সময় পাল্টাচ্ছে, পাল্টাচ্ছি আমিও : সিদ্ধার্থ সিংহ

 বইতন্ত্র–র মুখোমুখি কবি ও কথাসাহিত্যিক সিদ্ধার্থ সিংহ


বইতন্ত্র :
এই করোনার সময় তো মাঝের ক’টা মাস বাদে প্রায় দেড় বছর সবাই ঘরবন্দি। তবে বই পড়া ও লেখার জন্য অনেক সুযোগ পাওয়া গেল। আপনি কী লিখলেন?

সিদ্ধার্থ সিংহ : আমাকে তো এমনিতে নরওয়ের একমাত্র বাংলা পত্রিকা 'সাময়িকী', বাংলাদেশের 'স্টোরি অ্যান্ড আর্টিকেল' অস্ট্রেলিয়ার সিডনি থেকে প্রকাশিত 'প্রভাত ফেরী', উত্তরবঙ্গের নিউজ পিডিয়া এবং কলকাতার বেঙ্গল ওয়াচ-এ প্রত্যেক দিন একটি করে দৈনিক কলাম লিখতে হয়। এ ছাড়া প্রচুর গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, নাটক এবং বিভিন্ন পত্রপত্রিকার জন্য প্রচ্ছদকাহিনি লিখেছি। তবে অণুগল্প লিখে সব থেকে বেশি আনন্দ পেয়েছি।

বইতন্ত্র : এ বছর আপনার লেখার কত বছর পূর্ণ হল?

সিদ্ধার্থ সিংহ : আমি যখন ক্লাস নাইনে পড়ি তখন আমার প্রথম লেখা ছাপা হয় দেশ পত্রিকায়। পরের সপ্তাহেই একটি গদ্য ছাপা হয়েছিল আনন্দবাজার পত্রিকায়। ওটা ধরলে আমার লেখালেখির বয়স এখন প্রায় বিয়াল্লিশ বছর।

বইতন্ত্র : আপনি তো প্রচুর বই লিখেছেন। সংখ্যাটা এখন কত?

সিদ্ধার্থ সিংহ : আমার ছড়া, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, শিশুতোষ, এবং যেহেতু আমি ১৬টি ভাষা বলতে পারি এবং লিখতে পারি, সে জন্য কিছু কিছু অনুবাদও করি, সেই অনুবাদ এবং বিষয়ভিত্তিক বই মিলিয়ে আপাতত আমার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা দুশো পঞ্চান্নটি। এ ছাড়া একক এবং লীলা মজুমদার, রমাপদ চৌধুরী, শংকর, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, মহাশ্বেতা দেবী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সুচিত্রা ভট্টাচার্য, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, নবনীতা দেব সেন, রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে সম্পাদনা করেছি কম করেও পাঁচশোর ওপর সংকলন।

বইতন্ত্র : আপনার লেখাগুলি কী বিষয়ের উপর? সমাজের কোন দিকটা আপনার লেখক সত্তাকে নাড়া দেয়?

সিদ্ধার্থ সিংহ : সে ভাবে আলাদা করে কোনও বিষয় নেই। আমি সমস্ত রকম বিষয় নিয়েই লিখি। সমাজের যে সব ঘটনা হৃদয়বিদারক, সেটা যত তুচ্ছই হোক না কেন, সেটা শুধু লেখক সত্তাকে নয়, আমাকেও নাড়া দিয়ে যায়।

বইতন্ত্র : বই ছাড়াও আপনি বিভিন্ন পত্র–পত্রিকায় হরহামেশাই লিখে থাকেন। এখন তো বিভিন্ন ওয়েব ম্যাগাজিনেও আপনি নিয়মিত কলাম লিখছেন। এর পর আবার সম্পাদনার কাজ রয়েছে। দিনে ক’ঘণ্টা এইভাবে লেখালেখি বা সম্পাদনার কাজে থাকেন?

সিদ্ধার্থ সিংহ : আমি দিনে ৮ ঘণ্টার বেশি সাধারণত লিখি না। কারণ লেখা ছাড়াও আমার আরও অন্যান্য অনেক কাজ আছে। ফিল্মের স্ক্রিপ্ট লেখা আছে। গান লেখা আছে। বিভিন্ন ছায়াছবিতে মিউজিক কম্পোজ করা আছে। ছবি আঁকা আছে। এ ছাড়াও আছে বক্সিংয়ের প্রতি আমার অমোঘ টান।

আর সম্পাদনা বলতে তো আমেরিকার উড়ালপুল, কলকাতার বেঙ্গল ওয়াচ-এর সাপ্তাহিক 'সাহিত্যের পাতা'। আর প্রকাশকদের ফরমাস মতো ৩০ থেকে ৫০ ফর্মার এক একটি সংকলন সম্পাদনা, এই তো... এতে খুব একটা বেশি সময় লাগে না।

সম্প্রতি এসেছি বিশ্ববঙ্গ টিভির ইউটিউব চ্যানেলের রবিবারের 'ভিডিও সাহিত্যে'র সম্পাদনা এবং পরিচালনায়।

সঙ্গে আছে, যে সব সেলিব্রিটিদের আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি এবং খুব নিবিড় ভাবে মিশেছি, সেই সব লোকদের সম্পর্কে প্রতি শুক্রবার বলছি 'কত অজানারে' অনুষ্ঠানে।

প্রথম দিনই বলেছি লেখকদের লেখক সম্পাদকদের সম্পাদক রমাপদ চৌধুরীকে নিয়ে। সামনের সপ্তাহেও হয়তো তাঁকে নিয়েই বলব। তার পর একে একে আসবেন কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, লেখিকা সুচিত্রা ভট্টাচার্য, নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য...

বইতন্ত্র : ক্লান্ত বা একঘেয়ে লাগে না কখনও?

সিদ্ধার্থ সিংহ : একদমই না। বরং হাতে কাজ না থাকলে আমি হাঁফিয়ে উঠি। আসলে ২৪ ঘণ্টায় এক ঘণ্টা ঘুমোই তো, রাত ১টা থেকে ২টো। ফলে আমার হাতে প্রচুর সময়।

বইতন্ত্র : এই যে আপনি এক দীর্ঘ সময় ধরে লিখে চলেছেন, এর মধ্যে সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলা ও সারা দেশেই অনেক পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। পাঠকও বদলেছে। পাঠকের মন বদলেছে। আপনি এর সঙ্গে নিজেকে কতটা বদলেছেন।

সিদ্ধার্থ সিংহ : আমি তো সময়ের সঙ্গেই আছি। সময় যেমন পাল্টাচ্ছে, সামাজিক এবং রাজনৈতিক অবস্থান যেমন পাল্টাচ্ছে, আমিও তো তার সঙ্গে একই রকম ভাবে পাল্টাচ্ছি। পাঠক যেমন পাল্টাচ্ছে লেখক হিসেবে আমিও তো পাল্টাচ্ছি। এবং সেটা আমাকে চেষ্টা করে পাল্টাতে হচ্ছে না, অটোমেটিকালি পাল্টে যাচ্ছি।

বইতন্ত্র : আপনার বহু লেখা বিদেশ থেকে প্রকাশিত পত্রপত্রিকা, সাইটেও প্রকাশিত হয়। এই যোগাযোগটা আপনার কীভাবে হয়? তরুণ লেখকরা জানতে চাইছে।

সিদ্ধার্থ সিংহ : যাঁরা পত্র-পত্রিকা করেন, সেটা মুদ্রিত পত্রিকাই হোক কিংবা ওয়েবজিন, তাঁরা সব খোঁজখবর রাখেন, কে লিখছেন, কী লিখছেন। ফলে তাঁরা তাঁদের পত্রিকাটিকে সমৃদ্ধ করার জন্যই নিজে থেকেই উপযাচক হয়ে ঠিক যোগাযোগ করে নেন। আজ মোবাইল নাম্বার কিংবা ইমেইল আইডি পেতে তো কোনও অসুবিধা নেই। এখনকার বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েরা, যাঁরা পত্রপত্রিকার সঙ্গে যুক্ত, তাঁরা এ সব ব্যাপারে ভীষণ চোস্ত। তাঁরা জানেন, গুগুলে নাম দিয়ে সার্চ করলেই গড় গড় করে বেরিয়ে আসবে সমস্ত কিছু।

বইতন্ত্র : আপনি বিদেশ ক’বার গিয়েছেন, এই সাহিত্যকর্মের জন্য?

সিদ্ধার্থ সিংহ : সব মিলিয়ে কত হবে! ওই কুড়ি-বাইশ বার।

বইতন্ত্র : এখন তো সোশ্যাল মিডিয়ার আশীর্বাদে লেখক–পাঠক যোগাযোগ সহজ হয়ে গিয়েছে। আপনি পাঠকদের কাছ থেকে কেমন প্রতিক্রিয়া পান?

সিদ্ধার্থ সিংহ : এখানে একটা কথা বলে রাখি, প্রিন্ট মিডিয়ার পাঠক আর ওয়েব মিডিয়ার পাঠক কিন্তু এক নয়। প্রিন্ট মিডিয়ার পাঠক সহজে মুখ খোলে না। খুললেও অনেক ভেবেচিন্তে বলে। আর ওয়েব মিডিয়ার পাঠক হল, পড়ল কী পড়ল না, দুম করে একটা মন্তব্য করে দিল। তাও একটা কি দুটি শব্দে। যেমন--- 'দারুণ', 'অসামান্য', 'ভাবা যায় না', 'ফাটাফাটি', 'দুর্দান্ত', 'চমকে দিলে'। যে মন্তব্যগুলো শুনতে ভাল লাগে ঠিকই, কিন্তু এর কোনও মানে হয় না।

তা বলে কি সব সময়ই এই রকম মন্তব্য পাই? না, তা নয়। অনেকেই আছেন যাঁরা ফোন করে বা মেসেঞ্জারে কিংবা হোয়াটসঅ্যাপে তাঁদের ভাললাগার কথা জানান। আমার কাছে সেটাই অনেক। কারণ আমি বিশ্বাস করি, আমি আজ যা লিখলাম, সেটা আদৌ কোনও লেখা হয়েছে কি না, সেটা বিচার হবে আজ থেকে কুড়ি, পঁচিশ, ত্রিশ, চল্লিশ বছর পরে। ফলে এই সব মন্তব্যগুলো ভাল লাগলেও আমি এগুলোকে খুব একটা গুরুত্ব দিই না।

বইতন্ত্র : এত লেখার জন্য আপনাকে তো প্রচুর পড়তেও হয়। লেখার জন্য সময় ব্যয়ের পরে এই পড়ার সময়টা কখন বের করেন?

সিদ্ধার্থ সিংহ : যা পড়ার সব ছোটবেলায় হয়ে গেছে। আর কে কী ধরনের লেখা লেখেন এবং তিনি কী ধরনের লেখা লিখতে পারেন, সেটা আমি খুব ভাল করে জানি। আসলে প্রায় ৩০ বছর ধরে সর্বাধিক বিক্রিত একটি সংবাদপত্রে থাকার জন্য এবং সেই পত্রিকার রবিবারের সাহিত্য পাতার সম্পাদক, লেখকদের লেখক এবং সম্পাদকদের সম্পাদক, বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরীর সহযোগী হিসেবে থাকার দৌলতে এটা আমার রপ্ত হয়ে গেছে।

যেটুকু পড়তে হয় সেটা হল প্রবন্ধ লেখার জন্য। তথ্যের জন্য। কখনও-সখনও উপন্যাস লিখতে গিয়েও বিভিন্ন সূত্রের সন্ধান করতে হয়। যেমন আমি যখন একটানা প্রায় তিন বছর ধরে পৃথিবীর সমস্ত শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং জমি কেলেঙ্কারির উপর ভিত্তি করে 'নামগোত্রহীন' উপন্যাসটি লিখছিলাম, সে সময় আমাকে হন্যে হয়ে ঘুরতে হয়েছে ন্যাশনাল লাইব্রেরি থেকে আনন্দবাজারের লাইব্রেরি। যেতে হয়েছে বিভিন্ন পুরনো পত্রপত্রিকার অফিসে। ঘাঁটতে হয়েছে প্রচুর নথিপত্র। মুখোমুখি হতে হয়েছে তাবড় তাবড় বিদগ্ধ মানুষজনের। কারা কারা আমাকে সাহায্য করেছেন, শুধু তাঁদের তালিকা প্রকাশ করার জন্যই ওই বইটির প্রথম তিন পাতা আমাকে খরচ করতে হয়েছিল।

ফলে যে সব বই থেকে আমি লেখাটাকে পরিপূর্ণ করার জন্য রসদ পেতে পারি, সেই সব বইগুলিই আমি হাতের কাছে রাখি। কবিতা, গল্প বা উপন্যাস একদম নয়।

বইতন্ত্র : তরুণ লেখকদের প্রতি আপনার কি কোনও পরামর্শ রয়েছে?

সিদ্ধার্থ সিংহ : একটাই পরামর্শ--- ভাল-মন্দ পরে বিচার হবে। আগে লেখো। প্রথমত লেখো। দ্বিতীয়ত লেখো এবং তৃতীয়তও লেখো। যখন লিখবে না, তখনও লেখার ঘোরের মধ্যেই থাকো।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন