দেবাশিস কর্মকার
পর্ব-২
১৯৭৬ সাল।
মা আমাদের নিয়ে বেলেঘাটায় উঠে এল। সদ্য গড়ে ওঠা সিআইটি আবাসনে। উঠে আসাই বটে! এঁদো খালের পাশে হেলে পড়া বাড়ি থেকে একেবারে চারতলায় ফ্ল্যাট। মা উঠে এল এই কারণে বলছি, কারণ আমাদের এই ঠিকানা বদলে বড় উদে্যাগটাই ছিল মায়ের। বাবা টাকার বন্দোবস্ত করেছিল।
আমি, আমার দুই দিদি এবং মা-বাবা– আমাদের সবার জীবনে ঐতিহাসিক দিনটা ছিল, যতদূর মনে পড়ে ফেব্রুয়ারির শেষ বা মার্চের শুরুর কোনও এক সময়। বিল্ডিংয়ের গেটের সামনে রিকশা থেকে মায়ের সঙ্গে নামলাম আমরা তিম ভাইবোন। সিঁড়ি ভেঙে চারতলা। বারান্দায় উঁচু পাঁচিলে যতটা সম্ভব মুখ বাড়িয়ে দেখলাম মিঠে রোদে ভরে রয়েছে চারপাশ। ভোরের দিকে হয়তো একপশলা বৃষ্টি হয়েছে। বিল্ডিংয়ের দেওয়ালগুলো ভিজে রয়েছে এখনও। সামনেই বড় মাঠ। সেটাও ভিজে, মাঝে মাঝে কয়েকটা নিচু জায়গায় জল জমে রয়েছে।
আগে একদিন মা-বাবার সঙ্গে এখানে এসেছিলাম। বাবার কারখানার এক সহকর্মী আগেই এখানে ঘর কিনেছে। তারা ঘর দেখাতে ডেকেছিল। তখন রাতের বেলা। আর সেদিন লোডশেডিং ছিল। বিশেষ কিছু ঠাওর করতে পারেনি। আজ দেখলাম এখানে আকাশটা অনেক বড়। আর অনেক কাছ থেকে দেখা যাচ্ছে। নীল আকাশে ডানা মেলে উড়ে বেড়াচ্ছে পাখি। ঘরগুলোর জানলার কার্নিসে চড়ুই পাখি উড়ে এসে বসছে। আবার উড়ে যাচ্ছে।
আমাদের আগের বাড়িতে চিলতে আকাশ দেখা যেত। হয়তো কখনও তাকানোই হত না। একটা পাঁচ-সাতের খাটে মা আমাদের তিন ভাইবোনকে নিয়ে শুতো। একদিন রাতে হল কী, ছোড়দি বমি করে ফেলল। আমি পাশে শোয়া, আমার মাথা-কানেই বমি। রাতে আমাকে তুলে নিয়ে গিয়ে উঠোনে বালতিতে ধরে রাখা জলে আধ চাল করাল বাবা। সেই সময় হঠাৎ আকাশের দিকে চোখ পড়েছিল। সেদিন বোধহয় পূর্ণিমা ছিল। আকাশে রুপোর থালার মতো চাঁদ উঠেছিল। তার আলো এলো-মেলো টিনের চালাগুলোর সঙ্গে লুকোচুরি খেলার মতো খানিকটা চাঁদের আলো এসে পড়েছিল উঠোনে।
চারঘরে ভাড়াটিয়ার সবার সমান দখলদারি এই উঠোনে। বাসিন্দারা জলের বালতি, ঘুটে-কাঠ-কয়লার বস্তা দিয়ে যে যার সীমানা বাতলে নিয়েছে। রাতের অন্ধকারে কেউ কেউ আবার সেই সীমানা একটু একটু করে বাড়িয়েও নেয়। প্রতিবেশীর এই আগ্রাসন নিয়ে পরদিন সকালে গোলও বাধে।
মা এই উঠোনে উবু হয়ে বসে বাসন মাজত। রাস্তার কল থেকে বালতিতে করে বয়ে আনা জল বাসন ধুতে ব্যবহার করত অতি সন্তর্পনে। ওই উঠোনেই তোলা উনুনে আঁচ দেওয়ার সময় কাঁচা কয়লার ধোঁয়ায় আমাদের চোখ জ্বালা করত। আগুনের তাপে মায়ের ফর্সা মুখটা লাল হয়ে যেত। আমাদের নতুন বাড়িতে দুটো বড় বড় ঘর। দ্বিতীয় ঘরটাতেই রান্নার ব্যবস্থা, অর্থাৎ রান্না ঘর। কিন্তু একটা পাঁচ-সাত খাট পেতে দিবি্য আরও ক’জন শোয়া যায়। তারপরেই মেঝেতে আসন পেতে বসে দু’চারজন একসঙ্গে খেতে পারবে।
এই ঘরেই এক কোনায় সেট করা চৌকনা মাটির উনুন। চিমনি দিয়ে ধোঁয়া বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা। উনুনের ধোঁয়ায় আর আমাদের চোখ জ্বলবে না। পাশেই ঘেরা কলের ব্যবস্থা, বাসন মাজার জন্য। সবসময়ের জলের ব্যবস্থা। মাকে আর রাস্তার কল থেকে জল বয়ে আনতে হবে না। মাকে আর গরমে প্রচণ্ড রোদের তাপে, শীতের উত্তুরে হাওয়ায় কিংবা বর্ষার দিনে বৃষ্টির ঝাপটা সহ্য করে উঠোনে বসে বাসন মাজতে হবে না।
ঘরের সঙ্গেই স্নানের জায়গা, পায়খানা। মা বলতে শেখাল– বাথরুম। কাঠের দরজা। ভিতর থেক ছিটকানি টেনে দিয়ে ভিতরে...। আমাদের মাতৃকুটিরের বাড়িটায় কোনও আব্রু ছিল না। সববয়সী জনা কুড়ি বাসিন্দার জন্য একটাই পায়খানা, এখটাই স্নানের জায়গা। সামনে বস্তা টাঙানো। একদিন রাতে বাবাকে উদ্দেশ্য করে মা’কে বোধহয় বলতেও শুনেছিলাম– এখানে থাকলে আর ছেলেমেয়েকে মানুষ করতে হবে না। বাবার কোনও উত্তর শুনতে পাইনি। এরমধে্যই বাবা এসে গেছে। ও বাড়িতে জিনিসপত্র ক’দিন ধরেই বাঁধা-ছাঁদা চলছিল। সে সব জিনিসপত্র এসেছে টেম্পোতে।
ক্রমে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হল। এমন সিঁদুর রাঙা আকাশ আমার জীবনে সেই প্রথম দেখা। আমাদের চারতলার লম্বা বারান্দায় মা কোলে নিয়ে সূর্যডোবা দেখাল। সেই প্রথমবার।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন