সোনালি-দুঃখ আসলে ত্রিস্তান ও সোনালীর কাহিনী। পশ্চিম জগতে একটি প্রখ্যাত প্রেমের কাহিনী।
দেবাশিস কর্মকার
‘আকাশের সূর্য আছে যতদিন/তুমি তো আমারাই আর কারও নয়।/রাত ছাড়া চাঁদ নেই নদী ছাড়া ঢেউ/তুমি কার জানো না তো আমি ছাড়া কেউ।’
২০১৮ সালের মাঝামাঝি সময় হাতে এসে পড়ল আমার সন্ধানে থাকা একটি বই। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা ‘সোনালি-দুঃখ’। আমরা, যারা নব্বয়েইর দশকে কলেজের ছাত্র ছিলাম, এই বইটি তাদের কাছে খুব প্রিয় ছিল। প্রেমিক লেখক সুনীলের এই রোমান্টিক উপন্যাস বুকে প্রেম জাগাতো, হৃদয় রক্তাক্ত করত। জাহাজ যেমন বন্দরে নোঙর করে, আবার কোথায় চলে যায়, জানা যায় না, তেমনই ‘সোনালি-দুঃখ’র একটি কপি আমার হাতে এসে আবার চলে গিয়েছিল। কিন্তু দাগ রেখে গেছিল। বহুকাল সেই বইটি আবার ফিরে পাওয়ার অপেক্ষা থেকেছি। কলেজ স্ট্রিটে বা বইমেলায় গিয়ে খোঁজ করব ভেবেছি, কিন্তু নানা কারণে তা আর হয়ে ওঠেনি। অফিসে পুরানো বই নিয়ে আসা পরিতোষদার কাছে বইটি পেয়ে আর হাতছাড়া করিনি।
সেই বইয়ের ১৪২ পৃষ্ঠায় পেন্সিলে শুরুতে উল্লেখ করা বাংলা গানের এই পঙক্তিগুলি লেখা ছিল। যতদূর সম্ভব কোনও কিশোরী প্রেমিকার হস্তাক্ষর। প্রতিটি বর্ণে প্রেম ঝড়ে পড়ছে। ‘সোনালি-দুঃখ’র প্রথম প্রকাশ ১৩৭২ বঙ্গাব্দের অগ্রাহয়ণে। আমার হাতে যে বইটি এসেছে সেটি ত্রয়োদশ সংস্করণ। এর প্রকাশ ১৪১৪ বঙ্গাব্দের জৈষ্ঠ মাসে। এর মূল্য ছিল পঁয়তাল্লিশ টাকা। প্রকাশক অরুণা প্রকাশনী। ১৪৪ পৃষ্ঠার বই। পুরোটাই অক্ষত অবস্থায় আমার হাতে আসে।
পুরানো বইয়ের সংগ্রাহকরা পুরানো বই কেনার সময় অনেক গুলি বিষয়ে নজর দেন। তবে আমাকে আকৃষ্ট করে দু’টি বিষয়– বইটি কে, কাকে, কি উদ্দেশে প্রদাণ করেছে এবং দ্বিতীয়ত হল বইটিতে পাঠকের বাছাই করা জায়গায় দাগ দেওয়া বা পাতায় কিছু নোট। তাতে সেই অজ্ঞাত পাঠকের সঙ্গে আমার একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেই পাঠককে আমি কল্পনা করার চেষ্টা করি।
বইটির একটি পাতায় সুনীলের লেখা কয়েকটি লাইনের নীচে পেন্সিলে দাগ দিয়ে রেখেছিলেন পাঠক– ‘এ গান শুনলে, যে দুর্বল সে আবার শক্তি ফিরে পায়। ভালোবাসায় যার অবিশ্বাস এসেছে, সে আবার ভালোবাসায় বেঁচে ওঠে। যার জীবনে কখনও ভালোবাসা জাগেনি, এ গান শুনলে সেই পাথরের বুক ভেদ করে বেরিয়ে আসে ঝরনা। এই ভালবাসার গান শুনলে মানুষ মরতে ভয় পায় না। ভালবাসা ছাড়া জীবন হয় না, যেমন দুঃখ ছাড়া ভালোবাসা হয় না! ভালোবাসার জাত নেই, গোত্র নেই, ধর্ম নেই।’ সুনীলের এই বইটিও সেই গানের মতোই।
সোনালি-দুঃখ আসলে ত্রিস্তান ও সোনালীর কাহিনী। পশ্চিম জগতে একটি প্রখ্যাত প্রেমের কাহিনী। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নিজে বইয়ের পশ্চাৎভূমিকায় লিখেছেন– ‘অনেকের মতে, ভালোবাসার প্রগাঢ়তায় ও বৈচিত্র্যে এই কাহিনীটি এ পর্যন্ত শ্রেষ্ঠ। মধ্যযুগে আমাদের দেশে যখন রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের কাহিনীর সূত্রপাত, সেই সময়ে, পৃথিবীর অপর খণ্ডেও এক ধরণের প্রেমের বর্ণাঢ্য রচনা শুরু হয়– যাকে বলা হয় ‘কোর্টলি লাভ’– সেই সব উপাখ্যানেও, নায়ক-নায়িকার মধ্যে বিবাহ সম্পর্ক নেই– অবৈধ পরকীয়া প্রেম। নায়ক অনেক সময়েই নায়িকার অন্য সূত্রে আত্মীয়। এই সব প্রেম কাহিনীর নায়ক উদার, একনিষ্ঠ, বিপদ তুচ্ছ করা।
রাধা ছিলেন কৃষ্ণের মামীমা, সোনালিও ত্রিস্তানের তাই। মূমূর্ষু ত্রিস্তানকে জলে ভাসিয়ে দেওয়া– যেন লখীন্দরের কথা মনে পড়ে, যদিও সঙ্গে বেহুলা নেই, এবং ত্রিস্তান সম্পূর্ণ মরেনি– তবু কেন যেন মনে পড়ে। সোনালীর সতীত্বের পরীক্ষার সঙ্গে সীতার অগ্নিপরীক্ষার স্পষ্ট মিল– যদিও ওদেশে সতীত্বের আদর্শ ভিন্ন প্রকার। নারী ও পুরুষের মাঝখানে উন্মুক্ত তরবারি রেখে শোওয়া যে পবিত্র সম্পর্কের প্রতিক, এ ধারণা আমাদের দেশে রাজস্থানেও প্রচিলত।’
সুনীলের এ রচনা কোনও বিশেষ কবির ভাষার অনুবাদ নয়। প্রথম ত্রিস্তানের কাহিনী পড়ে মুগ্ধ হয়ে তিনি অন্যান্য কবিদের রূপান্তর পড়তে শুরু করেন। তারপর তাঁরও সখ হয় ত্রিস্তানের কহিনীর একটি নিজের ভাষ্য তৈরি করার। লিখে ফেলেন ‘সোনালি-দুঃখ’।
এই বইটি এই সময় পাতা ওল্টাতে গিয়ে ১৩০ পৃষ্ঠার চোখ আটকে গেল। সেখানেও কয়েকটি লাইনে নীচে পেন্সিলের দা। লাইনগুলি এই– ‘সোনালি, ভালোবাসা কি শুধু রূপে? আজ আমার বাইরের রূপ দেখে তোমার ঘৃণা? আমি কি শুধু রূপের জন্য তোমায় ভালোবেসেছিলুম? তবে, তোমার বাবা যখন তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন– আমি কেন তখুনি বিয়ে করিনি? আমি তো তখুনি তোমায় নিয়ে অন্য দেশে পালিয়ে যেতে পারতুম। সোনালি, ভালোবাসা চামড়ার নীচে থাকে। ওপরে নয়। সেই ভালোবাসার জন্যই আমি তোমাকে ছাড়ি অন্য কোনও নারীকে স্পর্শ করতে পারিনি।’
আচ্ছা এমন কি হতে পারে না, কোনও প্রেমিক প্রত্যাখাত হয়ে কোনওভাবে তার স্বপ্নে দেখা প্রেমিকার কাছে পৌঁছে দিয়েছিল বইটি। আর সেই প্রেমিকা কোনও কারণে সেই প্রেমকে স্বীকার করতে না পেয়ে ‘সোনালি-দুঃখ’ নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছিল ‘আকাশের সূর্য আছে যতদিন...’ এই একটি ছোট্ট নোট লিখে!
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন