ফাইটার



অনিন্দ্য সিংহ চৌধুরি

অঙ্কন : শান্তনু দে


সকাল থেকে পড়ার টেবিলে অনিকেত। কিন্তু বইয়ে মন নেই। ফিজিক্সের সূত্র মাথায় ঢুকছে না। এমনটা সাধারণত হয় না ওর। মন যে আসলে অন্য জায়গায়। মাথায় সারাক্ষণই ঘুরছে স্ট্র‌্যাটেজি। সামনে বোর্ড পরীক্ষা। তার সঙ্গে তো জয়েন্ট, নিট আছেই। সেন্ট জর্জের ফাস্র্টবয়টি যে এবার র‌্যাঙ্ক করছে, তা নিয়ে স্কুলের টিচাররা নিশ্চিত। কিন্তু বোর্ড পরীক্ষা এখন অনিকেতের মাথাতেই নেই। তার যে একটাই টার্গেট। যে করেই হোক তমোঘ্নদের স্কুল হলি হোমকে ফাইনালে হারাতে হবে। এটাই তো শেষ সুযোগ অনিকেতের কাছে। পরের বছর অনিকেতরা কলেজে। তাই তমোঘ্নদের হারানোর এটাই লাস্ট চান্স। প্রতে্যকবারই ইন্টার স্কুল ক্রিকেট টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন ট্রফিটা ঢ্যাংঢ্যাং করে নিয়ে যায় হলি হোম। আর সেই খবর শুনতে হয় অনিকেতদের। কেননা, কোনওবার ফাইনালে উঠার সুযোগই হয় না অনিকেতদের। এবার সেই স্বপ্নপূরণ করার হাতেগরম সুযোগ।

শুধুমাত্র টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হওয়া নয়, তমোঘ্নর সঙ্গে খেলার মাঠে আরও একটা হিসাব সুদে-আসলে চোকাতে হবে তাকে। বোর্ডের পরীক্ষার আগে নিজের জাত চেনাতে হবেই অনিকেত বন্দ্যোপাধ্যায়কে। না হলে, যে সে নিজের কাছে তো বটেই, আরও একজনের কাছেও হেরে যাবে।

কেমন করে তমোঘ্নদের বিরুদ্ধে খেলবে সে চিন্তা করতে করতেই বইয়ে পাতার কথা একদমই কপূরের মতো উবে গিয়েছে। কখন যে সকাল গড়িয়ে বেলা হতে চলল, তা খেয়াল করেনি সে। ঘোর ভাঙল মোবাইলের শব্দে। পড়ার টেবিলের পাশেই ঘাটে নিজের প্রিয় রিংটোনটা বাজছিল। স্ক্রিনে অদ্রিজার নাম দেখেই মুচকি হেসে উঠল অনিকেত। –কীরে পড়াশোনা করছিলি না কি ম্যাচের কথাই চরকি পাক খাচ্ছিল?

–জিও, তুই কি টেলিপ্যাথি জানিস না কি?

–ভাইটু, বয়স তো কম হল না। আর তোকে তো সেই ওয়ান থেকে ক্লাসে দেখছি, তোমার মতিগতি সম্পর্কে একটু হলেও জানি। তা ম্যাচ তো রবিবার। আর আজ শুক্রবার। মানে হাতে খালি শনিবারটা আছে। হঁ্যা রে, ম্যাচটা তো জেমস কলোনির মাঠে তো?

–হঁ্যা, কেন রে? তুই কি যাবি না কি?

–আমার কি খেতেদেয়ে কাজ নেই! যাই হোক, তোকে ‘বেস্ট অফ লাক’।

–থ্যাঙ্কস ডিয়ার।

অদ্রিজাকে আরও কিছু বলতে চাইছিল। কিন্তু বলার আগে মুঠোফোনকে কেটে গেল। গতকাল রাতের ফোনটার কথা অদ্রিজার সঙ্গে শেয়ার করতে চাইছিল অনিকেত। মনটা বড্ড ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। পড়ার টেবিলের পাশে রাখা ব্যাটটা তুলে নিয়েই শ্যাডো প্র‌্যাকটিস করতে শুরু করল। অনিকেতের পড়ার ঘরটা উপরে হওয়ায় শীতের হালকা হাওয়াটা ভাল পাচ্ছিল। মনটা এখন বেশ লাগছে। আর ঠিক সেই সময়ই ঘড়ির দিকে চোখ গেল। দেখেই বলে ওঠে, “এই রে, একটা বেজে গেছে। মা ডাকল বলে। বিকেলে তো অরিন্দম স্যরের বাড়ি যেতে হবে। টিম মিটিং।”

স্নান করে খেয়ে নিয়ে ঘণ্টাখানেক ঘুম দিল সে। তারপর চারটে নাগাদ সাইকেলে স্যরের বাড়ি। অনিকেতরা যে জায়গায় থাকে সেখানে শীতকালটা দারুণ। কলকাতা থেকে বেশ খানিকটা দূরে জায়গাটা। আধা-শহর বলাই যায়। শহুরে বিলাসিতার সব আয়োজন বেশ ভাল রয়েছে। একটাই স্বস্তির ব্যাপার, এখানে এখনও বহুতল সেভাবে থাবা বসাতে পারেনি। তাই শীতের আমেজটা ভাল এনজয় করা যায়। অনিকেতরা থাকে আবাসনে। অনিকেতের বাবা-মা দু’জনেই অধ্যাপক। অনেকে অনিকেতদের আবাসনটাকে প্রফেসর কোয়াটার্স বলেই ডাকে। সেখানে সবই দু’তলা বাড়ি। আর চারপাশে খালিই সবুজের আভা। প্রতে্যক শীতেই এখানকার স্থানীয় স্কুলগুলির মধে্য ক্রিকেট টুর্নামেন্ট হয়। যা নিয়ে হেব্বি টেনশন ও উত্তেজনা চলে স্কুলগুলির মধে্য। বলা ভাল প্রেস্টিজ ফাইট।

স্যরের বাড়িতে যেতে অনিকেত দেখল টিমের সকলেই চলে এসেছে। ক্যাপ্টেন অর্ক থেকে দলের নির্ভরযোগ্য স্পিনার শুভদীপ। অনিকেতকে দেখেই দলের কিপার অম্বরীশ চেঁচিয়ে উঠল, “এই তো আসল লোক এসে গিয়েছে। বস, এবার কিন্তু তমোঘ্নদের ট্রফি দেওয়া চলবে না। ওর খুব ঘ্যাম হয়েছে।” কী উত্তর দেবে, ঠিক বুঝতে পারল না অনিকেত, খালি একবার আস্তে করে বলল, “চেষ্টা করব, দেখা যাক। আচ্ছা স্যরকে তো দেখতে পাচ্ছি না?” অনিকেতকে চোখ মেরে ফাস্ট বোলার দীপ্তিময় বলে উঠল, “স্যরের ফোন এসেছে, চাপ নিস না, আসছেন।”

একটু পরে স্যর হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকে বললেন, “বয়েজ, প্রিন্সিপাল স্যর ফোন করে বললেন, হলি হোম না কি ম্যাচটা জিততে নানাভাবে ম্যানেজ করার চেষ্টা করছে। শোনা যাচ্ছে, অ্যাম্পায়রদের ব্ল্যাক চেক দিয়েছে।” স্যরের কথাটা শেষ হওয়ার আগেই অনিকেত কিছু একটা বলতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিল শেষ মূহূর্তে। সেটা চোখ এড়াল না অর্ক ও অম্বরীশের। দু’জনেই একসঙ্গে বলে উঠল, “কী রে, অনিকেত কিছু বলবি?” সঙ্গে সঙ্গে অনিকেত বলল, “না না, আমি তো কিছু বলব না। আমি তো স্যরের কথা শুনছি।”

ফের স্যর বললেন, “ওরা যাই করুক না কেন, আমাদের ফোকাস থেকে একটুও যেন নড়চড় না হয়! রিল্যাক্স থাকার চেষ্টা করবি। কাল সকালেই স্কুল গ্রাউন্ড প্র‌্যাকটিস। একটা কথা সকলের যেন মাথায় থাকে, ওদের টিমে সকলেই ভাল খেলে। তমোঘ্ন, বাপ্পাদিত্যের পাশাপাশি, তপোজিৎকেও দ্রুত প্যাভিলিয়নে পাঠাতে হবে। আর ওদের বোলিংয়ে কৌশিক ও অয়নের স্পিনটা দেখে খেলতে হবে। আর টসে জিতলে কিন্তু বোলিং নেওয়া হবে।”

স্যরের কথার মাঝে ক্যাপ্টেন হাত তুলে বলল, “স্যর, আমার একটা সাজেশন আছে।”়

–(হেসে) বল না, তুই ক্যাপ্টেন। তোর কথা না তো আমাকে শুনতেই হবে।

–স্যর, আমি চাই অনিকেত যদি লোয়ার অর্ডারে ব্যাট করুক। তাহলে আমাদের শেষ দিকে ব্যাটিংটা আরও সলিড হবে।

–খুবই ভাল হবে। গুড সাজেশন। হঁ্যা রে, অনিকেত তোর কোনও প্রবেলম নেই তো?

স্যরের কথা শুনলেও অনিকেত কেমন যেন আনমনা ছিল। সবাই তার দিকে চেয়ে আছে দেখে হঠাৎ সে বলে ওঠে, “হঁ্যা স্যর, বলুন?” অনিকেতের দিকে চেয়ে স্যর বলেন, “তোর কি হয়েছে বল তো? এনিথিং রং?” স্যরকে গতকালের ফোনের কথা কিছুতেই বলা চলবে না। হলি হোমের স্পোর্টস ট্রেনার অমল স্যর ফোনে তাকে ফাইনালে ভাল না খেলার প্রস্তাব দিয়েছেন, তা কখনও কাউকে বলতে চায় না অনিকেত। অমল স্যরের ওই ফোনের জবাব মাঠেই দিতে যায় সে। তাই কিছু হয়নি এমন ভাব করে অনিকেত বলল, “না স্যর, নো প্রবলেম।”

অনিকেতের উত্তরটা শুনে ক্যাপ্টন ও স্যর দু’জনেই বেজায় খুশ। এরপর বেশ কিছু সময় ধরে ম্যাচের প্ল্যানিং নিয়ে আলোচনা করলেন স্যর। মিটিং শেষ করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যায় সাতটা বাজল অনিকেতের। ঘরে ঢুকতেই বাবার ডাক। অনিকেতের বাবা সজলকান্তি বন্দে্যাপাধায় ইংরেজির অধ্যাপক। ভারী মজাদার মানুষ। ছেলের সমস্ত কাজেই দারুণভাবে উৎসাহ দেন। তিনি অনিকেতকে ঘরে ঢুকতে দেখেই জিজ্ঞেস করলেন, “কীরে তোদের ফাইনালের প্রিপারেশন কেমন?” গম্ভীর মুখে বাবার কথা উত্তর দিল অনিকেত, “মোটামুটি। ম্যাচের পরই সব বোঝা যাবে।” বাবার সঙ্গে আর কথা না বাড়িতে চটপট সে নিজের ঘরে চলে যায় সে। হাতমুখ ধুয়ে একটু খেয়েই ঠিক করে যে, ঘরেরই একটু স্যাডো প্র‌্যাকটিস করবে। আর এটাও ঠিক করে, এই ক’দিন সে খুব একটা পড়বে। শুধু শুধু পড়ে লাভ হবে না। তাই ম্যাচের টেনশন কেটে গেলে ভাল করে পড়তে বসবে। কিছুক্ষণ স্যাডো প্র‌্যাকটিস করে মোবাইলে ইউটিউবে প্রিয় ধোনি দ্য আনলোল্ড স্টোরি সিনেমাটা দেখতে থাকে। অনেকবার দেখেছে, তাও এ সিনেমা হাতে সময় পেলেই দেখে অনিকেত। এই সিনেমা দেখলে আলাদা একটা এনার্জি পায় সে। নিজেকে মোটিভেট করতে পারে সে। সিনেমা দেখতে দেখতেই নিজের মনে বলে উঠে সে, “ম্যাচে জিততে হবে। হারলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না।” নিজেকে চার্জড-আপ লাগছে। মনটা বেশ লাগছে।

এমন সময় ঘরে মায়ের প্রবেশ। “হঁ্যারে বসে বসে কি বিড়বিড় করছিস? শরীর ঠিক আছে তো?”

–(কিচ্ছু হয়নি এমন ভাব করে) একদম ঠিক আছি। পুরো বিন্দাস!

–ভাল থাকলেই ভাল। তোদের যে কখন কি মতিগতি হয়, কে জানে! যাই হোক কাল তো সকালে প্র‌্যাকটিস বললি, তা রাতে তাড়াতাড়ি খেয়ে নে তাহলে।

–আমি যাচ্ছি, তোমরা খেতে বসে যাও।

খেতে যাওয়ার আগে কিট ব্যাগ গুছিয়ে রাখল। ফোনে ভোর পঁাচটার অ্যার্লামও সেট করে রেখে খেতে গেল।

খাবার টেবিলে বাবার যে ম্যাচ নিয়ে এত কৌতুহল, তা দেখে চমকে গেল অনিকেত। “কীরে ম্যাচ নিয়ে টেনশনে আছিস না কি?” জবাব অনিকেত হিমশীতল ভঙ্গিতে বলল, “তা একটু আছে বটে। ফাইনাল ম্যাচ তো আগে খেলিনি।”

–আগে থেকে টেনশন করে লাভ নেই। তা তোদের বোলিং লাইনআপ কেমন?

–খুব একটা খারাপ নয়। স্পিনারও আছে ও ফাস্ট বোলারও আছে। এখন দেখা যাক!

–তোদের ফিল্ডিং কিন্তু ভাল করতে হবে। এই জায়গাতেই দু’দলের ফারাক হয়ে যায়।

–হু, স্যরও তো ফিল্ডিংয়ে জোর দিচ্ছেন।

বাবার সঙ্গে খেলা নিয়ে আলোচনা বেশ লাগছিল। খাওয়া শেষ করে নিজের ঘরে চলে গেল অনিকেত। ধ্যান করে ঘুমিয়ে পড়ল সে।

ভোরে ওঠেই কোনওমতে ফ্রেশ হয়েই প্র‌্যাকটিসে ছুট। অন্যদিনের থেকে আজকের প্র‌্যাকটিস একটু আলাদা। ব্যাটিং-বোলিং সব খুবই হালকা গতিতে হল। মাঝে মধে্যই কেউ কেউ গোল হয়ে মিটিং করছে। স্যরও আজ সকলকে নিজের মতো করেই প্র‌্যাকটিসের পারমিশন দিয়েছেন। তবে প্র‌্যাকটিস শেষেই যখন সকলে বাড়ি ফেরার তোড়জোড় করছে, ঠিক সেই সময় স্যরের ডাক। “বয়েজ, একটা ছোট্ট মিটিং করব আমরা। সকলেই কমনরুমে মিট করবে ঠিক দশমিনিটের মধে্য।” স্যরের গলার স্বর শুনে সকলেই একটু চমকে গেল। তাও সকলে সময়ের মধে্য কমনরুমে গেল। গিয়ে সকলে দেখল, স্যর একটি চেয়ারে বসে রয়েছেন। সামনে চারটে টেবিল। অনিকেত, অর্ক, অম্বরীশরা টেবিলেই বসল। অল্প সময়ের মধে্য স্যর বলে উঠলেন, “তোদের সঙ্গে এটা আমার লাস্ট ম্যাচ। তোদের অনেক বকেছি, মাঝে মধে্য বাজে কথাও বলেছি। সবটাই ভালর জন্য। তোদের কাছে আমার একটাই রিকোয়েস্ট, ম্যাচটা সহজে ছেড়ে দিবি না। শেষ বল পর্যন্ত লড়ে যাবি। কেমন।”

কথা শেষ করেই স্যর ঘর থেকে চলে গেলেন। কিন্তু অনিকেতরা শান্ত হয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকল। কমনরুমে অদ্ভূত রকমের একটা নিঃস্তব্ধতা। স্যরের স্পিচটা এখনও কারও হজম হচ্ছে না। এর মধে্য ক্যাপ্টন উঠে বলল, “কম অন বয়েজ। স্যরকে আমাদের ম্যাচটা জিতে সেরা ফেয়ারওয়েলটা দিতে হবে। কি আমরা স্যরকে এটা দিতে পারব না?”

সকলেই সমস্বরে বলে উঠল, “আলবাত ক্যাপ্টেন।” তারপর কমনরুমের মধে্য সকলে সকলের কঁাধে হাত রেখে গোল হয়ে শপথ নিল, “উই আর চ্যাম্পিয়ন। লেটস রক।”

কমনরুম থেকে বেরিয়ে যে যার মতো বাড়ি গেল। অনিকেত সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরে স্নান সেরে খাবার টেবিলে। ভীষণ খিদে পেয়েছে যে। ছেলের মুখ দেখেই মার বুঝতে এতটুকু সমস্যা হল না। ছেলের প্রিয় খাবার মাটন পাতে দিতেই অনিকেতের মুখ চকচক করে উঠল। তবে কাল ম্যাচ থাকায় অল্প করে খেল সে। তবে খাবার শেষে মাকে জড়িয়ে ধরে ছোট্ট করে একটা “থ্যাঙ্ক ইউ মাদার” বলে নিজের ঘরে চলে গেল সে।

ঘরে ঢুকেই টানা ঘুম। ম্যাচ নিয়ে আর কিছু ভাবতে চায় না এখন। কাল চিন্তা করবে। তার আগে নয়। তাই সন্ধ্যাতে বেশ খানিকটা সময় ছাদেই কাটিয়ে দিল। কানে হেডফোন লাগিয়ে প্রিয় অরিজিৎ সিংয়ের গান শুনল। টেনশন ফ্রি থাকার চেষ্টা করে চলে সে। ম্যাচ যে কাল আছে, তা যেন মাথাতেই নেই, এমন ভাব করতে থাকে সে। তাও একটা টেনশন যে চলছে, তা টের পায়। রাতে একটু আগেই খেয়ে নেয়। বারান্দায় একটু পায়চারি করার পর ব্যাগটা গুছিয়ে নেয়। ব্যাটটা বুকে জড়িয়ে মনে মনে বলে ওঠে, “বস কাল তুমি আমাকে বঁাচিও। তোমার সম্মান যেন রাখতে পারি।”

ঘুম থেকে খুব ভোরেই উঠল অনিকেত। ম্যাচ দুপুর বারোটায়। স্কুলের সামনেই সকলে মিট করবে দশটা নাগাদ। সেই মতো তৈরি হতে থাকল। ঘরেই হালকা ব্যায়াম করে নিল সে। রাতে ছোলা ভেজানোই ছিল। সেটাই মুখে পুড়ে ব্যাট নিয়ে স্যাডো প্র‌্যাকটিস। কেন জানিনা, অনিকেতের শরীরটা বেশ চনমনে লাগছিল। হালকা ব্রেকফাস্ট করে স্নান সেরে তৈরি হয়ে নিল। তৈরি হয়ে মাকে হঁাক দিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল স।

–মা মাঠে গেলাম গো।

–ভাল করে খেলিস কিন্তু। অল দ্য বেস্ট।

সাইকেল চালাতে চালাতে মায়ের এই শেষ কথাটা কানে বাজতে থাকল।

স্কুল থেকে সোজা মাঠে সকলেই। স্যর আগেই মাঠে পেঁৗছে গিয়েছেন। মাঠে তো এক্কেবারে বিশাল ব্যাপার। ফাইনাল ম্যাচ, অন্যদিন তেমন লোক না হলে এ ম্যাচে বেশ ভালই দর্শক হয়েছে। অনিকেতরা মাঠে গিয়ে অল্প দৌড় ও নকিং করে নিল। অনিকেতদের টিম লিস্ট আগেই ঠিক ছিল। অর্ক ও তমোঘ্ন টস করে গেল। টসে তমোঘ্ন জিতে ব্যাটিং নিল। ম্যাচের শুরু থেকে মারতে আরম্ভ করল তমোঘ্নরা। উইকেট পড়ার চান্স দেখতে না অর্ক সাত ওভারের মধে্য শুভদীপকে আনতে বাধ্য হল। কাজও হল। ওদের ওপেনার প্রবুদ্ধ ৩০ রান করে প্যাভিলিয়নের পথে। তমোঘ্ন কিন্তু একই গতিতে চালিয়ে গেল। কাউকে রেয়াত করছে না। শুভদীপকে তো এক ওভারে তিনটে বাউন্ডারি মেরে ১৮ রান নিল। অন্যদিক থেকে উইকেট পড়লেও তমোঘ্নকে তো ফেরানো যাচ্ছে না। ওদের বাপ্পাদিত্য এবং তনুময়ও ভাল সঙ্গ দিল তমোঘ্নর। ২৫ ওভার ম্যাচে তমোঘ্ন একা কুড়ি ওভার পর্যন্ত খেলল। শেষে রান আউট হল সে। তবে ততক্ষণে রান ভাল উঠে গিয়েছে হোলি হোমের বোর্ডে। ইনিংসের একেবারে শেষ ওভারে তো হোলি হোমের প্রীতম দু’টি ছক্কা হঁাকিয়ে দিল। ইনিংস শেষ হল ৮ উইকেটে ১৬০ রানে। তমোঘ্ন ৫৮ রান। এই রান চেস করে তোলা যে বেজায় কঠিন, তা ভাল বুঝতে পারছে অর্ক। তাই তো ফিল্ডিং শেষে মাঠ ছাড়ার আগে মাথা দোলাতে থাকে সে। প্যাভিলিয়নে বসেই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। বোলিং যে এতটা খারাপ হবে বুঝতে পারেনি। সকলেই টের পাচ্ছে, মির‌াক্যাল না হলে এই রান তোলা টোটালি অসম্ভব!

হঠাৎ স্যর এসে বললেন, ওরা যদি পারে তাহলেও তোমরাও পারবে।

স্যরের কথা যে প্লেয়ারদের খুব একটা প্রভাব ফেলল না, তার নমুনা ম্যাচ শুরু হতে বোঝা গেল। অম্বরীশ আর অর্ক বেশি রান না করে ফিরে এল। ইনিংসের প্রথমদিকে উইকেটে পেয়ে যাওয়ায় তমোঘ্নরা আরও ঝঁাপিয়ে পড়ল। রানের গতি কিছুটা বাড়ানোর চেষ্টা করল আকাশ আর ঈশান। তাও অল্প সময়। ১০ ওভারে স্কোরবোর্ড মাত্র ৬৫ রান। হার যে প্রায় নিশ্চিত, সেটা অর্করা বুঝতে পারছে। ইশান বোল্ড হতেই ব্যাট হাতে ক্রিজের দিকে এগিয়ে গেল অনিকেত। সঙ্গে রয়েছে আকাশ। অনিকেতের সঙ্গে তমোঘ্নর শুধু তো মাঠে নয়, বিশেষ শত্রুতা তো আছে। তাই অনিকেতকে দেখেই বল করার জন্যে ওয়ার্ম-আপ করতে শুরু করল। অনিকেত ডানহাতি ব্যাটসম্যান। স্ট্যান্স নিয়ে সে পুরো ফিল্ড পজিশন দেখে নিল। আর তা দেখতেই গ্যালারিতে চোখ আটকে গেল! মাঠে অদ্রিজা এসেছে! মুহূর্তের মধে্য চোখ ঘুরিয়ে বিপক্ষের সেরা বোলার আবীরের দিকে তাড়াল। প্রথম বলটা আউট সুইং। দেখে ছেড়ে দিল। মনে মনে ঠিক করে নিল, যে করেই হোক তাকে শেষপর্যন্ত টিকতেই হবে। আর প্রথম থেকেই মারতে হবে। না হলে, কোনও চান্স থাকবেই না। রিস্ক নিতেই হবে। রানরেট যে করেই হোক বাড়াতে হবে। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। আবীরের আর দু’টো বল বাকি। এর মধে্য প্রথমটাতেই স্কোয়ার কাটে চার মারল। দ্বিতীয়টাও চেষ্টা করেছিল। কিন্তু হল না। মাত্র দু’রানেই সন্তুষ্ট থাকতে হল অনিকেত। এর পরেই বোলিং করতে এল তমোঘ্ন। মিডিয়াম পেস বোলার তমোঘ্ন বোলিং শুরুর আগেই অনিকেতকে একেবারে মেরে ফেলবে, এই ভঙ্গিতে দেখে নিল। আর সতি্য সেটাই করার চেষ্টা করল। তমোঘ্নর একটা বাউন্সার মাথায় গিয়ে লাগল অনিকেতের। বল এতটাই জোরে ছিল যে হেলমেট মাটিতে পড়ে গেল। বলটা লাগায় কিছুক্ষণ একেবারে ব্ল্যাকআউট হয়ে যায় অনিকেত। হলি হোমের প্লেয়াররা চলে এল অনিকেতের কাছে। মাথা ঘুরতে থাকে। একটু থিতু হতে অনিকেত দেখল তমোঘ্নের চোখে-মুখে বিজয়ীর হাসি। সবকিছু সামলে ফের অনিকেত স্ট্যান্স নিতেই অর্করা বলে ওঠে, “জিও বস, দেখি দে তুই চ্যাম্পিয়ন।”

প্যাভিলিয়নের এই উৎসাহটা কাজ দিল বটে। জোশ পেল অনিকেত। তমোঘ্নকে মেরে পাট পাট করে দিল সে। চার ছ’য়ের বন্যা। স্কোরবোর্ড দ্রুত পাল্টাতে থাকল।

কিন্তু ফের ছন্দপতন। আকাশ বোল্ড। নেমেই প্রতীকও শূন্য রানে লোপ্পা ক্যাচ দিল। ম্যাচটা আবারও নিজেদের দিকে নিতে শুরু করল হলি হোম। ওভারও কমে আসছে। স্কোরবোর্ড জানান দিল, সাত ওভারে ৫৫ রান বাকি। হাতে পঁাচ উইকেট। কিন্তু ব্যাট করতে পারে একমাত্র শুভদীপ। বাকিদের নিয়ে খুব একটা আশা নেই। তাই যা করার এই জুটিতে করতে হবে। ফের তমোঘ্ন। মাথা ঠাণ্ডা রেখে সেই ওভারে ১২ রান করল এরপর শুভদীপ যা করল, তা আন্দাজ করেনি অনিকেত। রান তো দূর, হলি হোমের লেগ স্পিনার স্নেহাশুর ওভারে মাত্র দু’রান করল শুভদীপ। এত িকছু দেখেও মাথা ঠাণ্ডা রাখল অনিকেত। কিন্তু এমনটা যে হবে, তা কেউ কল্পনা করেনি। আবীরের শেষ ওভারে ম্যাচের রং ঘুরিয়ে দিল অনিকেত। ওই এক ওভারে তিনটে ছক্কা। সঙ্গে থাকল একটা দুর্দান্ত স্ট্রেট ড্রাইভে চার। অনিকেতের আত্মবিশ্বাস ফের ফিরল।

কিন্তু এখনও তো নিশ্চিত হওয়ার মতো কিছু নেই! ম্যাচ হোলি হোমের দিকেই।

অনিকেতের ভাবনা ভুল ছিল না। হঠাৎ প্রতীকের প্রথম বলেই শুভদীপ বোল্ড। দূর থেকে অনিকেত দেখতে পেল, স্যরের হতাশ মুখটা। তখনই ঠিক করে নিল, তাকেই এবার শেষ করতে হবে। তাতে যা হওয়ার হবে! সপ্তর্ষি ক্রিজে আসতে দৌড়ে অনিকেত গিয়ে বলল, “প্লিজ বল নষ্ট করিস না। একটা রান নিয়ে স্ট্রাইক দে।” সপ্তর্ষি কথাও রাখল সে।

ব্যাট করার চান্স পেল অনিকেত। তা দেখেই তমোঘ্ন ফিল্ডিং পজিশন চেঞ্চ করে দিল। সকলেই বুঝতে পারল, অনিকেতের উইকেটটা পেলেই ম্যাচটা পকেটে। তারজন্য জাস্ট একটা বল।

কিন্তু সেই বলটা আর করতে পারল না হলি হোমের বোলাররা। প্রতীক আর পার্থের ওভারে একেবারে ‘দে ঘুমাকে’ স্টাইলে চার ও ছয়ের ধামাকা লাগিয়ে দিল অনিকেত।

পার্থের যে বলটায় অনিকেত ম্যাচ উইনিং ছয়টা মারল, তমোঘ্নের মুখটা সতি্য দেখার মতো। মনে হল, পরীক্ষায় অঙ্কে একশো পাওয়ার জায়গায় ফেল! বলটা উড়ে বাউন্ডারির বাইরে পড়তেই অনিকেতের মুষ্টিবদ্ধ হাত। “ইয়েস, উই আর চ্যাম্পিয়ন,” বলে উঠল কোকড়ানো চুলের ছেলেটি। প্যাভিলিয়নে আনন্দ-উল্লাস। অনিকেতকে নিয়ে তখন সেলিব্রেশন চলছে। অনিকেত দেখতে পেল, মাঠের ধারে দঁাড়িয়ে অদ্রিজা হাততালি দিয়ে চলেছে। চোখে-মুখে তার সাফল্যের হাসি। স্যর সকলকে জড়িয়ে ধরলেন। অনিকেত স্যরের কাছে যেতেই জড়িয়ে ধরলেন অনিকেত। বললেন, “জিও বেটা, তুই তো আসল ফাইটার। যে শেষ পর্যন্ত লড়াই করতে জানে। হারবে জেনেও মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে আসে না। ওয়েল ডান।”

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন