইপ চোখে পড়ল রামজীবনের। জায়গার কী নাম, কোন অঞ্চল– এ সব কোনও কিছুই জানে না রামজীবন। শুধু ঠাহর করতে পারে গত বিশ ঘণ্টা হেঁটে এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে এসেছেন তাঁরা। এখনও অনেক পথ হাঁটতে হবে। তারপর আসবে বাংলা, আরও পরে বাঁকুড়া।

–আজ রাতটা আমাদের এই পাইপের মধ্যেই থাকতে হবে, বুঝলে সুধা। সুধা কী বুঝল জানেন না। শুধু বলেন হ্যাঁ।

–ছেলেটার জন্য একটু খাবার আনতে পারবে? দেখ না সামনে তো একটা দোকান দেখা যাচ্ছে। বল না আমরা অনেক দূর থেকে আসছি ছেলেটার জন্য একটু খাবার দিতে। রামজীবনকে অনুরোধ করেন সুধা। রামজীবনও অনুরোধ ফেলতে পারেন না।

–রামকিঙ্করকে নিয়ে তুমি এই পাইপের মধ্যে থাক, দেখি খাবারের কী ব্যবস্থা করতে পারি? সুধাকে আশ্বাস দিয়ে দোকানের দিকে এগিয়ে যান রামজীবন। চার বছরের রামকিঙ্করকে বুকে মধ্যে টেনে নিয়ে পাইপের মধ্যেই বসে থাকেন সুধা। তেষ্টায় গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। সঙ্গে একটু বিস্কুট ছিল। রাস্তায় পাশ থেকে পেয়েছিল। তা-ও শেষ হয়ে গেছে। তাই ছেলেটার জন্য খাবারের অপেক্ষা করেন মা। এই পাইপে রাত্রিযাপন মাত্র কয়েক ঘণ্টার। কারণ, রামজীবন বলে গিয়েছেন, কাল সকালে আবার হাঁটতে হবে।

রাস্তা পেরিয়ে একটা দোকানের সামনে দাঁড়ান রামজীবন। গত দশবছর শিবকাশিতে থাকার ফলে তামিল ভাষাটা অল্প অল্প রপ্ত করেছেন তিনি। কিন্তু খাবার কেনার টাকা, সেটা তো নেই তাঁর কাছে। একবার ভাবলেন, অনুরোধ করবেন, আবার ভাবলেন যদি অপমান করেন দোকান মালিক। গরিবের আবার মান-সম্মান– এই কথাওটা মাথায় খেলল রামজীবনের। কিন্তু তাঁকে কিছুই করতে হল না। প্রায় কুড়ি ঘণ্টা হাঁটার পর ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট মধ্য তিরিশের রামজীবনের শরীর। দূর থেকে ভবঘুরে মনে হতেই পারে। হয়তো তাই ভেবেই খানিক খাবার তাঁর হাতে তুলে দিলেন দোকান মালিক। খাবার নিয়ে সেই পাইপের আস্তানায় ফিরলেন রামজীবন। দূষণের চাদড় ছিঁড়ে আকাশে তখন তারাদের সাম্রাজ্য। রামজীবন দেখলেন, মায়ের বুকে নিজেকে সোপে দিয়েছে ক্লান্ত, বিষন্ন রামকিঙ্কর। আর ছেলের কপালে চুমু খেয়েই ঘুমের দেশে সুধা।


দেখতে দেখতে বাষট্টি দিন। এর আগে অনেকবার তনিমা ফোন করেছেন শ্যামসুন্দর। কিন্তু এই ফোনে তনিমার মনে রামধনু খেলে গেল।

–তনু আমি একটা গাড়ির ব্যবস্থা করেছি। তেলঙ্গনা সরকারের থেকে পাসও হয়ে গিয়েছে। কাল সকালেই রওনা দিচ্ছি। দুটি ড্রাইভার থাকবেন। ননস্টপ আসছি। আশা করছি পরের দিন বিকেলে বাড়ি পৌচ্ছে যাব।

একটা আনন্দমাখা গলায় তনিমাকে ফেরার খবরটা জানালেন শ্যামসুন্দর। সাতদিনের কাজ করতে গিয়ে টানা বাষট্টি দিন হায়দরাবাদে বন্দি শ্যামসুন্দর। শ্যামের আনন্দে ততধিক উদ্বেগ তনিমার গলায়– ‘সাবধানে ফিরবে। রাস্তায় কোথাও নামবে না। খাবার সঙ্গে নিয়ে নেবে। আর লোকেশন অনলাইন রাখবে।’

ঠিক ভোর পাঁচটায় হোটেলের সামনে এল শ্যামসুন্দরের গাড়ি। মহেশবাবু আর পুলেল্লা অশোক– দুই সারথিকে নিয়ে শুরু হল শ্যামের কলকাতা সফর। শহর থেকে হাইওয়েতে উঠতেই রাস্তার দু’ধারে শ্যামের চোখে পড়ল পরিশ্রান্ত পরিযায়ীদের বাড়ি ফেরার মরিয়া চেষ্টা। দেশে আজ অতিমারির প্রকোপ। যাঁদের কাঁধে দেশের অর্থনীতি, তাঁরাই আজ ব্রাত্য, পরিশ্রান্ত। সরকারি সিদ্ধান্ত খুব হঠকারি বলেই মনে হয়েছিল শ্যামের। তবুও বিপর্যয় মোকাবিলায় সরকারি সিদ্ধান্তকে তিনিও সমালোচনা করতে পারেননি।

শহর, মফস্বল, মহল্লা পেরিয়ে দুপুরে অন্ধ্রপ্রদেশের রাজামুন্দ্রি বলে এক জায়গায় এসে থামল শ্যামসুন্দরের গাড়ি। রাস্তার ধারে একটু ছাওয়া দেখে গাড়িটা থামাতে বললেন। দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য দরজা খুলে হাত ধুতে নেমেছিলেন শ্যাম। চোখ চলে গেল রাস্তার ধারে থাকা একটা পাইপের মধ্যে।

একটা মায়াবী চোখ তাঁকে টেনে আনল ওই পাইপের দিকে। নাম জানতে চেয়ে প্রথম অবাক হলেন শ্যামসুন্দর।

–রামকিঙ্কর। স্পষ্ট বাংলায় উত্তর দিল ছোট্ট ছেলেটা।

অবাক হলেন শ্যামসুন্দর। তবে বুঝতে অসুবিধা হল না, এই ছেলেটিও পরিযায়ীর দলে।

–কোথা থেকে আসছ, আবার প্রশ্ন করলেন শ্যাম। অনেক দূর থেকে পালটা উত্তর রামকিঙ্করের।

–কীভাবে আসছ? শ্যামের প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই, উত্তর হেঁটে।

পরিস্থিতি কতটা গুরুতর তা বুঝতে আর দেরি হল না শ্যামসুন্দরের। কালো ছেলেটা পাঁজরের হাড় তখন রেললাইনের মতো দেখাচ্ছে, ছোট্ট দুটি গালের হনুতে লেগে আছে মাইলের পর মাইল হাঁটার ধকলের চিহ্ন। ক্লান্তিতে কোঠরে ঢুকে যাওয়া চোখ দেখে শ্যামের মনে হল, এই দেশে যাঁরা আসল সংখ্যাগুরু সেই গরিব মানুষদের সঙ্গে প্রতারণা এবারও ব্যতিক্রম হয়নি। তাঁদের রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে বলা হয়েছে, যাও নিজেদের মতো করে ব্যবস্থা করে নাও। কী খাবে, কী পারবে– এ সব ব্যবস্থা এই পরিস্থিতিতে তাঁদেরই করতে হবে। তাতে তাঁরা বাঁচলে বাঁচবে, মরলে মরবে। তবুও রামকিঙ্করের মুখের দিক থেকে চোখ সরাতে পারছিলেন না শ্যামসুন্দর। বিশেষ করে ওই দুটি চোখে এক অন্য মায়া তিনি লক্ষ্য করেছিলেন।

–তোমার বাবা-মা কোথায় ?

আঙুল দিয়ে পাইপের মধ্যে দেখাল রামকিঙ্কর। শ্যাম দেখলেন এক পুরুষ ও মহিলা শুয়ে আছেন। দূর থেকে মনে হল নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছেন। একটু কাছে যেতে অসাড় হতে শুরু করল শ্যামসুন্দরের শরীর। তাঁদের উপর মাছি ভন-ভন করছে। শ্যাম বুঝতে পারল, বেশ কয়েকঘণ্টা আগেই মারা গিয়েছেন বছর পঁয়তিরিশের এই যুবক আর বছর তিরিশের ওই যুবতী। হয়তো কয়েক ঘণ্টা আগেও তাঁরাই ছিলেন এই অবহেলা মাখানো সুন্দর মুখের অভিভাবক। জীবনে অনেক মৃত্যু দেখেছেন শ্যামসুন্দর। অনেক অল্প বয়সে বাবা-মাকে হারিয়েছিলেন। তারপর খুব অল্প বয়সে দাদাকে হারিয়েছিলেন। পেশাগত কাজের জন্য অনেক দুর্ঘটনা কভার করেছেন। কিন্তু ভরদুপুরে রাস্তার ধারে এমন দুটি মানুষের মৃত্যু নাড়িয়ে দেয় তাঁর পেশাগত জীবনকে।

কী দোষ করেছিলেন তাঁরা? নিজেকেই প্রশ্ন করেন শ্যামসুন্দর। শুধু নিজেদের জীবনটুকুই তো বাঁচাতে গিয়েছিলেন। হয়তো স্বপ্ন দেখেছিলেন তাঁরা বাঁচলে, বাঁচবে এই চার বছরের ছেলেটাও। একদিন সবকিছু স্বাভাবিক হলে, তাঁদের জীবনও সেই সরণিতেই চলবে। রামজীবন আর সুধার দেহের দিকে একটু এগিয়ে গেলেন শ্যামসুন্দর। ক্ষুধা আর ক্লান্তিতে দু’জনেরর শরীর শুকিয়ে গিয়েছিল। নীল হতে শুরু করেছে দু’টি শরীর। কোমড়ের নীচ থেকে ফুলতে শুরু করছে। শ্যাম বুঝতে পারছেন প্রচন্ড গরমে মৃতদেহ দু’টিতে পচন ধরতে শুরু করেছে।

খানিকক্ষণের জন্য চোখ বুঝে আসতে শুরু করল শ্যামসুন্দরের। পা টলতে লাগল। মাথাটাও ঘুরতে লাগল। হঠাৎ একটা পচা গন্ধে তাঁর সম্বিৎ ফিরল। দেখলেন, মাটিতে বসে কিছু একটা মুখে দিচ্ছে চার বছরের ছেলেটা। তাঁর মুখে দিকে তাকিয়ে হাসছে। আর বলছে, ‘আমায় নিয়ে যাবে তোমার সঙ্গে। দেখ বাবা-মা আর হাঁটতে পারছে না। কিন্তু আমি পারব তোমার সঙ্গে হাঁটতে। আমায় নিয়ে যাবে তোমার সঙ্গে।’

–রামকিঙ্করের সামনে হাঁটুগেরে বসলেন শ্যামসুন্দর। ছোট্ট ছেলেটার মুখ থেকে সরিয়ে দিলেন পচা খাবারটা। কিন্তু রামকিঙ্করের প্রশ্নের কোনও উত্তর দিতে পারলেন না। এভাবে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন রামকিঙ্করের মুখের দিকে। ছেলেটার তাতে কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। সে নিজের মতোই ওই পচা খাবারই ঘেঁটে চলেছে। আর মাঝে মধ্যে পাইপের মধ্যে ঢুকে সুধাকে জাগানোর চেষ্টা করেছে। অনেকক্ষণ ডাকার পরেও সুধার কোনও সাড়া পায় না রামকিঙ্কর। শেষপর্যন্ত মাকে জড়িয়ে শুয়ে পড়ে সে।

আর বসে থাকতে পারেন না শ্যাম। হঠাৎ একটা শব্দ তাঁর কানে আসে। ‘স্যার চলিয়ে, হাম লোগো কো জানা হোগা।’

খাবার টেবলেই তনিমার দু’হাত ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লেন শ্যামসুন্দর। বাইরে তখন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। আর শ্যামের মনে ভিতরে উজান বয়ে যাচ্ছে। জীবনে অনেক বড় খবর ব্রেক করেছেন। তাঁর লেখায় সরকার টলছে। কিন্তু একটা চার বছরের ছেলের মুখ তাঁর সব কিছুকে ভাসিয়ে দিয়েছে। সবকিছু জেনে, সবকিছু দেখে একটা চার বছরের ছেলেকে রাস্তায় একা রেখে দিয়ে আসার অপরাধ তাঁকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। সাহস, নির্ভীক– এই শব্দ তাঁর অভিধান থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। ভেবেছিলেন একটা দুর্দান্ত অভিজ্ঞতার কথা লিখবেন। আর তাঁর পাঠক সেই লেখা পড়ে চমকে উঠবে। তারপর কোনও সান্ধ্য পার্টি বা মদ্যপানের আড্ডায় সেই লেখা নিয়ে চর্চা হবে। না সেই লেখা আর বেরল না শ্যামসুন্দরের কলম থেকে।

–আমাকে নিয়ে যাবে তোমার সঙ্গে...

বরং চোদ্দ দিন পরেও এই কথাটাই এখন কানে লেগে আছে শ্যামসুন্দরের। আর ভেসে ওঠে দু’টি মায়াবী চোখ। অবহেলা মাখানো মায়া রামকিঙ্করের মুখ।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন