দেবসেনা ।
সাহিত্য সমাদের দর্পণ। সাহিতি্যক তাঁর নিজের সময় এবং পারিপার্শ্বকে তুলে ধরেন সুবিধার মাধ্যমে। তৎকালীন মানুষের দৃষ্টিভঙ্গী ও মূল্যবোধের প্রতিফলনও ঘটে থাকে। বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র– সবার ক্ষেত্রেই একথা সত্য। তাঁদের সৃষ্ট উপন্যাসের চরিত্ররা সেই সময়ের প্রতিভূ। স্বাভাবিকভাবেই তৎকালীন সমাজে নারীর অবস্থা এবং অবস্থানের চিত্র ফুটে উঠেছে কুন্দনন্দিনীর অচলা বা বিনোদিনীর মধে্য। কেউ প্রশংশসিত হয়েছে, কারুর ভাগে্য জুটেছে শুধুই নিন্দা, সমালোচনা। কারণ, চরিত্রগুলির বিচার হয়েছে সেই সময়ের সামাজিক মূল্যবোধের নিরিখে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গিয়েছে জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গী। সে যুগের নারীর কাছে যা ছিল প্রত্যাশিত, স্বাভাবিক, আজ আর তা নয়। ভারতীয় ভাবনায় দিনে দিনে বেড়েছে পশ্চিমের প্রভাব। বেশি বেশি করে রুঢ় বাস্তবের মুখোমুখী হতে হয়েছে তাকে। তাই ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে তথাকথিত সতীত্বের খুঁটিনাটি নিয়ে মাথা ঘামানোর মানসিকতা। শরীর সূচিতা নয়, মনের সততার বিশ্বাস বেড়েছে। আর এর প্রভাব স্বাভাবিকভাবেই পড়েছে সাহিতে্য। গত এ শতকে বাংলা গল্প-উপন্যাসের নারীরা।
যুগের কোনও সীমারেখা নেই। ঠিক কবে থেকে ভারতীয় নারীর এই পরিবর্তনের সূত্রপাত, তার কোনও নিশ্চিত দিনক্ষণ থাকার কথা নয়। তবে গত শতাব্দীর চল্লিশের দশক ধেকেই মেয়েরা ব্যপাকহারে শিক্ষিত হতে থাকে ও পঞ্চাশের দশক থেকে তারা চাকরি ও জীবিকার সন্ধানে বাড়ির বাইরে আসতে শুরু করে। খোলা আকাশের নীচে এসেই চার দেওয়ালের টান আর বিশ্বজনীন হাতছানির টানাপোড়েনে নারীর স্বাধীনতার সুপ্ত বাসনা জেগে ওঠে। একদিনে চিনন্তন নারী সংস্কার, নারী সেন্টিমেন্ট– অপরদিকে সামাজিক বঞ্চনার নাগপাশের বিরুদ্ধে জাহাদ, এই দুইয়ের মাঝেই জন্ম নেয় নারী আন্দোলন, ‘অবলা’ নারী আর রাজি নয় শৈশবে পিতা, যৌবনে স্বামী আর বার্দ্ধকে্য পুত্রের বশে থাকতে।
এসবের চিত্রগুলিই বার বার উঠে এসেছে স্বাধীনতার ২৫ বছর অতিক্রম থেকে দেশে মুক্ত অর্থনীতির সূচনা হওয়ার আগে পর্যন্ত বিভিন্ন লেখকের লেখা উপন্যাসে। ‘ভারতীয় নারী জন্মায় একবার, মরে একবার, তাদের বিয়েও হয় একবার’– এই সামাজিক আপ্তবাকে্যর মূলে কুঠারাঘাত করলেন অরুণ দে তাঁর ‘বন্ধুর স্ত্রী’ উপন্যাসে (১৯৮০)। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র মণিকা সুখেই ঘর করছিল স্বামী প্রশান্তকে নিয়ে। উড়ে এস জুড়ে বসল প্রশান্তর ব্যাচেলর বন্ধু। প্রশান্তর অনুপস্থিতিতে অনিচ্ছাকৃতভাবে (!) মণিকার সঙ্গে তার একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। প্রশান্তর ওই বন্ধু যখন মণিকাকে বিছানায় টেনে নেয়, প্রতিবাদ করে না মণিকা। এরজন্য তার মনে বিন্দুমাত্র অনুশোচনা, পাপবোধ বাসা বাঁধে না। তাদের এ প্রেমকে ‘অবৈধ’ করে লুকিয়েও রাখে না সে, স্বামীর কাছে সে অকপটে স্বীকার করে সেই প্রেমের কথা।
এদিকে বাণী বসুর ‘শ্বেত পাথরের থালা’য় দেখি সেই বাল্যবিধবা নারী কীভাবে সংস্কার কাটিয়ে উঠে আসে জৈবিক চাওয়া-পাওয়ার অতিবাস্তবে। কিন্তু সাহিতি্যক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ‘ভালোবাসার অন্ধকারে’ (১৯৯০) উপন্যাসে সংস্কারটা কোনও প্রশ্নই তোলেনি গার্গীর মনে। গার্গী প্রশ্ন তোলে নিশ্চিত আশ্রয় নিয়ে– ‘আমাকে যদি তাড়িয়ে দেয়–?’ স্বামীর যৌনশৈত্য তার মা হওয়ার বাসনা অপূর্ণ রয়ে গিয়েছে। অবচেতনে সেই কারণেই কি তার মন সায় দিয়েছে অন্য পুরুষের সঙ্গে মিলনে? এরজন্যও গার্গীর মনে কোনও অপরাধবোধ হয় বলে মনে হয় না।
ব্যাভিচার, পাপবোধ-এর ‘সংস্কার’ কথাটা পুরান। বিয়ের আগে শারীরিক সম্পর্ক আজ আর কোনও ধর্তবে্যর বিষয় কিছু নয়। নয়ের দশকের আগে ওসব প্রশ্ন উঠত যে, বিয়ের আগে শারিরীক সম্পর্ক পরবর্তীতে দাম্পত্য সম্পর্কে্য প্রভাব ফেলে কিনা। তখনকার আর্থ-সামাজিক মানদণ্ডেই সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হত। আজ ২০২২ সালে হয়তো সেটা অবাস্তব শোনাবে, কিন্তু তখন সেটা বেশ আবেগের ছিল। দিবে্যন্দু পালিতের ‘স্বপ্নের ভিতরে’ (১৯৮৭) উপন্যাসের অর্পিতা বিবাদের পূর্বে অন্তস্বত্ত্বা হয়। অজাত সন্তানটির জন্য মাতৃত্বের টান অনুভব করা সত্ত্বেও তাকে বিসর্জন দিতে হয়। এরপর নিজের বাস্তব পরিস্থিতি সহজভাবে মেনে নেয় অর্পিতা। হয়তো জীবনের পথচলা স্বাভাবিক হয় না, হয় কিছুটা মন্থর, কিছুটা বিমর্ষ...তবু এগিয়ে চলে।
আবার প্রফুল্ল রায়ের ‘রণক্ষেত্র’ উপন্যাসে (১৯৮৫) নায়িকা দীপা উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলে অনীশকে ভালোবাসে। প্রেম অতি তাড়াতাড়ি শারীরিক প্রেমে পৌঁছেও যায়। দীপা অন্তঃস্বত্ত্বা হয়ে পড়ে। কিন্তু অনীশ বা তার পরিবার দীপা ও দীপার সন্তানের দায় নিতে অস্বীকার করে। দীপার বাড়ির সবাই তাকে গর্ভপাত করানোর জন্য চাপ দিতে থাকে। কিন্তু সে কিছুতেই রাজি হয় না। সে চায় না তার ‘ভুল’-এর জন্য যে নিষ্পাপ শিশু পৃথিবীতে আসছে সে পৃথিবীর আলো দেখার আগে তাকে চিরস্তব্ধ করে দিতে। বরং সে লড়াই করে প্রভাবশালী একটি পরিবারের সঙ্গে, সমাজের বিরুদ্ধে। বাধ্য করে অনীককে বিয়ে করতে। কিন্তু, পরদিনই বিচ্ছেদের নোটিস পাঠিয়ে দেয় অনীককে। তার সন্তানের একটা পিতৃপরিচয়ের দরকার ছিল! দীপার অনুশোচনা তার কোনও এক দুর্বল মুহূর্তের ভুলের জন্য নয়, মানুষ চিনতে ভুল করার জন্য।
ব্যাভিচার, পাপবোধ, সংস্কার– এসব মেকি বুলি অস্বীকার করে নারী ‘উচ্ছৃঙ্খল’ হচ্ছে কিনা, সে বিচার পাঠকের। সে বিরাট বিতর্কেরও বিষয়। কিন্তু নারীর চরম আত্মত্যাগও বর্ণিত হয়েছে বারবার বিভিন্ন গল্প-উপন্যাসে। নারীর যে এই আত্মত্যাগ, এও তো সেই পাপবোধ-সংস্কার-সতীত্ব– শব্দগুলির অসাড়তা অনুভবের জন্যই। এইসব উপন্যাসের নায়িকারা কেউ কল্পনা নয়। চোখ খুলে থাকলে আমাদের চারপাশেই খুঁজে পাওয়া যাবে তাদের।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন