বিকেলের মৃত্যু


x
x








উপমন্যু রায় 

— ‘‘নমস্কার আমার নাম মধুজা দত্ত’’

মাথা নীচু করে লিখছিল রমন কথাটা শুনে চমকে উঠল সে মুখ তুলে দেখল, ছিপছিপে একটা মেয়ে তার টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে গায়ের রং মোটামুটি পরিষ্কার ভুরুচোখ বেশ টানাটানা চেহারায় একটা চটক আছে

কিন্তু এমন একটি মেয়ে তার কাছে কেন? মধুজার মুখের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় সে জানতে চাইল, ‘‘কী ব্যাপার?’’

মধুজা বলল, ‘‘আসলে আমি একটা কাজে আপনার কাছে এসেছি’’

কাজে! একটু অবাক হল রমন ভাবল, তার কাছে আবার কী কাজ আছে এই মেয়েটির? মেয়েটিকে তো সে চেনে না! কখনও দেখেছে বলেও মনে করতে পারল না অবশ্য মেয়েটি প্রথমেই সৌজন্য দেখিয়েনমস্কারবলেছে তার পর নিজের নামও জানিয়েছে তার মানে মেয়েটির নিশ্চয়ই কোনও দরকার আছে তার কাছে!

রমন জিজ্ঞাসা করল, ‘‘কী কাজ?’’

মধুজা কী যেন ভাবল একটু তার পর বলল, ‘‘আসলে রানাঘাট কৃষ্ণনগরে আপনাদের ঘি ডিস্ট্রিবিউশনের অর্ডারটা পাওয়ার জন্য আমি একটা অ্যাপ্লিকেশন পাঠিয়েছিলাম কিন্তু কোনও জবাব পাইনি অ্যাপ্লিকেশনটা পেয়েছেন কিনা, বা সেটার অবস্থা এখন কী রকম, তা যদি বলে দেন, খুব ভালো হয়’’

পাঁচটা বেজে গিয়েছে অফিস ফাঁকা করে সকলেই চলে গিয়েছে রমনও বের হবহব করছিল শুধু একটা ফাইল দেখা বাকি ছিল তাই কাজটা তাড়াতাড়ি শেষ করে উঠে পড়বে ভাবছিল ঠিক সেই সময়ই মেয়েটি এসে পড়ায় একটু বিরক্তই হল সে

পাঁচটায় রিসেপশনিস্ট মেয়েটি চলে গিয়েছে নিশ্চয়ই ফোর্থ ক্লাস স্টাফ ছেলেটিও সেখানে নেই! তাই হয়তো মেয়েটি অফিসে ঢুকে সোজা তার কাছে চলে আসতে পেরেছে

বিবাদি বাগে টেলিফোন ভবনের কাছে একটি বড় বেসরকারি সংস্থায় কাজ করে রমন রমন বসুমল্লিক অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার সকাল নটা থেকে পাঁচটা, আট ঘণ্টা ডিউটি আওয়ার মাঝে অবশ্য একটা থেকে দুটো পর্যন্ত একঘণ্টা ব্রেক টাইম ওই সময় অফিসের সকলেই টিফিন খায়

রমন একটু চিন্তায় পড়ল অফিসের ঘি ডিস্ট্রিবিউশনের অর্ডারটার জন্য প্রচুর অ্যাপ্লিকেশন এসেছে তার কোম্পানির প্রধান প্রোডাক্টই হল ঘি গোটা রাজ্যেই তাদের ঘি বিক্রি হয় তবে কিছু জায়গায় এখনও তারা পৌঁছতে পারেনি এর মধ্যে রানাঘাট কৃষ্ণনগর অন্যতম এই দুই জায়গায় অন্য কয়েকটা কোম্পানির ঘি বিক্রি হয় এখন রানাঘাট কৃষ্ণনগরে নিজেদের ঘি মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চায় তারা তাই একজন ডিস্ট্রিবিউটর দরকার

ডিস্ট্রিবিউটর হতে চেয়ে ওই দুই জায়গা থেকে প্রচুর সংস্থা অ্যাপ্লিকেশন পাঠিয়েছে সেগুলির মধ্য থেকে এই মেয়েটির অ্যাপ্লিকেশন খুঁজে পেতে বেশ সময় লেগে যাবে! ব্যাপারটা বিরক্তিকরই মনে হল তার তাই সে বলল, ‘‘এখন তো অফিস বন্ধ হয়ে গিয়েছে তা ছাড়া বহু অ্যাপ্লিকেশন এসেছে এখন সেগুলি থেকে আপনারটা খুঁজে বের করা সম্ভব নয়’’

মেয়েটি বিনীত ভাবে বলল, ‘‘প্লিজ, একটু দেখুন অনেক দূর থেকে এসেছি আমি রানাঘাটে থাকি আমার পক্ষে ভাবে বারবার আসা একটু কঠিন আজ অনেক আগেই এসে পড়তাম কিন্তু ট্রেনটা এত লেট করল যে আমার এখানে আসতে পাঁচটা বেজে গেল!’’

কী যেন ভাবল রমন তার পর জানতে চাইল, ‘‘কবে নাগাদ অ্যাপ্লাই করেছিলেন?’’

মধুজা বলল, ‘‘দুমাস হয়ে গিয়েছে’’

একটু ভেবে হাত তুলে মধুজাকে তার ঘরের বাইরে বাঁদিকে ওয়েটিং রুমটা দেখিয়ে দিয়ে রমন বলল, ‘‘আপনি ওই ঘরে গিয়ে বসুন দেখি কী করা যায়!’’

ওয়েটিং রুমের দরজাটা রমনের ঘর থেকে পরিষ্কার দেখা যায় কোনও কথা না বলে মধুজা তার ঘরের বাইরে ওয়েটিং রুমে চলে গেল

রমন উঠে আলমারি খুলে ফাইল ঘাঁটতে শুরু করল মিনিট দশেকের মধ্যে নির্দিষ্ট ফাইলটা পেয়েও গেল সেখান থেকে মধুজার অ্যাপ্লিকেশনটা বের করল একটু দেখল অ্যাপ্লিকেশনের সঙ্গে তাদের পুরনো কিছু কাজের ব্যাখ্যাও দিয়েছে কী কী কাজ তারা সাফল্যের সঙ্গে করেছে এবং এখনও করছে, সে সব পরিষ্কার লিখেছে সেগুলি পড়ে ভালোই লাগল রমনের

অন্য সময় হলে অফিসের বেয়ারাকে বলত মেয়েটিকে ডেকে দিতে কিন্তু একজন ফোর্থ ক্লাস স্টাফ ছাড়া সকলেই বাড়ি চলে গিয়েছে আর যে আছে, তার রিসেপশনে বসে থাকার কথা মনে হয় সে এই মুহূর্তে রিসেপশনে নেই তাই রমন নিজেই উঠে ওয়েটিং রুমের দিকে এগিয়ে গেল

ওয়েটিং রুমে ঢুকে ভুরু কুঁচকে গেল তার কেউ নেই সেখানে! মেয়েটি গেল কোথায়? অবাক হল রমন ভাবল, তার নির্দেশ ঠিক বুঝতে না পেরে মেয়েটি রিসেপশনে চলে যায়নি তো? তাই সে রিসেপশনের দিকে এগিয়ে গেলনা, সেখানেও কেউ নেই কপাল কুঁচকে গেল তার মধুজা কি তা হলে চলে গিয়েছে? তা কী করে হয়? নিজের দরকারে সে এসেছে দরকার না মিটিয়েই চলে যাবে!

অদ্ভুত মেয়ে তো! বিরক্ত হয়ে রিসেপশন থেকে ফিরে এলো রমন তার জন্য বেকার সময় নষ্ট হল! ভাবতে ভাবতে ফের ওয়েটিং রুমের সামনে আসতেই চমকে উঠল মেয়েটি তো রুমেই বসে রয়েছে! তা হলে কোথায় গিয়েছিল সে? সে কথাই স্পষ্ট জানতে চাইল, ‘‘কোথায় গিয়েছিলেন আপনি?’’

তার প্রশ্ন শুনে মধুজা যেন একটু অবাক হল বলল, ‘‘আমি?’’

— ‘‘হ্যাঁ, আপনি ছাড়া এখানে আর কে আছে?’’

মধুজা হেসে বলল, ‘‘আমি তো কোথাও যাইনি! এখানেই বসে রয়েছি’’

বলে কী মেয়েটা! তা হলে কি সে ভুল দেখল?‌ কে জানে, হবে হয়তো! ভাবল রমন বলল, ‘‘আপনার অ্যাপ্লিকেশনটা পেয়েছি ঠিকই আছে নেক্সট উইকেই কল পেয়ে যাবেন’’

মধুজা মাথা নেড়ে বলল, ‘‘অসংখ্য ধন্যবাদ আপনি আমার অনেক উপকার করলেন’’

রমন উত্তর দিল না

মধুজা হেসে বলল, ‘‘আসি তা হলে?’’

রমন মাথা নাড়ল

মধুজা চলে গেল

অফিস থেকে রমনের বের হতে ছটা বেজে গেল অফিসের গাড়িতে রওনা হল গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের কাছে এসে তার গাড়ির গতি শ্লথ হয়ে গেল

রমনের বাড়ি শ্যামবাজারে এই রাস্তা দিয়েই প্রতিদিন বাড়ি ফেরে গাড়ির কাচ নামানো ছিল রাস্তার বাঁদিকে পথচারী, দোকানপাট দেখছিল সে

বাসস্টপের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখল, কয়েকজন মাত্র বাস ধরার জন্য দাঁড়িয়ে রয়েছে সেখানে যারা দাঁড়িয়ে রয়েছে, তাদের মধ্যে কয়েকটি মেয়েও রয়েছে একটি মেয়ের দিকে চোখ আটকে গেল তারমধুজা!

মধুজাও রমনকে দেখতে পেয়েছে সে হেসে ফেলল

ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলল রমন জানালা দিয়ে মুখ কিছুটা বের করে প্রশ্ন করল, ‘‘এখনও বাস পাননি?’’

মধুজা হাসিমুখে জবাব দিল, ‘‘না’’ একটু থেমে ফের বলল, ‘‘দেখুন না, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে! এখনও যদি বাস না পাই, তা হলে ছটা চল্লিশের রানাঘাট লোকালটা মিস হয়ে যাবে!’’‌

একটু ভেবে রমন বলল, ‘‘রানাঘাট লোকাল তার মানে আপনি শিয়ালদা যাবেন, তাই তো?’’

ঘাড় নেড়ে মধুজা বলল, ‘‘হ্যাঁ’’

রমন বলল, ‘‘উঠে আসুন আমি শ্যামবাজারে থাকি আপনাকে শিয়ালদায় নামিয়ে দেব’’ কিন্তু এমন কথা সামান্য পরিচিত একটা মেয়েকে কেন যে বলল, তা সে নিজেই বুঝতে পারল না

মধুজা আপত্তি করল বলল, ‘‘নানা, বাস ঠিক এসে যাবে’’

রমন বলল, ‘‘বাস তো আসবেই কিন্তু আপনার ছটা চল্লিশের রানাঘাট লোকালটা সেজন্য অপেক্ষা করবে না উঠে আসুন’’

মধুজা তবু ইতস্তত করছিল

রমন একটু জোর দিয়ে বলল, ‘‘উঠে আসুন’’

দরজা খুলে দিয়ে রমন নিজে আরও ডানদিকে সরে বসল একটু অস্বস্তি নিয়ে যেন মধুজা গাড়িতে উঠে বসল

ব্যাপারটা চোখ এড়াল না রমনের বলল, ‘‘এত অস্বস্তি কেন? আরে বাবা, আমি খুব খারাপ মানুষ নই আপনার ভয়ের কিছু নেই’’

মধুজা একটু যেন লজ্জা পেল রমনের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিল জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল

রাজভবনের কাছ থেকে বাঁদিকে গাড়ি টার্ন নিল ড্রাইভারকে রমন বলল, ‘‘শিয়ালদা দিয়ে চলো’’

মধুজা বলল, ‘‘আপনি শিয়ালদা দিয়ে যান না?’’

রমন বলল, ‘‘এখান থেকে বাঁদিকে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ দিয়ে যেতাম আসলে শ্যামবাজারে তো অনেক দিক দিয়েই যাওয়া যায় আজ আপনাকে শিয়ালদায় নামিয়ে এপিসি রোড দিয়ে সোজা বেরিয়ে যাব’’

মধুজা আর কোনও প্রশ্ন করল না

তবে রমন বলল, ‘‘আপনি ব্যবসা করেন জেনে ভালো লাগছে’’

মধুজা প্রশ্ন করল, ‘‘কেন?’’

রমন বলল, ‘‘যেখানে বাঙালি ছেলেরাই ব্যবসার দিকে যেতে চায় না, মানে ভয় পায়, সেখানে একটা মেয়ে নিজেই ব্যবসা করছে, এটা সত্যিই তারিফ করার মতো ব্যাপার’’

মধুজা কোনও জবাব দিল না

রমন বলল, ‘‘আপনার কোম্পানির নামও তো দেখলাম মধুজা’’

হাসিমুখে মধুজা বলল, ‘‘আসলে ব্যবসাটা আমার বাবার আমার জন্মের পর ব্যবসাটা শুরু করেছিলেন তখনই আমার নামে নিজের সংস্থারও নাম দিয়েছিলেন এখন বাবা অবসর নিয়েছেন তা ছাড়া বয়সের কারণে তিনি কিছুটা অসুস্থও তাই আমাকেই ব্যবসার হাল ধরতে হয়েছে’’ একটু থেমে ফের সে বলল, ‘‘যদিও ব্যবসার হাল তেমন ভালো নয় দুজন কাজ করে তাই আমি নতুন কিছু অর্ডার ধরে ব্যবসার পজিশনটা ভালো করতে চাইছি আপনাদের কাছেও তাই অ্যাপ্লাই করেছি’’

রমন জানতে চাইল, ‘‘আপনার বাড়িতে কে কে আছেন? যদি আপত্তি থাকে বলতে হবে না’’

মধুজা হাসল বলল, ‘‘নানা, আপত্তি থাকবে কেন? বাড়িতে বাবা, মা আর আমি আমার কোনও ভাইবোন নেই’’

রমন আর কোনও প্রশ্ন করল না ডানদিকের দরজা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল মিনিট কুড়ির মধ্যে শিয়ালদা পৌঁছে গেল তারা

বিদ্যাপতি সেতু পার হতেই গাড়ি সাইড করল ড্রাইভার গাড়ি থেকে নেমে মধুজা বলল, ‘‘আপনাকে অনেক ধন্যবাদ’’

রমন হাসিমুখে বলল, ‘‘ঠিক আছে আমাদের অফিস থেকে ঠিক সময়ে আপনার কাছে কল চলে যাবে’’

— ‘‘আমি অপেক্ষায় থাকব’’ মধুজা হাসিমুখে বলল, ‘‘আসছি’’

রমন মাথা নাড়তেই মধুজা হাঁটতে শুরু করল রমন ড্রাইভারকে গাড়িতে স্টার্ট দিতে বলে ফের তাকাল রাস্তার দিকে চমকে উঠল সেকোথায় মধুজা? এত দ্রুত সেখান থেকে হারিয়ে গেল কোথায়? কী করে? ব্যাপারটা বুঝতে পারল না ততক্ষণে গাড়ি চলতে শুরু করেছে

‌‌দুদিন পরই মধুজাকে ফোন করল রমন বলল, ‘‘আপনার অ্যাপ্লিকেশনটা অ্যাপ্রুভ হয়েছে আপনাকে একদিন আমাদের অফিসে আসতে হবে’’

মধুজা জানতে চাইল, ‘‘কবে আসতে হবে?’’

রমন বলল, ‘‘কালই চলে আসুন’’

মধুজা বলল, ‘‘ঠিক আছে’’

পরের দিন শনিবার একটায় অফিস বন্ধ হয়ে যাবে দুপুর সাড়ে বারোটা নাগাদ চলে এলো মধুজা রিসেপশন থেকে ইন্টারকমে ফোন গেল রমনের কাছে রমন যেন তার জন্যই অপেক্ষা করছিল তাকে পাঠিয়ে দিতে বলল রিসেপশনিস্টকে

মধুজাকে কি রমন একটু বেশিই গুরুত্ব দিয়ে ফেলছে? না হলে সেদিন কেন তাকে শিয়ালদায় পৌঁছে দিল? কেনই বা ঘি ডিস্ট্রিবিউশনের অর্ডারটা তাকে দিতে বেশি উদ্যোগ নিল ভাবল সে কিন্তু উত্তর খুঁজে পেল না হঠাৎ তার মনে হল, সে কি মধুজার প্রতি একটু দুর্বল হয়ে পড়েছে?

মধুজা হাসিমুখে তার ঘরে এলো

রমনও হাসিমুখে বলল, ‘‘বসুন’’ তার পর মধুজার হাতে সমস্ত কাগজপত্র তুলে দিল কয়েকটা কাগজে সই করিয়ে নিল মধুজাকে দিয়ে সমস্ত অফিসিয়াল কাজকর্ম শেষ হতে আধঘণ্টা লাগল

মধুজা হাসিমুখে বলল, ‘‘আপনি আমার অনেক উপকার করলেন’’

রমন বলল, ‘‘না, উপকার নয় আপনার সংস্থার রেকর্ডও দেখলাম মন্দ নয় তাই আপনাকে অর্ডারটা দিয়ে মনে হয় আমি ভুল করিনি’’

মধুজা হাসল কোনও কথা বলল না

রমন বলল, ‘‘আজ তো শনিবার একটায় ছুটি আপনি যদি একটু অপেক্ষা করতে পারেন, তা হলে আপনাকে শিয়ালদায় ছেড়ে দিতে পারি’’

মধুজা কোনও আপত্তি করল না সে অফিস থেকে নীচে নেমে রাস্তায় এসে দাঁড়াল মিনিট কুড়ির মধ্যেই অফিসের গাড়িতে বের হল রমন রাস্তা থেকে মধুজাকে গাড়িতে তুলে নিল

রাজভবনের কাছে এসে সিগন্যালে দাঁড়াল গাড়ি সামনের রাস্তার দিকে ইঙ্গিত করে মধুজা হাসিমুখে বলল, ‘‘রেড রোড, আকাশবাণীর রাস্তাঘাট আমার খুব ভালো লাগে মনে হয় যেন চুপচাপ হাঁটি’’

রমন তাকাল মধুজার দিকে মধুজার চোখ চিকচিক করছে রমন বলল, ‘‘যাবেন নাকি?’’

মধুজা প্রশ্ন করল, ‘‘কোথায়?’’

— ‘‘একটু ঘুরি’’

মধুজা কোনও জবাব দিল না

— ‘‘আপনার কোনও ভয় নেই আমি কাপুরুষ নই আপনার সম্মানহানি হবে না’’

মধুজা হাসিমুখে ঘাড় নাড়ল

রমন ড্রাইভারকে বলল, ‘‘আকাশবাণীর দিকে চলো’’

গাড়ি চলতে শুরু করলে মধুজা বাইরের দিকে নীরবে তাকিয়ে রইল তার দিকে তাকিয়ে রমন বলল, ‘‘গঙ্গার কাছে যাবেন?’’

মধুজা মাথা নাড়ল

— ‘‘বাবুঘাটের দিকে চলো’’ ড্রাইভারকে নির্দেশ দিল রমন

বাবুঘাটে পৌঁছে গঙ্গার পাড়ে গিয়ে বসল তারা রমন বলল, ‘‘আপনার সঙ্গে এখানে এলাম বলে ভাববেন না আমি এখানে নিয়মিত আসি আমিও যে কতদিন পর এখানে এলাম, তা মনে করতে পারছি না!’’

মধুজা তার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘‘আগে কার সঙ্গে আসতেন?’’

রমন হাসিমুখে বলল, ‘‘কোনও নির্দিষ্ট একজনের সঙ্গে নয় তখন কলেজে পড়তাম বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে দল বেঁধে কখনও কখনও এখানে এসে আড্ডা দিয়েছি’’ একটু থেমে গম্ভীর হয়ে গেল রমন বলল, ‘‘কলেজ শেষ হতে না হতেই বাবা মারা গেলেন সংসারের দায়িত্ব এসে চাপল মাথায় ভাগ্য ভালো এখানেই চাকরি পেয়ে গেলাম ধীরে ধীরে পদোন্নতি হয়ে আজ অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার যা রোজগার করি, মা আর ছেলে, আমাদের দুজনের মোটামুটি ভালোই চলে যায়’’

মধুজা প্রশ্ন করল, ‘‘বিয়ে করেননি?’’

রমন হাসিমুখে বলল, ‘‘নাহ্’’

— ‘‘কেন?’’

— ‘‘জানি না সে ভাবে বিষয়টা নিয়ে ভাবা হয়ে ওঠেনি’’

আরও কিছুক্ষণ বসল তারা তার পর গঙ্গার পাড়েই একটা রেস্তোরাঁয় কিছু খাওয়াদাওয়া করে ফেরার পথ ধরল শিয়ালদায় মধুজাকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল রমন সে চেয়েছিল, মধুজাকে স্টেশনে পৌঁছে দিতে মধুজা আপত্তি করায় আর যায়নি

সোমবার অফিসে হুলস্থুল কাণ্ড বাঁধিয়ে দিল অমিত সোজা রমনের ঘরে ঢুকে বলল, ‘‘বেশ তো ডুবে ডুবে জল খাও হে দেখছি!’’

রমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, ‘‘মানে?’’

অমিত বলল, ‘‘শনিবার বিকেলে বাবুঘাটে তোমার সঙ্গে কে ছিল হে? মেয়েটা অফিসে এসেছিলতাই না? গঙ্গার পাড়ে পাশাপাশি বসা, কত কথা, তার পর রেস্টুরেন্টে খাওয়া! ব্যাপারটা কী?’’

রমন একটু বিরক্ত হয়ে বলল, ‘‘আজকাল কি সবাইকে ফলো করিস নাকি? এই দায়িত্বটা কবে থেকে কাঁধে নিলি শুনি?’’

অমিতও তার মতো কোম্পানির একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার দুজনের ভালোই বন্ধুত্ব সে হাসিমুখে বলল, ‘‘আসলে আমি আর রঞ্জিতা সেখানে ছিলাম মানে প্রেম করছিলাম আর তোদেরও দেখে ফেললাম’’

রমন রাগ দেখিয়ে বলল, ‘‘বাজে কথা রেখে কাজের কথা বল’’

অমিত রেগে গেল বলল, ‘‘বাজে কথা! আমি কি মিথ্যে কথা বলছি নাকি? দাঁড়া, দেখাচ্ছি’’ বলেই সে মোবাইলের গ্যালারি খুলল তার পর ছবি বের করে রমনকে দেখাতে গিয়ে চমকে গেল নিজেই

অমিতকে চমকে উঠতে দেখে তার থেকে মোবাইলটা প্রায় ছিনিয়ে নিল রমন দেখল, ছবিতে গঙ্গার পাড়, বেঞ্চ আর সেখানে তার বসে থাকার ছবি পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে কিন্তু মধুজার ছবি নেই!

অমিত বলল, ‘‘এটা কী করে সম্ভব?’’

রমনও ছবিটা দেখে একটু ঘাবড়ে গেল তবে বিষয়টা নিয়ে বেশি আলোচনা করতে চাইল না বলল, ‘‘তুই এখন যা এখান থেকে’’

অমিত চুপ করে গম্ভীর মুখে সেখান থেকে চলে গেল তবে রমনের মনে খটকাটা থেকেই গেল কী করে এটা হয়? মধুজাকে কি সে ফোন করে জিজ্ঞাসা করবে একবার? কিন্তু মধুজাই বা ব্যাপারটা জানবে কী করে? সে তো তার সঙ্গেই ছিল!‌

তবে তার চমকের বেশ কিছু তখনও বাকি ছিল ঘটনাটা ঘটল বুধবার বেলা বারোটা নাগাদ রিসেপশন থেকে ফোন পেল রমন এক ভদ্রলোক তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন তিনি নাকি মধুজা এন্টারপ্রাইজের কর্ণধার কথাটা শুনে অবাক হল রমন সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে তার কাছে পাঠিয়ে দিতে বলে দিল

ভদ্রলোকের বয়স সত্তরের বেশিই হবে বেশ ক্লান্ত লাগছিল তাঁকে রমন গম্ভীর গলায় বলল, ‘‘বলুন’’

ভদ্রলোকের হাতে কিছু কাগজপত্র ছিল সেগুলি রমনের দিকে এগিয়ে দিলেন তিনি বললেন, ‘‘এগুলি একটা খামে আমার বাড়ির বারান্দায় পেয়েছি বোধ হয় ক্যুরিয়ারের লোক জানালা দিয়ে ফেলে গিয়েছে কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল আমার বা আমার স্ত্রীকে দিয়ে অ্যাকনলেজমেন্ট কাগজে সই করিয়ে নিয়ে যায়নি!’’

রমন দেখল কাগজপত্রগুলি খামে ভরে মধুজাকে সে দিয়েছিল খামে তাদের সংস্থার নামঠিকানাও লেখা রয়েছে বেশি কিছু ভাবতে পারল না বলল, ‘‘হুম তাতে কী হল?’’

ভদ্রলোক বললেন, ‘‘আসলে আপনাদের অর্ডারটা পাওয়ার জন্য আমার মেয়ে মধুজা আবেদন করেছিল আপনারা তাঁর আবেদন অ্যাকসেপ্ট করেছেন কিন্তু আমাদের সঙ্গে তো আপনারা চুক্তি একটা করবেনতা তো হয়নি কাগজপত্র দেখে বুঝলাম আপনারা সরাসরি আপনাদের প্রোডাক্ট ডিস্ট্রিবিউশনের জন্য আমাদের দায়িত্ব দিয়ে দিয়েছেন এটা কী করে সম্ভব?‌ সেই ব্যাপারটাই জানতে এসেছি’’

রমনের ভুরু কুঁচকে গেল বলল, ‘‘আপনার মেয়ে কোথায়? তিনি এসেছেন?’’

ভদ্রলোকের মুখ করুণ হয়ে গেল বলল, ‘‘মধুজা তো নেই!’’

— ‘‘মানে? বাড়ি ফিরে তাঁকে জিজ্ঞেস করুন, উত্তরটা পেয়ে যাবেন’’

— ‘‘কী করে উত্তর পাব? মধুজা কি আর আছে?’’ ভদ্রলোকের কান্নাভেজা কথা যেন আটকে গেল গলায়

— ‘‘কী বলছেন আপনি?’’ প্রায় অাঁতকে উঠল রমন

ভদ্রলোক বললেন, ‘‘আপনাদের জবাব আসতে দেরি করায় দিন দশেক আগে কলকাতায় আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল মধুজা কিন্তু ট্রেনে নিয়মিত যাতায়াত করার অভ্যেস তার ছিল না ভিড় ট্রেনে উঠতে গিয়ে পড়ে যায় ঘটনাস্থলেই মারা যায়’’ ভদ্রলোক সত্যিই কেঁদে ফেললেন এবার

তাঁর কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেল রমন ব্যাপারটা বুঝতে তার অসুবিধে হল না অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করে বলল, ‘‘অর্ডারটা কি আপনি পেতে চান?’’

ভদ্রলোক নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, ‘‘নিশ্চয়ই পেলে আমাদের খুব ভালো হয়’’

— ‘‘আপনার এই বয়সে কাজ করতে অসুবিধে হবে না তো?’’

— ‘‘আমার দুজন স্টাফ আছে তারা বিশ্বস্ত এবং পরিশ্রমী’’

ভদ্রলোকের কথা শুনে বেশ জোরের সঙ্গে রমন বলল, ‘‘অর্ডার ফাইনাল আপনি কি একটু বসতে পারবেন ওয়েটিং রুমে বাকি কাজগুলি এখনই করিয়ে নেব’’

নিজেই চেয়ার ছেড়ে উঠে ভদ্রলোককে নিয়ে ওয়েটিং রুমে এলো রমন তাঁকে বসিয়ে দিয়ে টিফিন চা দেওয়ার জন্য বেয়ারাকে নির্দেশ দিল

বৈশাখের এই সময়টায় বিকেল একটু দীর্ঘ হয় সন্ধে নামতে সাড়ে ছটা বেজে যায় সাড়ে পাঁচটা নাগাদ অফিস থেকে বের হল রমন কিন্তু বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করল না তার কী মনে হল ড্রাইভারকে বলল, ‘‘বাবুঘাট চলো’’

ড্রাইভার একটু অবাক হলেও কোনও প্রশ্ন করল না

বাবুঘাটে পৌঁছে সেই জায়গাটায় গেল রমন সেদিন এখানেই সে আর মধুজা এসে বসেছিল একটা সিগারেট ধরাল এক গাল ধোঁয়া আকাশের দিকে ছেড়ে দিয়েই চমকে উঠল সে দূরে দাঁড়িয়ে মধুজা! তার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে হাসছে

রমনের খুব রাগ হল নিজেকে সামলাতে না পেরে তাকে ইশারায় ডাকল তার পরই তার যেন সংবিৎ ফিরল

মধুজা এগিয়ে আসছে তাকে দেখে রমনের সারা শরীরে শিহরণ খেলে যেতে শুরু করল

কাছে এসে তাকে কিছু বলতে না দিয়ে মধুজা নিজেই বলল, ‘‘আপনাকে অনেক ধন্যবাদ অর্ডারটা না পেলে আমাদের খুব ক্ষতি হয়ে যেত দুজন কাজ করে তাদের মাইনেও দিতে পারতাম না’’

রমন চুপ করে রইল

মধুজা হাসছে

এবার রমন বলল, ‘‘আপনি এমন করলেন কেন?’’

মধুজার চোখে খুশির ঝিলিক বলল, ‘‘আমাকে ভুল বুঝবেন না ছাড়া আমার আর কোনও উপায় ছিল না’’ একটু থেমে বলল, ‘‘আমি আসি কেমন!’’

রমন কোনও কথা বলতে পারল না

মধুজা চলে যাচ্ছে যেতে যেতে একবার থমকে দাঁড়াল পিছন ফিরে রমনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘‘আপনি খুব ভালো মানুষ’’ বলেই ধীরে ধীরে বাতাসে মিলিয়ে গেল

রমন দৃষ্টি নামিয়ে আনল মাটিতে তার পর মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে রইল গঙ্গার দিকে আজ যেন একটু তাড়াতাড়িই সন্ধ্যার জন্ম হচ্ছে অন্ধকার নামছে ধীরে ধীরে আচমকা তার মনে হল বিকেলটা যেন অসহায় ভাবে মরে যাচ্ছে আপন মনে বলে উঠল রমন, ‘‘একটা ছোট্ট সংসার! হয়তো ভুল করেই—!’’

একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার মুখ থেকে‌‌‌

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন