দৃশ্য থেকে দৃশ্যের ভিতর সূক্ষ্ম ঐশ্বর্য

আবদুস শুকুর খান

কবি তাজিমুর রহমানের চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ "দ্বিতীয়ার চাঁদ ও স্বস্তিকচিহ্ন" প্রকাশ পেয়েছে সিগনেট প্রেস তথা আনন্দ পাবলিশার্স থেকে। বন্ধুবৎসল তাজিমুর যথাসময়ে বইটি পাঠের জন্য আমাকে দিয়েছিলেন। আমার ব্যক্তিগত সমস্যার জন্য গ্রন্থটি পড়া হয়ে ওঠেনি। তারপর হঠাৎ একদিন কবির এই বইটি নিয়ে পাঠ করি, আশ্চর্য হই।আর মুগ্ধ হয়ে প্রথম পাতা থেকে শেষ পাতা পর্যন্ত কাব্যগ্রন্থটি একটানা পড়ে ফেলি। আরও আশ্চর্য এই যে, বোধহয় এই প্রথম কোন কাব্যগ্রন্থ মুগ্ধ হয়ে প্রথম পাতা থেকে শেষ পাতা পর্যন্ত পড়ার জন্য আমাকে বসিয়ে রাখল।এই গ্রন্থ পাঠ করতে গিয়ে আমি কবির অন্তর্জগৎ থেকে বহির্জগৎ সবটা প্রায় পাঠ করে নিই। চার ফর্মার বইটির একটিও কবিতা আমার পড়া থেকে বাদ যায়নি। বলতে পারেন,বাদ দিতে পারিনি মুগ্ধতার জন্য।

কবির মেধা, তার উন্মেষ, শব্দ চয়ন, আন্তরিক অভিনিবেশের গন্ধ পেয়ে আমি গ্রন্থটির প্রতিটি পৃষ্ঠা পাঠ করে উঠি। এক অন্তর্জগতের অরূপ মাধুর্য যা কবির মেধা,শব্দ, কাব্যশৈলী, বাক্য বন্ধনীর সমানুপাতিক চিত্রে ভাস্বর। আমাকে বেশ কয়েক ঘন্টা বসিয়েও রাখল। প্রীত হলাম, তাঁর প্রগাঢ় ও কাব্যশৈলীর গঠনমূলক শৃঙ্খলায়।


কবির আত্মমগ্নতা দৃশ্য থেকে দৃশ্যের ভিতর সূক্ষ্ম ঐশ্বর্যকে উদাস বাউলের মত কুড়িয়ে নিয়েছেন কবিতার বীজ। বেঁধেছেন শব্দ বন্ধনে; না, বেশি বড় কবিতা হয়ে ওঠেনি।অত্যন্ত সংযমে বেঁধেছেন কবিতার চিত্রপট। প্রতিটি কবিতার ভিতর খুঁজেছেন হৃদয়ের অনুপম ধ্বনি।সংযমে, কবিতার সারস্বতে অত্যন্ত বিনম্র স্বরে বলে চলেছেন---

"আবরণ সরিয়ে রাখি গৃহস্থ নাইবা হলাম। কাকড়ির ধান ফেলা বয়ে গেছে, এসো এই

ভরা শ্রাবণে সেরে নিই ভ্রমণের অন্তিম পাঠ

#

উদাস জানালা আঁচল পেতে আছে,কখন দু ফোঁটা

বৃষ্টির ছাট এসে ভিজিয়ে দেবে চেনা অক্ষরসকল"

( অপেক্ষা )


কাব্য গ্রন্থের প্রথম কবিতা 'অপেক্ষা'। কবি তাজিমুর রহমান বেশ চঞ্চল হয়ে উঠেছেন। তাঁর চিত্তচাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে। ভেজা বাতাসে বেড়ে গেছে অস্থিরতা,খন্ড অন্ধকার, ঝিঁ ঝিঁ ডাকা সময়ে তাঁর আত্মযোগ ছিন্ন হচ্ছে। তিনি নিমগ্ন হয়ে ডাক দিয়েছেন---" চলো যাই অন্য কোথাও"। সমস্ত আবরণ সরিয়ে কবি ডাক দিয়েছেন--- 'কাকড়ির ধান ফেলা বয়ে গেছে, এসো এই/ ভরা শ্রাবণে সেরে নিই অন্তিম পাঠ।'

অস্থির সময়ে কবি ছটফট করছেন এই সাম্প্র মুহূর্তে উদাস জানালা পেরিয়ে সেই চেনা মুহূর্তগুলো জমে আছে, তাকে ধারণ করতে হবে কবিতায়।


কবিতা লেখার আগে কবির মনোযোগকে নিবিড়ভাবে ধরার এক ঘন পরিবেশ;কবি রপ্ত করেছেন---তাই হয়তো বৃষ্টি পতনের থেকে চেনা অক্ষরসমূহ হারাতে চান না। জীবনবোধের আশ্চর্য চৈতন্যকে নিবিড় করে পেতে কবি যেন নিজস্বতার কাছে পৌঁছতে চাইছেন---কাকড়ির ধানের ফোটার অপেক্ষাতে। কবির অন্বেষণ এবং অভিজ্ঞার প্রতিরূপ হয়ে উঠেছে কবিতাটি। সার্থক শিল্পীর মত তাঁর শিল্পায়ন, কবিতার যাত্রাপথ।


কবি এখানে দক্ষ শিল্পীর চোখে কবিতাবলয়কে পর্যবেক্ষণ করেছেন। তাঁর চোখের দর্পণে ফুটে উঠেছে গ্রাম বাংলার শিল্পায়ন।স্মৃতিমেদুর পথরেখা। তিনি যেন দক্ষ শিল্পীর মতো তাঁর শিল্পায়ন চোখের ভিতরে প্রবেশ করিয়েছেন--- গ্রাম বাংলার এক নিরাবরণ শরীর। কবি, শিল্পীর চোখে নিরীক্ষণ করেছেন প্রকৃতির রূপ, রস, বিলাস। তাঁর চেতনায় প্রলম্বিত হচ্ছে প্রকৃতির নির্যাস। তিনি কবিতায় বাজিয়ে চলেছেন শব্দের নিক্কন। শব্দও বেজে উঠেছে তাঁর মানবিক নন্দনে।---


"আতস কাচের নিচে পূর্ণিমার চাঁদও লাজুক প্রেমী/ তবুও স্বপ্ন হামাগুড়ি দিয়ে যায়, চারণভূমি ঘিরে/ যে আঁধার ক্ষণিক ঋজু হয়ে ওঠে তার জন্য/ সাজিয়ে রাখি হৃদিমন্ত্র, মৃদুলয়ে/ তোমার আঁখিতে তার প্রতিরূপ উদ্ধত ফণার মতো" (বৃষ্টি এলে)


পৃথিবীর যেখানে শান্ত, সম্মোহিত পরিবেশ তার মধ্যে নিমগ্ন হয়ে কবি গেয়ে চলেছেন জীবনের ভৈরবী গান। হৃদয়ের অভিমুখকে নাচিয়েছেন প্রকৃতির উন্মাদনায়। কবি বিভ্রান্ত নন, শান্তশিষ্ট পরিবেশের মধ্যে অপেক্ষা করেছেন; হৃদযন্ত্রে সীমাহীন বেদকে পাওয়ার জন্য, অনায়াসে তুলে নেন হৃদয় তূরপুনে। কবি নয়, যেন কোন শিল্পী জীবনের মেদুর কথোপকথনে বাজাতে চেয়েছেন হৃদয় ভৈরবী। লক্ষ্যনীয়, এই কবিতায় তিনি খুব বেশি দাঁড়ি, কমা ব্যবহার করেননি। এমনকি পূর্ণচ্ছেদও।যেন অনন্ত প্রবাহ থেকে মুঠো ভর্তি করে তুলে এনেছেন কয়েক টুকরো ভালোবাসা, প্রকৃতিজাত সম্পদ। কবি তাঁর অভিপ্সাকে আত্মস্থ করে আনেন--- "বৃষ্টি এলেই শালুক পাতার মতো ছড়িয়ে পড়ে/ আমাদের স্মৃতিমেদুর কথোপকথন/ আর দিগন্তজুড়ে ধ্বনিত হয় অরণ্যগান"।


বৃষ্টি পতনের মূর্ছনা, কবি তাঁর আশান্বিত কল্পনাকে প্রলম্বিত করেন এবং স্মৃতিমেদুর কথোপকথনকে জারণ প্রক্রিয়ায় তুলে আনেন। দেখেন--- আশ্চর্য অরণ্যগান। তাঁর মগ্নচৈতন্যের মধ্যে আরোহন করেন; প্রকৃতিজাত অনেক দৃশ্যাবলী, যা প্রায়ই ঘটে এবং চিরন্তন সত্য হয়ে ওঠে।এই দেখা কবির সহজাত প্রবৃত্তি। কতটা নিবিড় হলে( মানুষ নয়) কবি তাঁর হৃদিমন্থিত কাব্যের মধ্যে বাজাতে পারেন এই প্রকৃতি ভৈরবী। কবির নিমজ্জিত শব্দের মধ্যে আমরাও বেজে ওঠি। বেজে যাই।---


"ভেসে রয়েছি মাস্তুলের মতো, চাঁদ ক্রমে গিলে খাচ্ছে/ ছায়াঘন মেরু পথ।/নদীর জলে পড়া সাংসারিক অক্ষরমালায়/ ওত পেতে রয়েছে বিপন্ন বিষাদ/ পাথরের খাদানে অতন্দ্র যে জীবন সেখানে/ কুয়াশা নামক বালিকার দল রাসায়নিক হয়ে উঠেছে।"( গ্রামীণসন্ধ্যা)।


কবির দৃষ্টিপথ বিশাল, ব্যপ্ত। কাব্যিক হৃদয় গ্রামীণ সন্ধ্যাকালীন পরিবেশে বনজ্যোৎস্নার চিদাভাসে আপ্লুত। পাথরের খাদানে রণক্লান্ত যে জীবন; তারাও 'কুয়াশা নামক বালিকার দল রাসায়নিক হয়ে উঠেছে'

কবি, উদাসীন বাউলের মত বিষণ্ণ। কিছু কিছু সময় কবি আবার উদভ্রান্ত, উদাসীন। তাঁর দেখা সত্যগুলি প্রকট ও প্রচ্ছন্নরূপে কবিকে আরোপিত করে।কবি জোনাকির মতো মেলে ধরেন তাঁর দেহ। প্রান্তিক বলয়ের ঘোর প্লাবনে দেখতে পান--- জ্যোৎস্না উঠছে চরাচরে।


বনজ্যোৎস্নায় স্নিগ্ধ কবি আন্তরিক পরিবেশে কাব্যময় হয়ে ওঠেন। কবির দেখা অতি সাধারন বিষয়ও অসাধারণ হয়ে ওঠে। পাঠক, আমরাও নন্দিত হই। কবির মনোভূমিতে আশ্লেষে জড়িয়ে থাকি।--- "পাতা ঝরে পড়ে আনমনা একাকি বালক/ অপলক চেয়ে থাকে সেই ঝড়ে পড়ার গান শুনবে বলে/ মেঘলা আকাশ, দূরে গাভীদের ফিরে যাওয়া/ বিকেলগুলো আজ স্পষ্ট দাঁড়িয়ে আছে/ অসংখ্য বৃষ্টি আড়ি পেতে তরজমা করে হেমন্তের"

সময় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দৃশ্যের বদল হয়। পরিবর্তিত দৃশ্যাবলির মধ্যে পরিবেশও বদলে যায়। কবির চোখে ধরা পড়ে এই পরিবর্তন। কবি উপলব্ধি করেন, অসংখ্য বৃষ্টি,হেমন্ত আগমনের তরজমা করছে, অনায়াসে।কবির উপলব্ধি ও মনোজগতে হারায় না কোনকিছুই। তিনি লক্ষ্য করেন,---

" মাতলার জলে একদল মেছেনি জাল পেতে/ খুঁটে তোলে মাছের পোনা। হঠাৎ নেমে আসা/লাল সূর্যের আলোয় ডিঙি নৌকোগুলো/ বড় বেশি মায়াবী হয়ে ওঠে/বালির আঙিনায় ছড়িয়ে পড়ে গাঢ় জ্যোৎস্না"।


কবি ছিলেন উন্মুখ দর্শক। তাঁর বোধে,প্রতিক্রিয়ায় ধরা পড়ে যায় গাঢ় জ্যোৎস্নার ঝরে পড়া। ডিঙি নৌকোগুলো যেন মুহূর্তে মায়াবী হয়ে উঠছে। কবির এই মৌনজাত অভিরূপে পাঠকের উপমিত চোখে তৃষ্ণা বড় হয়ে ওঠে। আশ্চর্য মায়াবী খেলায়---

"ছায়াময় সন্ধ্যার বুক চিরে হিমেল বাতাস গোটা গোটা অক্ষরে লিখে ফেলে/ তারাদের বর্ণমালা" (বর্ণমালা)।


কবির সদাজাগ্রত চোখে এই ছবি চিরসত্য। প্রকৃতি রূপায়নে দৃশ্যত বাস্তবকে লিখে চলেন অনায়াসে,---

"কতটা রাস্তা হাঁটলে পরে সম্পর্কসেতু/ হাওড়া ব্রীজ হয়ে ওঠে কিংবা বাউলের হাতে/ চাঁদ এসে হামাগুড়ি দেয়/ বলে দাও নীলাঞ্জনা। কূটতর্কে নাই বা গেলাম/ পাথর জানে জলপ্রপাতের স্নিগ্ধ প্রবঞ্চনা"( ছায়া)।


'পাথর জানে জলপ্রপাতের স্নিগ্ধ প্রবঞ্চনা'।--- আমাদের অস্থির জীবনযাপনের প্রতিচ্ছবি। কবি নির্বিকারভাবে লক্ষ্য করেন--- কিভাবে সরে যাচ্ছে আমাদের চিরপরিচিত সত্যগুলি। ক্রমাগত ক্ষয়িষ্ণু সমাজ, বিশ্বপ্রকৃতি। কবি এদের মধ্যে থেকে তুলে আনেন জীবনের অমৃত বোধগুলি। আশ্চর্যভাবে যাপন করেন সেই সত্যের গভীরতা। ধীরে ধীরে তাঁর সমাপতন হয়। কবি দেখেন এ যেন সত্য নয়, কোন কাল্পনিক এক জগতের কিসসা।---


"লক্ষ্যভেদ হলো না বলে জলছবির গায়ে জড়ানো/ নীল চাদর অমাবস্যার ছোপগুলো/ কারুময় এক নির্মাণশৈলী; হসন্তরোগে/

যে বেদনাগুলো ক্রমে ছড়িয়ে পড়ে/ তার ভিতর কৃষিভিত্তিক সভ্যতা/ প্রকৃত তাপ পেলে জায়মান হলেও হতে পারে/ কৃষ্ণগহবর থেকে সুমেরু আদল। শুধু…"।(ঐ)


কবির অনুভব নির্মাণশৈলী কতখানি প্রাঞ্জল। তাঁর বোধ কীভাবে পাঠককে অসীমের দিকে টানে। এই দৃশ্যমান আবহের মধ্যে থেকে কবি অস্পষ্টভাবে লক্ষ্য করেন--- জীবনের ব্যপ্ত সমস্যাগুলো। কবি তাজিমুর তাঁর শিল্পিত কবিতাগুলো তুলে এনেছেন এইভাবে, যেন কোন বিশাল ক্যানভাসের মধ্য থেকে জীবনবোধের সত্যকথনগুলি। আমরা নিমজ্জিত হয়ে যাই এই সুন্দর চিত্রিত চিন্তনে।


অনেক শব্দসমষ্টি কবিতাগুলোর গুণগত মান বাড়িয়ে দিয়েছে। কবি নিজস্ব প্রকৃতিকে তন্ন তন্ন করে খুঁজেছেন, জীবনের সামান্য রসদ, যা চিরন্তন সত্যকে উস্কে দেয়, তা ধরেছেন নিবিড় ভাবে, প্রতিটি কবিতায় আছে সেই ভাস্বর।---


"অন্ধ বাউলের ডাকে জ্যোৎস্নার রং ফিকে হয়ে/ আসে, তবু বরষায় চিয়ে নেয় সকল গোধূলিরাগ/ শুধু মর্মপীড়া ছড়িয়ে পড়লে বেহুলার হাতে/ তুলে দেব বিষের পাত্র/ পাতায় পাতায় সেই প্রতিরূপ চিহ্নিত করে/ দৃশ্যমান হয় দৃষ্টির মায়াপ্রপাত

(সংবাদ)।


তাজিমুরের এই উদ্দাত বলার বোধ তৈরি হয়েছে অনায়াসে। ভিতরের যন্ত্রণা কিংবা ক্ষোভ; যা বলবে বলে প্রতিনিয়ত হুঙ্কার দেয়, তা এককথায় কিংবা একটি শব্দের ব্যবহারে, কবিতাকে গড়ে তোলেন--- সকল বলার চেয়ে বেশি পাঠক, কষ্ট করে কবিতার ভেতর থেকে তুলে আনা অনুষঙ্গগুলিকে পাঠ করে নেবেন। কবির শিল্পিত ঝংকার কবিতাকে করে তোলে কখনো জেদি বিক্ষেপনের অহংকার।


কবির অনুভবের কয়েকটা উদাহরণ যা কবিতার অঙ্গনে ব্যবহার করে জীবনের নিবিড় আকর্ষণকে অধ্যয়ন করেছেন---

( ক) তার পাশে তুমি দাঁড়ালে সব শূন্যতা/ চতুর্দশী কিশোরীর মতো/ মেঘমুক্ত আকাশ (শূন্যতা)


(খ) ...বৃক্ষের নম্র আবেশে কেবল চিনিয়ে দিতে পারে/ উঠোনের মায়াবী সংকেত, ছায়া ও চারুময় হয়ে ওঠে/ প্রস্থে কিংবা দৈর্ঘ্যে তাকে জরিপ করতে গেলেই/ ভাঙনের গূঢ়মন্ত্রে বিপন্ন হয়ে ওঠে শিকড়ের মাটি

#

আসন্ন প্রসবা নারী তখন ব্যথা ভুলে খুঁজে ফেরে/ দ্বিতীয়ার চাঁদের মতো ক্ষয়ে ওঠা উঠোনের স্বস্তিকচিহ্ন (দ্বিতীয়ার চাঁদ)

(গ)

আমাদের মাঝে কতকগুলো রাত্রি আছে

জ্যোৎস্না আছে

মাঝখানে স্থির দাঁড়িয়ে একাকি মোমবাতি


একাকি ভ্রমণে গেলে জঙ্গলে প্রতিটি নৈঃশব্দ্যতা বুকে করে নিতে হয়। কবি জানেন--- এইসবই তাঁর হৃদয়ের কাব্যিক চেতনা। কবি আচ্ছন্ন, তিনি একা, অনন্ত পথিকের বেশে সকল নৈঃশব্দ্যতা পাঠ করে নিতে চান; খুঁজতে থাকেন। যেভাবে ভ্রমণ হলো না, সেই বাস্তবিক চিত্রগুলোর অবদান।


তাজিমুর রহমান,খুব নিঃশব্দে কবিতার ভিতরে তাঁর জীবনের ভাব,ব্যক্তিগত সমীক্ষা,চেনা জানা অন্তরায়গুলো কবিতার উপযোগী করে তুলেছেন। তাঁর সামনে এলিয়ে পড়েছে দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তর, নৈসর্গিক আবহ। কবি কবিতার অন্বেষণে প্রতিটি দেখা অনুরাগে, শব্দের প্রয়াসে আত্মস্থ করেছেন। সমাজে তাঁর দেখা, যা আমাদের চারপাশে অহরহ ঘটে যায়, বর্ষাভেজা বিকেলের মত একাকি, মূর্ত সময়ের মধ্য থেকে অনায়াসে কবিতা ধারণ করেছেন। কবিতাকে তুলে এনেছেন। আমরা মথিত হই। তার কল্পনার অভিষেকে মূর্ত হয়ে ওঠে।

"সদ্য কুমারীত্ব খুইয়ে কলকাতা কন্যা অচিরেই/ ছাড়পত্র পেয়ে গেল অ্যাসাইলামের/ বর্ষাভেজা বিকেল গোঙানির শব্দে/ বলে ওঠে... নবান্ন কতদূর মা…(বর্ষাভেজা বিকেল)


প্রিয় পাঠক বইটি খুব ধাতস্থ করে পাঠ করে নেবেন। কবি খুব বিনীত স্বরে, অত্যন্ত কাব্যিক কুশলতায় কবিতার ভিতরে ভিজিয়ে দিয়েছেন, নিজের ক্রান্তিকাল, চাওয়া পাওয়া, অসহনীয় কর্মকাণ্ডের মধ্যে নিজ দাম্ভিকে কবিতা রচনা করেছেন। তা অপূর্ব এবং দেহাতীত, আমাকে ভাবায়।

"একলা মাঠের মতো পড়ে রয়েছে চৈতন্য/ বাউলের একতারায় কোন বেদমন্ত্র/ আছে কিনা জানা নেই/ শুধু চাতকের ইশারার মতো/ ওত পেতে রয়েছে/ কুয়াশা ও মেঘের হিংস্রতা…


চেতনা জারিত হলে শব্দের রসায়নে হৃদয় জেগে ওঠে। কথা বলার সমূহ আবেগ কবিতা হয়ে যায়। কবির চারপাশে যা ছিল ভালোভাবেই থেকে যায়। কবি আত্মবিস্তৃতি অতল থেকে তুলে আনেন কবিতার শরীর। তাঁর চেতনায় আমরাও নামিয়ে আনি, নত মস্তকে পাঠ করে যাই ----তাঁর প্রজ্ঞার, বোধের অনুলিখন।


'সিগনেট প্রেস'-এর(আনন্দ পাবলিশার্স) ব্যবস্থাপনায় প্রকাশিত হয়েছে। কবির চৈতন্য প্রসূত আক্ষরিক কামনা ও সাধনাকে সাধুবাদ জানাই।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন