স্মৃতিকণা রায়
সাত সকালে হাঁটার অভ্যাস কিছুতেই ছাড়তে পারে না। এমন অভ্যাস যে, ওই সময় তার ঘুম ভাঙবেই। নতুন জায়গা। তবু ট্রাকস্যুট পরে বেরিয়ে পড়ল। দু’দিনের জন্য ডুয়ার্স আসা। একটা অনুষ্ঠানে প্রায় জোর করেই তাকে নিয়ে আসা হয়েছে। তার একদমই ইচ্ছে ছিল না। উপরোধে মানুষ ঢেঁকি গেলে মাঝে মাঝে। তারও সেই অবস্থা!এই মুহূর্তে হাতে অনেক কাজ। পুরো দু’দিন সময় নষ্ট!
তবে, খারাপ লাগছে না। দু’দিকে ঘন জঙ্গল।তার মধ্য দিয়ে হাঁটছে।সবে আলো ফুটেছে। হালকা হাওয়া, শুদ্ধ অক্সিজেন। সে নিজেকে মনে মনে বলল, ‘‘কলকাতায় তো এ সব পেতে না!অতএব, খুশি থাকো।’’
মনও খুশি। গলা দিয়ে গান বেরিয়ে এলো। ‘‘মম চিত্তে নিতি নৃত্যে কে যে নাচে...।’’
ছোটবেলায় মায়ের শেখানো রবীন্দ্র সঙ্গীত। ঘড়ি দেখে হাঁটছে। ঠিক চল্লিশ মিনিট। তার মানে কুড়ি মিনিট সামনে এগিয়ে ব্যাক করবে। তখন সূয্যিমামা সামান্য উঁকি দিচ্ছে। হঠাৎই সে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। কী একটা দেখে প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেল। রীতিমতো কাঁপছে।পিছন ফিরে দৌড়তে শুরু করল। একবার হোঁচটও খেল। পড়িমড়ি করে আবার দৌড়।ধাক্কা খেল একজনের সঙ্গে। একেবারে ঘাড়ে হামলে পড়েছে। পড়তে পড়তে মানুষটা নিজেকে সামলে নিল। দু’হাতে জড়িয়ে নিয়েছে তাকে। চোখ বন্ধ। সমানে হাঁপাচ্ছে। একটু সামলে নিয়ে হাত–পা জড়ো করে বসে পড়ল রাস্তায়
মানুষটাই প্রথম কথা বলল, ‘‘তুমি নন্দিনী না?’’
তার মুখ থেকে কথা বের হচ্ছে না।গলা শুকিয়ে গেছে খুব। মাথা নেড়ে উত্তর দিল।
–‘‘কী হয়েছে? হাতির পাল? এখানে যখন–তখন হাতির পাল বের হয়।’’
তবে সে ঘাড় নেড়ে বলল, ‘‘না।’’
—–‘‘তা হলে?’’ সে হাত তুলে সামনের দিকে দেখাল। মানুষটা সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। নন্দিনী তার পাঞ্জাবি টেনে ধরল। সে হেসে বলল, ‘‘এত ভয় কীসের? দেখে আসি!’’
—–‘‘না।’’
–‘‘আচ্ছা, তুমিও চলো। দু’জন একসঙ্গে যাই।’’
মানুষটার পিছু পিছু মৃদু পায়ে হেঁটে চলল নন্দিনী।
—–‘‘কোথায় কী! কীসে এত ভয় পেলে?’’ সে হাত তুলে দূরের দিকে দেখাল।
—–‘‘কোথায়? এতটা হেঁটে ফেললাম! কত দূর গিয়েছিলে তুমি?’’ নন্দিনী আবার হাত তুলে দেখাল। আরও খানিকটা এগিয়ে মানুষটা দাঁড়িয়ে পড়ল। দুটো শঙ্খচূড় রতিতে মগ্ন। নন্দিনী দূরে দাঁড়িয়ে।
—–‘‘কী হল? —এসো। এসো এখানে। কিচ্ছু হবে না।’’
সে একটু এগিয়ে গেলেও মানুষটাই পিছিয়ে এলো। – ‘‘শঙ্খচূড়। পরস্পরকে ভালবাসছে। এই সময় তাদের বিরক্ত না করলে তারাও কিছু করে না। আর জানো, আমার মা বলে, এই সময়টা হল শঙ্খলাগা। তা দেখতে পাওয়া খুব মঙ্গলের। আর নিজের কাছে যদি রুমাল বা অন্য কোনও কাপড় থাকে, তা তাদের দিকে ছুড়ে দিতে হয়। সেই কাপড় বা রুমালের ওপর তাদের শরীর ফেললে, সেটা তুলে যত্ন করে আলমারিতে রেখে দিতে হয়।’’
হাসিমুখে বলল, ‘‘এটা হয়তো কুসংস্কার, হয়তো নয়!’’
নন্দিনীর কাছে একটা বড় তোয়ালে ছিল। মানুষটা সেটা টেনে নিল। তার পর শঙ্খলাগা সাপ দুটোর দিকে ছুড়ে দিল। তা দেখে নন্দিনী কয়েক পা পিছিয়ে গেল। মানুষটাও কিছুটা পিছিয়ে এসে দাঁড়াল। তার পর সেখান থেকে তাকে নিয়ে কিছুটা দূরে সরে গেল।
* * *
কখন যেন আকাশ কালো করেছিল। দু’জনেই খেয়াল করেনি। গুরুম গুরুম করে মেঘ ডেকে উঠল। নন্দিনীর ভয় পাওয়ার আর শেষ নেই! বজ্র নিনাদকেও সে বড় ভয় পায়। ফের খুব জোরে মেঘ ডেকে উঠলে তার চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে এলো। মানুষটা তাকে কাছে টেনে নিল। আবারও বজ্র নিনাদ! নন্দিনী তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তার পিঠে হাত রাখল মানুষটা। অদ্ভুত এক অনুভূতি হল তার। মানুষটার বুকের ওপর আলতো ভাবে পড়ে রইল। মানুষটা দু’হাত দিয়ে তাকে আগলে রাখল।
ভালো লাগছে তার। খুব ভালো লাগছে। জীবনে এই প্রথম কেউ যেন তাকে বলছে, ‘‘আমি তো আছি। ভয় কী?’’
মানুষটা আস্তে আস্তে বলল, ‘‘ঝমঝম করে বৃষ্টি নামবে এখনই। চলো, তোয়ালেটা নিয়ে ফিরে যাই।’’
–‘‘তোয়ালে?’’
—–‘‘হ্যাঁ, যেটা ওখানে দেওয়া হল।’’
—–‘‘হ্যাঁ, কিন্তু।’’
–‘‘কিন্তুর কিছু নেই। তারা এতক্ষণে নিশ্চয় অন্যদিকে চলে গেছে।’’
* * *
ফেরার পথে নন্দিনীই কথা বলল, ‘‘জানেন তো আমার এখানে আসার একদম ইচ্ছে ছিল না। উদ্যোক্তারা এমন জোর করল!’’
—–‘‘ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ!’’
—–‘‘একদম।’’
—–‘‘আমাকে নিজের সম্পর্কে বলতে হবে। —কী বলব?’’
—–‘‘নিজেকে যতটুকু জানো, ঠিক ততটুকুই বোলো।’’
—–‘‘ধ্যুস, ভালো লাগছে না।’’
—–‘‘ভালো না লাগার কোনও কারণ নেই। প্রথম প্রথম এ রকম একটু হয়।’’
* * *
সামনে একটা চায়ের দোকান দেখে মানুষটা তার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘‘চা খাবে?’’
—–‘‘চা? —আমি তো খাই না!’’
—–‘‘সে কী? তা হলে চা–খড়িটা আজই হয়ে যাক। আপত্তি নেই তো?’’
চা খেতে খেতে মানুষটা বলল,‘‘আমার পরিচয় পাওয়ার কি দরকার আছে?’’
লাজুক হেসে নন্দিনী ঘাড় নাড়ল।
—–‘‘তীর্থঙ্কর আমার নাম। আর, কী করি? বাংলার শেষ হয়ে যাওয়া সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা।’’
নন্দিনী হা–হা করে হেসে উঠল।
–‘‘বাহ্, তুমি হাসতে পারো নাকি?’’ নন্দিনী তখনও হাসছে।
–‘‘সবসময় এ রকম হাসতে পারো না? একটাই তো জীবন। কেন হাসতে হাসতে কাটাবে না? এমন সহজ ভাবে বাঁচতে পারলে তো ক্ষতি নেই!’’
* * *
আজ বিকেলে কী বলবে, মনে মনে নন্দিনী নিজের সঙ্গেই আলোচনা করে নিচ্ছিল। আজ তার মধ্যে অদ্ভুত একটা ভালো লাগা কাজ করছে। আর কোনও দিন তার এ রকম হয়নি। তীর্থঙ্কর যখন তাকে জড়িয়ে ধরেছিল, তখন তার খুব ভালো লাগছিল।আগে কোনও দিন তার এ রকম হয়নি। এখনও চোখ বুজলে সেই ভালো লাগাটা সে অনুভব করতে পারছে। উদ্যোক্তারা একটা ভালো কাজ করেছে।সবার জন্য আলাদা, মানে সিঙ্গল রুম। এটা না হলে তার খুব অসুবিধে হত। ঘরের টিভিটা আস্তে চলছে।উপরে পাখার দিকে তাকিয়ে সে ভাবছিল, সারা জীবন মানুষের কি একই ভাবে চলে? মাঝে মাঝে সব তো বদলাতে পারে!এই আজ যেমন একটু বদলাল। তা হলে একটা দিন তো একটু অন্য রকম কাটে!
তোয়ালেটা পাশেই ছিল। সে সেটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল। হঠাৎ দরজায় ঠকঠক আওয়াজ শুনে সে চেঁচিয়ে বলল, ‘‘চলে আয়। দরজা খোলা।’’
—–‘‘আবার একচোট ঘুম নাকি?’’ সে তাড়াতাড়ি বিছানায় উঠে বসল।
–‘‘আপনি?’’
–‘‘চলে এলাম।’’ পিছনে হোটেলের একটা ছেলে। হাতে খাবারদাবার।
–‘‘ভাবলাম, আজকের ব্রেকফাস্টটা তোমার সঙ্গেই করি। অবশ্য তোমার পারমিশন নেওয়া হয়নি!’’
–‘‘কী যে বলেন!’’ নন্দিনী বিছানা থেকে নেমে বলল, ‘‘ভালো হয়েছে।’’ ছেলেটা খাবারের ট্রেটা নামিয়ে রেখে চলে গেল।
* * *
স্টেজে উঠে অস্বস্তি হচ্ছিল নন্দিনীর। জীবনে এই প্রথম তার স্টেজে ওঠা! সামনে অনেক মানুষ।এক সেকেন্ড।দু’ সেকেন্ড। তিন সেকেন্ড। কী বলবে সে? কী বলবে? সামনে তীর্থঙ্কর। একদম সামনে। হাত নাড়ছে। শুরু করতে বলছে।
সে শুরু করল, ‘‘আমি নন্দিনী। আপনারা হয়তো কেউ কেউ আমাকে চেনেন। অনেকেই আবার চেনেন না। আসলে এই নন্দিনী হয়ে ওঠার পিছনে একটা ছোট্ট গল্প আছে। সেটা বলার জন্য আজ আপনাদের কাছে আমার আসা। কিন্তু, আপনারা আমার কথা শুনবেন কেন? অবশ্য সে দায় আমার নয়, সেই দায় উদ্যোক্তাদের। আমি কী ভাবে বড় হলাম, তা কি একটা গল্প? নাকি আমি কী করি, তা একটা গল্প? আমার ছোটবেলা। বাবাকে আমার খুব একটা মনে পড়ে না। শুধু মনে আছে, আমাকে কাঁধে বসিয়ে ঘুরে বেড়াতেন তিনি। তার পর একদিন। বাবা আর নেই। এখন অনেক উঁচু ফ্ল্যাটে থাকি আমি। দিদুন আর মণি পিসি। আগে মা খুব কম সময়ই বাড়িতে থাকত। আসলে মা ডাক্তার ছিল। বড় হওয়ার অনেক আগেই হস্টেলটা আমার বাড়ি হয়ে গেল। এক সময় আমার একটা ঘর ছিল।বাড়ি ছিল।গ্রীষ্মের ছুটিতে, পুজোর ছুটিতে সবাই যখন বাড়ি যেত, আমি কিন্তু হস্টেলেই!আমার মতো আরও কয়েকজন থাকত। আমার মা আসত।মায়ের কোনও দিন সময় মতো আসতে ভুল হত না। মায়ের ইচ্ছে ছিল আমিও ডাক্তার হই। কিন্তু দু’বারের চেষ্টাতেও ডাক্তারি পড়তে চান্স পেলাম না। তা হলে ইঞ্জিনিয়ার হই? তা–ও আমার ইচ্ছা নয়।কিন্তু জোর করে ভর্তি করে দিল।আবার হস্টেল। কিন্তু ফার্স্ট ইয়ারের পর আর টানতে পারলাম না।
মাকে বললাম, ‘‘আমি আর পড়ব না।’’
— ‘‘তা হলে আমার সঙ্গে আর কোনও সম্পর্ক থাকবে না।’’
— ‘‘আমার খুব বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করে। তোমার সঙ্গে থাকতে ইচ্ছে করে।’’
একদিন বাড়ি চলে গেলাম। দিদুনকে কতদিন পর দেখলাম! পিসি এসে জড়িয়ে ধরল। তাদের মুখেই শুনলাম, বাবার প্রভাব যাতে আমার ওপর না পড়ে, তাই আমাকে বাড়ি আনা হয় না। আর, আমার বাবা দু’বছর আগে মারা গেছেন!’’
হস্টেল থেকে হয়তো মাকে ফোন করেছিল। মা খুব তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এলো।
–‘‘কী ব্যাপার? তুমি হস্টেলে কিছু না জানিয়ে চলে এসেছ কেন?’’
–‘‘হ্যাঁ, আমার ভালো লাগছে না।’’
–‘‘কিন্তু পড়াশোনা তো তোমায় করতে হবে!’’
–‘‘আমি আর পড়ব না।’’
–‘‘কী করবে?’’
–‘‘ভাবিনি এখনও।’’
–‘‘আর তো কয়েকটা বছর!’’
–‘‘আমি আর পড়ব না। আমি তোমাদের সবার সঙ্গে থাকব।’’
–‘‘পড়াশোনা না করলে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। আমার সঙ্গে সম্পর্ক রেখো না।’’
কী মনে হল, তৎক্ষণাৎ বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেলাম। কিন্তু যাব কোথায়? সে কথা মনে হতেই থমকে দাঁড়ালাম। এবার? ফুটপাথ ছাড়া তো গতি নেই! অন্যমনস্কভাবে হেঁটে চলেছি। তা হলে কি হস্টেলেই ফিরে যাব? ...কতক্ষণ হেঁটেছি মনে নেই। একটা ঠান্ডা হাতের ছোঁয়ায় সংবিৎ ফিরল।
–‘‘অনেক রাত হয়েছে। চল এবার।’’
–‘‘কোথায় যাব?’’
–‘‘আমার বাড়ি।’’
–‘‘মা জানতে পারলে?’’
–‘‘তাড়িয়ে দেবে।’’
–‘‘তা হলে?’’
–‘‘আজ তো চল। অনেক হেঁটেছি। তোর সঙ্গে আর পারছি না।’’
শুরু হল সংগ্রাম। টিউশন করতাম। একদিন ঘরের সামনে কিছু মাটি দেখে কী মনে হল তৈরি করে ফেললাম অনেক ছোট ছোট পুতুল। বিক্রি হয়ে গেল সব। সেই টাকা পিসিকে দিয়ে আরও মাটি কিনলাম। আবারও অন্য মূর্তি। আসলে আমার বাবা ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। কিন্তু মূর্তি বানানো তাঁর নেশা ছিল। মায়ের সঙ্গে এই জায়গাতেই তাঁর মেলেনি। বাবার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হলেও তাঁর এই নেশা আমাকে ছাড়েনি। আমি এখন মূর্তি বানাই। আমি আপনাদের অনেক সময় নিয়ে নিয়েছি।আর একটা কথা বলে শেষ করব। সবাইকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, প্রফেসর হতে হবে কেন? কেউ যদি একটু অন্য রকম হতে চেষ্টা করে ক্ষতি কী? আজ কিন্তু আমার মা আমার সঙ্গেই থাকে।’’
কিছুক্ষণের জন্য নিঃশব্দ। তার পর হঠাৎই গোটা স্টেডিয়াম ফেটে পড়ল হাততালিতে। চমকে উঠল নন্দিনী। আস্তে আস্তে স্টেজ থেকে নেমে এলো। এতদিনের জমানো ব্যথা, কথা— সব নিঃশেষ করে তার কেমন হালকা লাগছিল। সে বেরিয়ে এলো সেই ভিড় থেকে। কে যেন গান গাইছে! তবে তার কানে পরিষ্কার ভাবে কিছুই ঢুকছে না। সে হেঁটে চলেছে নীরবে। তার চোখ দিয়ে অঝোর ধারা। মেঘ ডাকার আওয়াজে তার ঘোর ভাঙল। সে খেয়াল করল, সকালের সেই পথ দিয়েই সে হেঁটে চলেছে। কিন্তু এখন তার একটুও ভয় করছে না। এত বছর বাদে সে হয়তো সাবালিকা হল! দৌড়ে ফিরতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ল সে। তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল তীর্থঙ্কর। বৃষ্টির দাপট ক্রমশ বাড়ছে। তারা হোটেলে ফেরার রাস্তা ধরল। মাটির রাস্তায় জল জমে যাচ্ছে। বারবার পা পিছলে যাচ্ছে। তীর্থঙ্কর জোর করে তাকে বুকের মধ্যে টেনে নিল। তার কাঁধ চুমুতে ভরিয়ে দিল।
নন্দিনীর কানের কাছে মুখ এনে বলল, ‘‘প্লিজ, অনুমতি দাও।’’
তীর্থঙ্করের বুকে নিজেকে ছেড়ে দিল নন্দিনী।
সে জানত, জ্বর তার আসবেই। তবে এটা জানত না, তার জ্বর কমাতে কাউকে সারারাত ধরে জলপটি দিয়ে যেতে হবে। ঘুম যখন ভাঙল, দেখল, তার মাথার বালিশে মাথা রেখে ঘুমিয়ে রয়েছে সে। এমন সময় দরজায় ধাক্কা দিল কেউ। সেই আওয়াজে
তীর্থঙ্করের ঘুম ভেঙে গেল। বিছানা থেকে উঠে পড়ল।
–‘‘কী ম্যাডাম? ঘুম ভাঙল তা হলে!’’
–‘‘কী এমন রাত এখন!’’
–‘‘তা তো বটেই।’’ হাসল তীর্থঙ্কর।
–‘‘স্যর, চা না কফি?’’
–‘‘একদম ব্ল্যাক কফি।’’
–‘‘আচ্ছা স্যর। ম্যাডাম?’’
–‘‘এক যাত্রায় কি পৃথক ফল হয়? —কী ম্যাডাম?’’
* * *
বেলা বারোটা নাগাদ তারা বেরিয়ে পড়ল।ঘণ্টা দুয়েক লাগবে তাদের বাগডোগরা পৌঁছতে। রাস্তার দু’ধারে অসাধারণ প্রকৃতি চোখ জুড়িয়ে দেয়। নন্দিনীর জন্য তীর্থঙ্কর একটা আলাদা গাড়ি নিয়েছে। নন্দিনীর খুব দুর্বল লাগছে। তীর্থঙ্করের বুকে সে লুটিয়ে পড়ে রয়েছে। তীর্থঙ্কর বলল, ‘‘তোমাকে নিয়ে জয়ন্তী যাওয়ার খুব ইচ্ছে ছিল। হল না।’’
–‘‘তাতে কী? পরের বার নিশ্চয় হবে।’’
তার বুকের মধ্যে আরও নিবিড় হল নন্দিনী।
ঝামেলার কাজগুলো মিটিয়ে এয়ারপোর্টের ভেতরে ঢুকে তারা দেখল, অনিবার্য কারণে আজ প্লেন লেট! কলকাতা পৌঁছতে তাদের সন্ধে হয়ে গেল।
–‘‘আজ কি বাড়ি ফিরতেই হবে?’’
–‘‘না, তেমন কিছু নয়।’’
–‘‘তা হলে আজ রাতটা আমার বাড়িতে কাটিয়ে যাও।’’
–‘‘কিন্তু—!’’
–‘‘কিন্তু কীসের? কাল যে ভাবে জ্বর বেড়েছিল তোমার, একদম ইচ্ছে নয় তুমি আমাকে ছেড়ে যাও।’’
–‘‘তোমার বাড়িতে?’’
–‘‘অনেক লোক। মা, সুবীর কাকা আর—।’’
–‘‘বুঝেছি।’’
–‘‘কী হল? তা হলে আজ আমার বাড়িতে তো?’’
–‘‘কী আর করা? কর্তার যখন ইচ্ছা!’’
গাড়িটা একটা পুরনো বিশাল বাড়ির সামনে দাঁড়াল। নন্দিনী অবাক হয়ে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘‘কলকাতা শহরে এখনও এত বড় বাড়ি আছে!’’
–‘‘নন্দিনীদের জন্য কত কিছুই থাকে, তা কি আর নন্দিনীরা চোখ মেলে দেখে?’’
–‘‘সারাদিন বাজে বকা!’’
–‘‘এসো।’’
তীর্থঙ্কর হাত ধরে নন্দিনীকে সদর দরজা পার করাল।বাড়ির অন্দর মহলে সন্ধের শাঁখ বাজছে।ঠাকুর দালানে দুর্গা প্রতিমার কাঠামোটা দাঁড় করানো রয়েছে।নন্দিনী এগিয়ে গেছে সেদিকে।পাশেই অনেক মাটি।নন্দিনী মাটি তুলে নিয়ে আপন মনে ঠাকুরের গায়ে প্রলেপ লাগাতে শুরু করল। হঠাৎ একটা শান্ত শীতল হাতের স্পর্শে ঘোর ভাঙল তার।পিছন ফিরে দেখল, সাদা শাড়ি পরা আর এক দুর্গা!দূরে দাঁড়িয়ে তীর্থঙ্কর।হাসিমুখে বলছে, ‘‘তা হলে তোমার কালো বউমা পছন্দ তো মা?’’

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন