সৈকত
‘প্রতিবার জিতে ফিরে রক্ত ধুয়েমুছে যখন তুমি হাসো
কেবল সে বালিকা জানে,
ভালোবেসে খুন হয় না কেউ,
আসলে ওটা আত্মহত্যা ছিল।’
ভালোবাসা আর রক্তপাত– যুগ-যুগান্ত ধরে একসাথে চলেছে। কিন্তু ছন্দকবিতায় ভালোবাসার সঙ্গে রক্তপাত ততদিন ধরেই দূরে দূরে রাখা হয়েছে। গোলাপটাকেই তুলে ধরা হয়েছে, আড়াল করা হয়েছে কাঁটাগুলোকে। সাহস দেখালেন এক তরুণ কবি।
লোপামুদ্রা কুণ্ডু। মহানন্দার তীরে, আম্রপল্লবের ছায়ায় বড় হয়ে ওঠা একজন তরুণ কবিকে ইট-কাঠ-পাথরের জঙ্গলে মানায়া কিনা জানি না, কিন্তু পেশায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার কাজের চূড়ান্ত ব্যস্ততার মধে্যও হাতে কলম তুলে নিয়েছেন। সদ্য দিনকয়েক আগে তাঁর ‘গোলাপের কাঁটা’ বইটি হাতে এসে পেয়েছি। আশ্চর্য হয়ে দেখছি, কবি লোপামুদ্রা কুণ্ডু এই কাব্যগ্রন্থে তার কবিতাগুলিকে যেন কালের প্রস্তরখণ্ডে উৎকীর্ণ করে দিয়েছেন। কথাটা এই কারণে বললাম, এই কাব্যগ্রন্থের ‘বালিকা জানে’ কবিতায় কবি আশ্চর্যভাবে তার আগমনকে জয়ধ্বনিতে রূপান্তরীত করেছেন, – ‘যে দেশে নীতির নাম করে ধর্ষণ নিয়মিত, /সেদেশে প্রেমিক হবে না তুমি এতো জানা কথা ছিল। /কার দেহ টেনে এনে তবে কাঁটাতারে রাখো?/ সে তো মৃতই ছিল রাষ্ট্রদ্রোহীর মত।/ আঙুল তুলে আজ দেশ দেশ ডাকো, / আগে একটি ঘর খোঁজ যেখানে বিশ্বাস ছিল।’
কবি লোপামুদ্রার কবিতাগুলো অন্তর ছুঁয়ে যায়। বইয়ের মলাট বন্ধের অনেক পর পর্যন্তও মনকে সুবাসিত করে রাখে। লোপামুদ্রা একজায়গায় লিখেছেন– ‘তবু ঠিক করেছি/ বাঁচবো আমি,/ এ হৃৎপিণ্ড তোমাদের কারও হাতে তুলে দেব না কখনো।’ ‘অবাধ্য মেয়ে’ কবিতায় লোপামুদ্রা আরও লিখেছেন, ‘আমি তো চাই,/ ভালোবাসা এতটাই সংক্রমিত হোক তেমাদের বুকে/ যে মানুষ একদিনে শিখে যাক মৃতু্যকে আগ্রাহ্য করতে।’ তবু ভালাবাসাই সব, ভালোবাসাই শেষকথা। ভালোবাসায় আস্থা রাখার নামই জীবন। তাই তো লোপামুদ্রা এ-ও লিখছে, ‘ভালোবাসা একটি পাখির নাম–পাখি আসে, ঠোঁট ডুবিয়ে বসে বুকের খাঁচায়। /আশ্রয় কি ভালো না বাসলে কেউ দিতে পারে?...ভালোবাসি বলে গাছ সেজে মাটিতে পা পুঁতে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকি, পাখি আসে, পাখি উড়ে যায় বিমা বাধায়।’
এই তরুণ কবির কবিতা পড়তে পড়তে আনমনা হয়ে যেতে হয়। লোপামুদ্রা লিখছেন– ‘আমি সবটুকু সোহাগ পাঠিয়ে দিয়েছি তোর নাম করে/ এর পরে ফিরে এলে /দেখবি মরেনা কেউই, শূন্যতা নিয়েও মানুষ ঠিক বেঁচে থাকে।’ আহা কী অপরূপ আবেগ– ‘মেয়েরা যখন ভালোবাসে চুপচাপ ভেজে, / নয়তো আকাশের মতো মুখ বুজে ছুঁয়ে থাকে পৃথিবীর মাঠ পাহাড়।’ বইয়ের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে প্রথমেই চোখ আটকে গিয়েছিল ‘অহল্যা’কবিতাটিতে। যেখানে কবি লিখছেন– ‘কে শাস্তি দেবে আমায়? আমি নিজেই তো ছেড়ে যেতে পারি অন্তঃস্বারহীন কূটনীতি!/ মেয়েরা আসলে মাটি, ফসল চাইলে ধানবীজ দেবে আর ঘৃণা করলে শুকনো রুক্ষ মরুভূমি।/ আমি অহল্যা, কেউ শাস্তি দেয়নি আমাকে, বরং আমি নিজেই পাল্টে ফেলেছি আমাকে/ নিদ্রিত থেকছি পাথর হয়ে, অপেক্ষা করেছি কবে বিবেক জাগ্রত হবে তোমাদের!’ প্রচ্ছদি খুব আকর্ষণীয় নয়। তবে একটা ভাল বিষয়, আমার যেটা মনে হয়েছে, কবির নিজেই একটি প্রচ্ছদ আঁকার চেষ্টা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। আর মনে আছে তো সেই বিখ্যাত উক্তটি– মলাট দেখে বইয়ের বিচার করা ঠিক নয়।
এই কাব্যগ্রন্থে গদ্যকবিতার য়ে স্পর্ধিত উচ্চারণ কবি লোপামুদ্রা এনেছে, তিনি নিশ্চয় সেখানেই থেমে থাকবেন না। কবিকে ছন্দের বাগানে প্রবেশাধিকার আদায় করে নিতে হবে, যেখানে ধীর, মধ্য ও দ্রুত লয়ের স্বাভাবিক তালে কবিতার শব্দরা শৃঙ্খলাবদ্ধ হতে শেখে। তরুণ কবির সেই প্রত্যাশা জাগিয়ে দিতে পেরেছেন, তাঁর কবিসত্ত্বা মিশ্রকলাবৃত্ত, কলাবৃত্ত, দলবৃত্তের স্পন্দনে নন্দিত হবে। লোপামুদ্রাকে জানতে হবে, কবিতা শুধু নিখাদ গদ্য নয়, অথবা দুই ছন্দের মাতামাতি নয়। কবিতা হল ছন্দ ও না-ছন্দের এক অন্তহীন পরিভ্রমণ। আমরা সেই কবিতাগুলির অপেক্ষায় রইলাম।
গোলাপের কাঁটা
লোপামুদ্রা কুন্ড ু
শব্দের ঝংকার প্রকাশনী

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন