শান্তনু গুহ
বাংলা সাহিত্যে রহস্য, রোমাঞ্চ এবং অতিপ্রাকৃত বিষয়ের গুরুত্ব চিরকালই ছিল। কিন্তু গত শতকের শেষ দিক থেকে বর্তমান শতকের প্রথম দশক পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যে গোয়েন্দা, অ্যাডভেঞ্চার প্রভৃতি নিয়ে আগ্রহ থাকলেও অতিপ্রাকৃত বিষয় নিয়ে লেখালেখির ক্ষেত্রে কোথাও যেন একটা ভাটার টান দেখা গিয়েছিল। তবে গত কয়েক বছর ধরে এই বিষয়টি নিয়ে ফের নাড়াচাড়া চলছে। এর পেছনে তরুণ কিছু সাহিত্যিকের আগ্রহ যে কাজ করছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর সেই তরুণ সাহিত্যিকদেরই একজন হলেন উপমন্যু রায়।
যদিও উপমন্যু সব ধরনেরই গল্প বা উপন্যাস লিখে থাকেন। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নানা সময়ে সে সব প্রকাশিতও হয়। সেইসব লেখার মধ্যে অতিপ্রাকৃত বিষয় একটি বিশেষ জায়গা দখল করে থাকে। সে সব লেখা পড়লে স্পষ্ট বোঝা যায়, ভৌতিক বা অতিপ্রাকৃত বিষয়ের ওপর তাঁর বিশেষ আন্তরিকতা রয়েছে। এই বিষয়ে এখনও পর্যন্ত তাঁর লেখা তিনটি বই প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম বই ‘অশরীরী আতঙ্ক/ পৃথিবীর রহস্যময় ঠিকানা’ প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালে। প্রকাশ করেছিল পারুল প্রকাশনী। পৃথিবীর ভৌতিক স্থানগুলির পেছনে থাকা গল্প নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে বইটিতে। ২০২০ সালে প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় বই ‘গভীর রাতের আতঙ্ক’। প্রকাশক মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স। পাঁচটি অতিপ্রাকৃত উপন্যাসের সঙ্কলন এই বই। আর এ বছর প্রকাশিত হয়েছে ‘প্রেত রহস্য/ মোটেও কল্পকাহিনি নয়’। এই বইটিও প্রকাশ করেছে পারুল প্রকাশনী।
আলোচ্য ‘প্রেত রহস্য/ মোটেও কল্পকাহিনি নয়’ প্রকৃত পক্ষে ‘অশরীরী আতঙ্ক/ পৃথিবীর রহস্যময় ঠিকানা’ বইটির দ্বিতীয় পর্ব বলা যায়। যদিও সে বিষয়ে বইতে কোনও উল্লেখ নেই। আগের বইটিতে যেমন গোটা পৃথিবীরই বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন বাড়ি, প্রাসাদ বা জায়গা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, এই বইতে কিন্তু ভৌতিক ঘটনাগুলিই বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। এ কথা ঠিক, এই বইটিতেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নানা রহস্যময় ঘটনার কথা বলা হয়েছে। তবে, বাংলা এবং বাঙালি প্রাধান্য পেয়েছে। যেমন পাশ্চাত্যের ভূত ভাবনার পাশাপাশি বাঙালির প্রেত চর্চার ইতিহাস, ভূত দিবস প্রভৃতি। আর অবধারিত ভাবেই পাঠকের মন কেড়ে নেবে রবীন্দ্রনাথের অশরীরী চর্চা, ঠাকুর বাড়ির রহস্য, ঠাকুর পরিবারের সদস্যদের ভৌতিক অভিজ্ঞতা, প্যারীচাঁদ মিত্র থেকে সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রীঅরবিন্দ, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, অমৃতবাজার পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা শিশিরকুমার ঘোষ এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের প্রেত চর্চা ও নানা অভিজ্ঞতার কথা বলা হয়েছে।
তবে আমার মনে হয়, বইটির উল্লেখযোগ্য দিক হল উপমন্যুরই লেখা ভূমিকা এবং উপসংহারটি। ভূমিকাটির শিরোনাম ‘আমার বিশ্বাস আমার অবিশ্বাস’ এবং উপসংহারটির শিরোনাম ‘তা হলে কী বোঝা গেল’। এই দুটি অধ্যায়ে লেখকের ব্যক্তিগত ধারণা এবং অভিজ্ঞতা বইটিকে অন্য মাত্রা দিয়েছে। আর শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের প্রাক্কথন বইটিকে সমৃদ্ধ করেছে। ভূত যে বাস্তবিকই আছে, সেখানে শীর্ষেন্দু নানা উদাহরণ দিয়ে বলেছেন। রঞ্জন দত্তর প্রচ্ছদটিও বেশ আকর্ষণীয়। সব মিলিয়ে অতিপ্রাকৃত বিষয়ের ওপর লেখা এই বই রহস্যপ্রিয় পাঠককে মুগ্ধ করবে বলেই আমার বিশ্বাস।
প্রেত রহস্য/ মোটেও কল্পকাহিনি নয়
উপমন্যু রায়
পারুল প্রকাশনী।
মূল্য ২৫০ টাকা।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন