আনন্দময় : নন্দিতা মিশ্র চক্রবর্তী

সবে দিনের আলো ফুটছে। ভোরের রবির কিরণে এখনও রং ধরেনি। কোমল আর ম্লান একরকম আলো এসে পড়েছে গুহায়। এই সময়টি শ্রমণের ধ্যানের সময়। তবে আজ তিনি ধ্যান করছেন না। 

আনন্দময় : নন্দিতা মিশ্র চক্রবর্তী

এক বৃদ্ধ শ্রমণ বসে আছেন বিরাট একটি গুহার কন্দরে। তিনি শাক্য বংশের সন্তান। বুদ্ধ ও নন্দ ছিলেন তাঁর জ্ঞাতি ভ্রাতা। বুদ্ধের ভ্রাতা নন্দের থেকে সামান্য বয়সে বড় তিনি। উজ্জ্বল গৌরবর্ণ শরীর তাঁর। বয়সের ভারে ত্বকে এসেছে বলিরেখার আঁকিবুকি, তবে এখনও বেশ সৌম্যদর্শন তিনি। সুঠাম শরীরের গঠন, তবে এখন লাঠি ছাড়া চলা ফেরায় সমস্যা হয়। চলার সময় সামান্য সামনে ঝুঁকে চলেন তিনি। দৃষ্টিশক্তি এখনও প্রখর তাঁর, আর এখনও প্রবল স্মৃতিধর। একসময় বুদ্ধের সমস্ত উক্তি যাকে ভিক্ষুরা বলেন সুত্ত, সে সবই কন্ঠস্থ ছিল তাঁর। বুদ্ধ তাঁকে অক্ষয়শ্রুতিধর বলতেন। তিনি একবার যা কানে শোনেন তা কখনও বিস্মৃত হন না।

সবে দিনের আলো ফুটছে। ভোরের রবির কিরণে এখনও রং ধরেনি। কোমল আর ম্লান একরকম আলো এসে পড়েছে গুহায়। এই সময়টি শ্রমণের ধ্যানের সময়। তবে আজ তিনি ধ্যান করছেন না। তাঁর মন আজ কিছুতেই বিচ্ছিন্ন হতে পারছে না। একটি স্বপ্ন তাঁর চেতনাকে কিছুটা বিক্ষিপ্ত ও চিন্তিত করে তুলেছে। এই স্থানটি রাজগৃহের সপ্তপর্ণী গুহা। আদতে এই গুহাটি রাজগৃহের কোনও প্রাকৃতিক গুহা নয়। রাজা ও শ্রেষ্ঠীদের বদান্যতায় একদিকের পার্বত্য দেওয়ালের অপরদিকে চুন সুরকি দিয়ে একটি পাথরের দেওয়াল এবং মাথার উপরে চেটালো ছাদ তৈরি করে একটা বেশ প্রশস্ত পরিসর তৈরি করে দেওয়া হয়েছে, যাতে ভিক্ষুরা শীত গ্রীষ্মের হাত থেকে রক্ষা পায়। এই গুহার একদিকে একসময় একটি সুবিশাল সপ্তপর্ণী বা ছাতিমগাছ ছিল। তার ডালপালা ছিল এতটাই বিরাট যে তার এক একটিই যেন এক একটি দেওয়াল। বুদ্ধও এই গাছের ছায়ায় তপ্ত নিদাঘ দিনে বসে বিশ্রাম করতেন। এখন আর সেই ছায়াদায়ী গাছটি বেঁচে নেই, তবে গুহার নামটি হয়ে গেছে সপ্তপর্ণী। রাজগৃহের অসংখ্য স্থান এখনও বুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত। তপোদার উষ্ণপ্রস্রবণে তিনি নিয়মিত স্নান করতেন একসময়, রাজবৈদ্য জীবকের নির্দেশে।

তখন দিনগুলিতে ছিল কত ঘটনার ঘনঘটা! একবার দেবদত্ত বুদ্ধকে হত্যা করতে পাহাড়ের উপর থেকে বিশাল একটি পাথরকে ঠেলে নিচে গড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু কালশিলা পর্বত বুদ্ধের বহুকালের ধ্যানসাধনার সাক্ষী। সে তার প্রিয় পুত্রের প্রাণ রক্ষা করতে বুদ্ধের দিকে ধেয়ে আসা পাথরটিকে নিজের বুকে ধারণ করে রেখেছিল! তবে একটা তীক্ষ্ণ পাথরের টুকরো এসে বুদ্ধের পায়ের আঙুলে আঘাত করেছিল। বুদ্ধের শরীর তখন বেশ দুর্বল। আগে থেকেই অসুস্থ ছিলেন তিনি। তাঁর পা থেকে অনেক রক্তপাত হয়। ভিক্ষুরা তাঁকে ধরাধরি করে পাশের বিশ্রাম কুটীর মদ্রকুক্ষিতে নিয়ে যান। রক্ত তবুও বন্ধ না হওয়ায়, বুদ্ধকে নিয়ে যাওয়া হয় জীবকের আম্রকুঞ্জে। জীবক বেশি রক্তপাত দেখে দ্রুত বুদ্ধের পায়ে নানা গাছপালার নির্যাস সমৃদ্ধ একটি বাঁধন বেঁধে দেন এবং তাতে ক্ষতের দ্রুত উপশম হয়।

একবার তো যুক্তি করে এক মত্ত হাতিকে দেবদত্তের নির্দেশে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল রাজপথে। ঠিক যখন বুদ্ধ তপোদার উষ্ণ জলে স্নান সেরে বেণুবনে ফিরছিলেন, তখন। সেই হাতির নাম ছিল নালাগিরি! সুবিশাল নীলমেঘের মত ছিল তার বিশাল শরীর, যেন গিরিরাজ! বুদ্ধের মৈত্রীচিত্ততা সেই মত্ত হাতির মনকে মুহূর্তে শান্ত করে দিয়েছিল! কত স্মৃতি! এ জীবন বুদ্ধের জন্য নিবেদিত করেছিলেন। নিবেদনেই তাঁর প্রাণের শান্তি। কখনও নিজের কথা, এমনকী নিজের নির্বাণলাভের জন্য ধ্যান অনুশীলন করার কথাও ভাবেননি তিনি। কেবল গুরুর সেবা ও তাঁর প্রতি কর্তব্যই ছিল তাঁর একমাত্র কাজ। সেইসব দিন কোথায় বাষ্পের মতো হারিয়ে গেছে। বড় কঠিন সময় এসেছে এখন। প্রবীণ শ্রমণটিই হলেন বুদ্ধের প্রিয় শিষ্য ও ব্যবস্থাপক আনন্দ। বর্তমানে বৌদ্ধসংঘের প্রধান আচার্য তিনি।

পুরনো দিনের মত দিনগুলো আর নেই। মহাকাশ্যপের দেহত্যাগের পর সদ্ধর্মের প্রতি সাধারণের মনে এখনও বিরাগ নেই যদিও, তবে বুদ্ধের অভাবে সবার উৎসাহেই যেন ভাঁটা লক্ষ্য করছেন আনন্দ। ভিক্ষুরাও এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি পরিশ্রম-বিমুখ হয়ে পড়েছেন। অন্যদিকে অগণন সংখ্যা বেড়ে চলেছে তীর্থিকদের। তারা আগে ধর্মের শত্রু ছিলেন না। বুদ্ধের সঙ্গে সবার বেশ সদ্ভাব ছিল। যদিও তাঁরা শ্রমণদের দোষত্রুটি খোঁজার চেষ্টা তখনও করতেন, কিন্তু এখন! শ্রমণদের উপর সর্বদাই কলঙ্ক লেপনের জন্য তারা যেন সংকল্পবদ্ধ হয়ে উঠেছেন! এ কেমনধারা বৈরীভাব?

বুদ্ধের পরিনির্বাণের পর বহু বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। ধর্মকে আরও একশো-দেড়শো বছর রক্ষা করে সমস্ত ঝড় ঝাপটা সামলে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। বুদ্ধের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী অনাগত ভবিষ্যতে আসবেন একজন মহান রাজা। তিনি সুদর্শন নন, তাঁর ত্বকের স্থানে স্থানে থাকবে চর্মরোগের চিহ্ন, তিনি কৃষ্ণবর্ণ, খর্বাকৃতি। তাঁর স্থূল শরীরে উদরদেশ হবে বিসদৃশ। বৌদ্ধ থেরগণ তাই তাঁর নাম রেখেছেন, পিয়দস্সী। তিনি প্রিয়দর্শী নন বলেই বুঝি তাঁর নাম এমন। অথবা হয়তো তাঁর অন্তর জাগ্রত তাই তিনি পিয়দস্সী। তবে তিনি অতি সৌভাগ্যবান, ইনিই মৃতপ্রায় ধর্মকে বিশ্বের সর্বত্র প্রতিষ্ঠা করবেন। বুদ্ধের করুণায় আনন্দ এতটা কাল রক্ষা করে এসেছেন ধম্মকে। এরপর যোগ্য কারো হাতে দায়িত্ব দিয়ে তবেই হবে তাঁর ছুটি।

আজ বুদ্ধ তাঁর ধ্যানে এসে কেন বলে গেলেন আবার ধম্মকে এক কঠিন পরীক্ষা দিতে হবে জনসমক্ষে? এর অর্থ কী? রাজা তো সদ্ধর্মের বিরোধী নন। তবে আর কাকে পরীক্ষা দিতে হবে ভিক্ষুদের?

আনন্দ ভুলতে পারছেন না, বুদ্ধের সেই করুণাঘন মূর্তিটি। গলিত স্বর্ণের মত উজ্জ্বল তাঁর শরীরটি। যেন জীবন্ত রূপই ধারণ করেছিলেন প্রভু। তিনি এসে বললেন,

“কলহ বিষবৎ। মনে রোখো সঙ্ঘে তোমার কারণে যেন কখনও কোনও বিবাদ না আসে। সেই ঝড়ে ধর্মের বিপর্যয় এলে রক্ষা করার মত অর্হৎদের সংখ্যা এখন অতি নগন্য। এই অবস্থায় সবার ভেতর শান্তিরক্ষাই হল শ্রেষ্ঠপন্থা। মনে আছে আনন্দ? আমার পরিনিব্বাণের পরে আমার অস্থি নিয়ে কেমন বিবাদের সূত্রপাত হয়েছিল? এবারে কিছুতেই যেন সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয়! কয়েকদিনের ভেতর সঙ্ঘে আসছে প্রবল এক ঝড়। সাবধান!”

বুদ্ধমূর্তিটি মিলিয়ে যাওয়ার আগে তাঁকে ইঙ্গিত করে গেল সামনের দিকে। আনন্দ সেদিকে তাকিয়ে দেখতে পেলেন অনন্ত নক্ষত্রবীথি। শতসহস্র নক্ষত্র খচিত আলোকিত এক পথ সুদূর অনন্তের দিকে যাত্রা করেছে। আনন্দ উপলব্ধি করলেন, এই সেই পথ! এই পথেই ফিরে যেতে হবে তাঁকে। আনন্দ বুঝতে পেরেছেন তাঁর দেহত্যাগের সময় আসন্ন।





মগধরাজ অজাতশত্রুর রাজসভা। রাজা পারিষদবর্গ-বেষ্টিত হয়ে বসে আছেন। তাঁর কপালে চিন্তার ছায়া। মৃগী রোগের প্রকোপ ভয়ানক বৃদ্ধি পেয়েছে রাজার। রাজবৈদ্য জীবক নিরুদ্দেশযাত্রা করেছেন বহুকাল হয়েছে। এখন তাঁর অভাব প্রতিটি মুহূর্তে অনুভব করছেন অজাতশত্রু। তাঁর কাছে সব আছে। ধনরত্ন, ক্ষমতা, প্রাচুর্য, ঐশ্বর্য, সুন্দরী নারী, সুবাসিত আসব ও সুরা ইত্যাদি ভোগের সমস্ত উপকরণ উপস্থিত। কিন্তু নিজের ভগ্ন-স্বাস্থ্যের কারণে সবকিছুই যেন ব্যর্থ! এখন কে বলে দিতে পারবে রাজবৈদ্য কোথায় আছেন? তিনি কি জীবিত আছেন? যদি জীবিত থাকেন, একটিবার তাঁর চিকিৎসা পেলে তিনি আবারও সুস্থ হয়ে উঠতে পারবেন। জীবকের মতো যোগ্যব্যক্তি সমস্ত বিশ্বে বিরল। চিকিৎসক তো কতই আছে। একটি ঘটনায় বৌদ্ধ শ্রমণদের উপর অজাতশত্রু বেশ বিরক্ত হয়েছেন। শাণবাসিক নামক একজন তরুণ ও বিদ্বান ভিক্ষুকে তিনি জীবকের বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন। ভিক্ষু রাজসভায় এসে বিরক্ত গলায় বলেছিল,

“ভিক্ষুর লক্ষ্য হল কেবল সর্বদা সপ্তধাপ বিশিষ্ট ধ্যানে লগ্ন থাকা। তাঁরা জ্যোতিষীদের মত গ্রহের অবস্থান নির্ণয় করেন না। প্রকাশ্যে আসতে অনিচ্ছুক কোনো ব্যক্তির অবস্থান জানা আমার সাধ্যাতীত।”

সংঘে প্রবেশের আগে শাণবাসিক শ্রাবস্তী নগরের এক অত্যন্ত ধনী ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান ছিলেন। জেতবনে আনন্দের কাছে ধর্মব্যাখ্যা শুনে শাণবাসিক ভিক্ষুসংঘকে নিজের বাড়িতে রেখে সেবা করতে চেয়েছিলেন। আনন্দ তাতে সম্মতি দিয়েছিলেন। পরদিন শাণবাসিকের ব্যবস্থায় সবাই অবাক। শাণবাসিক বহু সংখ্যক রথের ব্যবস্থা করেছেন। যাতে ভিক্ষুরা সকলে নগরপ্রান্তে তাঁর বাড়িতে বিনা বাধায় পৌঁছাতে পারেন। তারপর পাঁচ বছর ধর্মের সেবা করেছিলেন তিনি। দায়িত্ব নিয়েছিলেন সংঘের সমস্ত ভিক্ষুদের ভরণপোষণের। পরবর্তীকালে তিনি উপসম্পদা ও প্রব্রজ্যা লাভ করে সংঘের একজন বিশিষ্ট পণ্ডিত ভিক্ষু হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।

আনন্দময় : নন্দিতা মিশ্র চক্রবর্তী

এই শাণবাসিকের কথায় ক্রুদ্ধ হয়েছেন রাজা। এতবড় সাহস! আমারই অন্ন ও বস্ত্রে প্রতিপালিত হয়ে আমার সামনে এসে আমাকেই অস্বীকার করছে এক সামান্য ভিক্ষু! সাধারণ কেউ হলে তাকে এখনই শূল-দণ্ড দিতেন তিনি। কিন্তু কোনও ভিক্ষুকে শাস্তি দেওয়া শোভন নয়। তাছাড়া তা মহাপাপও বটে। অজাতশত্রু এখন আর বেশিক্ষণ ভাবতে পারেন না। সামান্য ক্রোধেই এখন তাঁর শরীর আচ্ছন্ন লাগতে থাকে। ক্রমে তাঁর চেতনা লুপ্ত হল। পরিচারকেরা দ্রুত এসে রাজাকে ঘিরে ধরল। অজাতশত্রু আবার সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছেন।

এই রোগটি অজাতশত্রুর শুরু হয়েছিল প্রথম বুদ্ধের পরিনির্বাণের খবর পাওয়ার সময় থেকে। পরম মানসিক ভরসার মানুষটির দেহরক্ষার খবর শুনেই তিনি সংজ্ঞাহারা হয়ে পড়েছিলেন। তখন জীবকের নির্দেশে ঊশিরমূল, পোড়া বাসকপাতা ও কাঁচা এবং গেঁজিয়ে ওঠা তামাকপাতার ঘ্রাণ আহরণ করিয়ে এবং শীতল ও উষ্ণ জলে পরপর অবগাহন করিয়ে রাজার সংজ্ঞা ফেরানো হয়েছিল। সেই শুরু। রাজার রোগ ধীরে ধীরে বেড়ে চলেছে। অজাতশত্রু বর্ষকারকে বললেন,

“শোনো বস্সকার! আমরা ক্ষত্রিয়, তাই আমাদের মান একবার আহত হলে আমরা তার প্রতিশোধ নিয়ে থাকি। শ্রমণ গৌতমের শিষ্যদের কেমন করে অপমানিত ও লাঞ্ছিত করা যায় এখন তার উপায় বলো। শাণবাসিকের স্পর্ধা শুধু একার নয়, থের আনন্দও তাঁকে এই স্পর্ধিত বাক্য বলতে অনুপ্রাণিত করেছেন। তুমি এ বিষয়ে এমন উপায় বলবে, যেন কেউ বলতে না পারে, শ্রমণ গৌতমের শরণ-গমন উপাসক হয়েও অজাতশত্রু নিজে উদ্যোগী হয়ে তাঁর শিষ্যদের মগধ থেকে বিতাড়িত করছেন। কিন্তু এমন চাল চালবে যাতে ভিক্ষুরা নিজেরাই মগধ ছেড়ে পালায়। তোমার উপর আমার অনেক ভরসা। তোমার জন্যই আমি বৈশালি জয় করতে পেরেছি। মনে আছে কী সুচতুর কৌশলে তুমি বৈশালীর গণরাজাদের মধ্যে কলহের সূত্রপাত ঘটিয়েছিলে? তারফলেই বৈশালী দখল করেছিলাম আমি। শেষে রাজ্য ফিরিয়ে দিলেও বিপুল ধন উপঢৌকন নিয়েছিলাম আর গঙ্গাবক্ষের সকল বাণিজ্যপোতগুলির করও যে কেবল মগধরাজের হাতে আসে, তা-ও তোমারই কৃতিত্বে। তোমার ঋণ আমি আজীবন মনে রাখব! এছাড়া বন্দরে কর বসিয়ে দূরদেশের জাহাজগুলো থেকে মণিরত্নাদিলাভও কেবল তোমারই তীক্ষ্ণ বুদ্ধির ফল। এখন যে এত অর্থ ও সম্পদ উদ্বৃত্ত হচ্ছে রাজকোষে তার কারণও হলে তুমি। ধন্য তোমার বুদ্ধি!”

“শুনুন রাজা! শাক্যমুনি গৌতমের শিষ্যদের মধ্যে গুণী ও জ্ঞানী শিষ্যদের সংখ্যা এখন প্রায় হাতে গোনা। বেশিরভাগ গৌতমের শিষ্যরা এখন হলেন অজ্ঞানী এবং বাচাল। এদের বিতর্ক ও জাদুশক্তির মাধ্যমে সবার সামনে একবার পরাস্ত করলেই গৌতমের শিষ্যরা লজ্জায় কীটের মতো মাটিতে মিশে যাবে। তার্কিকরাই এরপর বিদ্রূপ করে করে তাঁদের দেশ ছাড়া করে দেবে। তার্কিক তীর্থিকদের বশ্যতা স্বীকার করাতে পারেন একমাত্র থের আনন্দ। তবে তিনি বয়সের ভারে ন্যুব্জ, শক্তিহীন। সপ্তপর্ণী-গুহার বাইরে বেরই হন না। কখনও ভিক্ষায় পর্যন্ত বের হন না। বালক শ্রামণেররা এসে তাঁর খাদ্য রাজপুরী থেকে সংগ্রহ করে নিয়ে যায়। এ অবস্থায় আপনি দাক্ষিণাত্যের তীর্থিকদের রাজ্যে আহ্বান জানান রাজা! আপনার উদ্দেশ্য সফল হবেই।”

“বাহ্! অতি উত্তম প্রস্তাব। তাহলে এখনই একজন তীর্থিক বা কোনও বিশিষ্ট তার্কিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁকে আমার সভায় নিয়ে এসো। গৌতমের শ্রমণদের সঙ্গে তীর্থিকদের বিতর্ক শুনতে আমি নিজে উপস্থিত থাকব। বিজয়ীকে নিজে হাতে জয়মাল্য পরিয়ে পুরস্কৃত করব আমি।”

তীর্থিকদের জন্য বিম্বিসারের সময় থেকে ময়ূর-উপবনে একটা আরাম তৈরি করে দেওয়া হয়েছিল। সেখানে বিশিষ্ট তীর্থিকদের মধ্যে সর্বক্ষণ আলাপ আলোচনা চলে। বিশেষত যে কোনও তর্কে তাঁদের পরাজিত করা সুকঠিন। দাক্ষিণাত্যের কাম্পিল্য নগর থেকে তীর্থ পর্যটন করে সদ্য ফিরেছেন তীর্থিক ভরদ্বাজ। বর্ষকার যখন উপস্থিত হলেন ময়ূর-উপবনে, তখন জয়ধ্বনি শুনলেন। সকলেই বলছে জয়! ভরদ্বাজের জয়! কে এই ভরদ্বাজ? বর্ষকার উপবনে প্রবেশ করেই প্রশ্ন করলেন, আপনাদের “মধ্যে ভরদ্বাজ কে?”

সবার মধ্যে একজন দীর্ঘকায় ব্রাহ্মণ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,

“আমিই ভরদ্বাজ।”

তারপর হঠাৎ হাত শূন্যে তুলে একটা চম্পক পুষ্পের মালা এনে বর্ষকারকে পরিয়ে দিলেন। বর্ষকার চমকিত হলেন। বললেন,

“বাহ্! বেশ বেশ। তা আরও কী কী বিদ্যা অর্জন করেছেন।”

“আজ্ঞে আমি জড় ও চেতন দু প্রকার বস্তু, যা বলবেন আপনার সামনে এনে উপস্থিত করতে পারি।”

বর্ষকার হাসলেন। বললেন– “যেমন?”

সঙ্গে সঙ্গে ভয়ানক শোঁ শোঁ শব্দ হতে লাগল, তারপর প্রবল বাতাসের সঙ্গে কোথা থেকে যেন ছুটে এল একপাল বন্য হাতি। তারা শূঁড় তুলে বর্ষকারের দিকে ছুটে এল। বাকি তীর্থিকেরা সবাই দল বেঁধে তখন পালাতে আরম্ভ করল। বর্ষকার চিৎকার করে বলে উঠলেন, “রক্ষা করো।” ভরদ্বাজ তাঁর হাতটা তুলতেই কোথায় সেই ভয়ানক হাওয়া? আর কোথায় বা বন্য হাতির দল! সব উধাও হয়ে গেল।

বর্ষকার বললেন, “এ তো পরম আশ্চর্য ঘটনা! এ সব আপনি শিখলেন কী করে?”

“সবই মায়া আর জাদুবিদ্যা। এর জন্য বহুকাল প্রেতসাধনা করেছি। দিনের পর দিন তীর্থে তীর্থে ঘুরে ফিরেছি মন্ত্রসাধনের জন্য। তারপর এসেছে সিদ্ধি।”

“আপনাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি মগধরাজ অজাতশত্রুর পক্ষ থেকে, রাজসভার উদ্যানে আপনার জাদুবিদ্যা দেখানোর জন্য। আমার মনে হয়, শ্রমণ গৌতমের শিষ্যরা এই শক্তির ধারে কাছে কেউ আসতে পারবে না। এ সব তাঁরা দেখলে ভীষণই অবাক হয়ে যাবে!”

“ঠিক বলেছেন! আমার ইচ্ছে তাঁদের সামনেই এই প্রদর্শণীর আয়োজন করা হোক।”

“আর যদি তাঁদের শ্রেষ্ঠতার পরীক্ষা নিতে বলি?”

“অবশ্যই। সবার মাঝে আমিই শ্রেষ্ঠ!”

“তাহলে আপনার আহ্বানও তেমন করেই করা উচিত!”

“আমি ভাবছি বৌদ্ধ শ্রমণদের এই জাদুবিদ্যা প্রদর্শনীর জন্য আহ্বান করব। যদি তাঁরা না পারে, হার স্বীকার করবে আর তাঁদের তীর্থিক হতে হবে। এটা কেমন হবে?”

“এ তো অতি উত্তম প্রস্তাব। যে শ্রেষ্ঠ, কেবল তাঁর ধর্মই থাকবে মগধে, আর এটাই হবে সঠিক কাজ।”





কয়েকদিনের মধ্যেই রাজ্যের সর্বত্র ঢেঁড়া পিটিয়ে খবর দেওয়া হল যে রাজপ্রাসাদের উদ্যানে জাদুবিদ্যার প্রদর্শনী দেখাবেন জাদুকর ভরদ্বাজ। তিনি দাক্ষিণাত্যের কাম্পিল্য নগর থেকে প্রশিক্ষিত হয়ে মগধে এসেছেন। সকল ধর্মীয় সংঘগুলিকে বলা হচ্ছে, তাঁকে পরাজিত করে নিজেদের শক্তি দেখান। যদি না পারেন, তাহলে মগধের সকল উপবন, আরাম ও বিহারগুলিতে কেবল তীর্থিকেরাই থাকবে। বাকিদের মগধ পরিত্যাগ করে চলে যেতে হবে আর জাদুশক্তি প্রদর্শনে অংশ নিয়ে পরাজিত হলে তীর্থিক-ধর্ম গ্রহণ করতে হবে।

আনন্দ শ্রামণেরদের একটি দলকে শিক্ষা দিচ্ছিলেন। তাঁর হাতে ভিক্ষাপাত্রে খানিকটা জল। একজন শ্রামণের সবার পাত্রে জলপাত্র থেকে খানিকটা করে জল ঢেলে দিচ্ছে। আনন্দ বললেন,

“এখন বুদ্ধের কথিত-বাক্য উচ্চারণ করবো, তাই হাত ও মুখ ধুয়ে নিচ্ছি। পরিনির্বাণের ঠিক আগে বুদ্ধ কী বলে গেছিলেন জানো? বলেছিলেন,–

‘হন্দদানি ভিক্‌খবে আনন্তয়ামি বো

বয়ধম্মা সঙ্খারা অপ্পমাদেন সম্পাদেথা তি।’

অর্থাৎ এর অর্থ হল– সংস্কারসমূহ ক্ষয়শীল। প্রকৃতপক্ষে এই জগতের সকল কিছুই অস্থায়ী। শরীর চিরস্থায়ী নয় তাই শরীর থেকে উৎপন্ন সমস্ত অনুভূতিও চিরস্থায়ী নয়, তাই সকলে অপ্পমাদের সঙ্গে সব কাজ সম্পন্ন করবে। এই অপ্পমাদ কথাটি যেটি বুদ্ধ বলেছিলেন, তার অর্থ বুঝেছো তোমরা? এটি একটি ছোট্ট শব্দ, কিন্তু এর মাধ্যমে ভগবান শেষ-শয্যায় শুয়ে একটি শব্দেই তাঁর সমস্ত উপদেশ জুড়ে দিয়েছিলেন। এটিই ছিল তথাগত বুদ্ধের বলা শেষ বাক্য! অপ্পমাদ হল শীলে প্রতিষ্ঠিত থাকা। ধ্যানে ব্রতী হওয়া, এর অর্থ হল সৎকর্মে উদ্যমী হওয়া। অপ্পমাদের অর্থ যথা নিয়মে বিনয় পালন করা।”

সকালে শাণবাসিক রাজপথের বিপণীগুলির দিকে ভিক্ষা সংগ্রহে গিয়েছিলেন তিনি। শুনেছেন, তীর্থিকদের সঙ্গে মিশে রাজগৃহের কিছু মানুষ কদর্য ভাষায় ধর্মের অপবাদ দিচ্ছে। তথাগতের নিন্দা তাদের কন্ঠে। শাণবাসিক সেখান থেকে ভিক্ষা সংগ্রহ না করে চলে এসেছেন। এর উপর রাজার কর্মীকদের ঢেড়া পিটিয়ে বলা কথাগুলোও তাঁর কানে এসেছে। তাঁর মন বেদনায় ভরে গেছে। ভিক্ষুরা অনেকেই সেই ঘোষণা শুনেছেন। কী করবেন ভাবতে পারছেন না কেউ। আচার্য আনন্দকে এমন সংবাদ দিতে মন সরছে না শাণবাসিকের। এমন দিন দেখতে হবে বলেই কি তিনি আজও সকলকে শিক্ষা দিয়ে চলেছেন? এই কি তবে ভবিতব্য? জাদুবিদ্যা আর শক্তিপ্রদর্শনের হুজুগ! এ কি কখনও কারো আচরণীয় হতে পারে?

কয়েকজন ভিক্ষু উদভ্রান্তের মতো ছুটে গেল আনন্দর কাছে।

আনন্দময় : নন্দিতা মিশ্র চক্রবর্তী

“ভন্তে নগরের মানুষ কদর্য ভাষায় তথাগতের নামে অপবাদ দিচ্ছে আর তীর্থিকেরা তাদের ইন্ধন দিচ্ছেন। তাঁরা রাজার কাছেও গেছেন। নানা কূটযুক্তি দিচ্ছেন রাজাকে। তীর্থিকদের নেতা ভরদ্বাজ স্বয়ং অজাতশত্রুর অতিথি হিসেবে রাজপ্রাসাদে আছেন, তিনি নাকি রাজার মৃগীরোগের চিকিৎসা করছেন! তিনি বলেছেন, তিনি এক নিমেষে রাজবৈদ্য জীবককে নিয়ে আসতে পারেন রাজার সামনে। আগে জাদু প্রদর্শনী হয়ে যাবে, তারপরের অমাবস্যায় তিনি জীবককে নাকি বিশেষ প্রক্রিয়ায় এখানে টেনে আনবেন, যদি তিনি মৃতও হন, তাহলে তাঁর আত্মাকেই তিনি রাজার সামনে আনবেন। এইসব বাগাড়ম্বর শুনে শুনে রাজা আপ্লুত। শুনেছি বর্ষকারও রীতিমত স্তাবকতা করছেন ভরদ্বাজের।”

“আমল দিয়ো না। ওরা যা চায় করুক!”

এমন সময় শাণবাসিক এসে দাঁড়ালেন আনন্দের সামনে। তাঁর দুচোখ লাল। বললেন,

“ভন্তে তাহলে কি আমরা চোরের মত মগধরাজ্য ছেড়ে চলে যাব? শ্রাবস্তীতেও যদি ওরা একই পদ্ধতিতে আমাদের পেছনে আসে এবং আবার জাদুবিদ্যার প্রদর্শন করতে বলে? শ্রমণ গৌতমের শিষ্যরা ঋদ্ধি প্রদর্শন করে না, তাই সবাই আমাদের দুর্বল মনে করছে!”

শাণবাসিকের কথা শুনতে শুনতে আনন্দ ভাবতে লাগল বহুকাল আগেকার কথা। তখন রাজগৃহে শুরু হয়েছিল বুদ্ধের বিরুদ্ধে অপপ্রচার। শ্রাবস্তীর জেতবনে নর্তকী সুন্দরীর মৃতদেহ পাওয়া গেছিল। সুন্দরীর গর্ভে ছিল সন্তান। তাই নিয়ে শ্রাবস্তী নগরে শুরু হয়েছিল কানাকানি। তীর্থিকেরা বিচার আহ্বান করেছিল। ভিক্ষা সংগ্রহে গেলে ভিক্ষুরা গৃহস্থদের গালি শুনে শূন্য হাতে ফিরে আসছিলেন। তখন আনন্দ বুদ্ধকে বলেছিলেন,

“প্রভু! চলুন আমরা এখান থেকে অন্য কোথাও চলে যাই।” শুনে বুদ্ধ বলেছিলেন, কোথায় যাবে আনন্দ? সেখানেও যদি এমনটা ঘটে? তার চেয়ে যুদ্ধক্ষেত্রের হাতির মত সংগ্রাম করো। তাছাড়া এই অপবাদের অবসান ঘটবে এবং আসল সত্য প্রকাশিত হবে। আর মোট সাতদিন এই অবস্থা চলবে।”

তীর্থিকদের পরাজিত করতে বুদ্ধও তো শ্রাবস্তীর গণ্ডম্ব আমগাছের তলায় নিজের ঋদ্ধি প্রদর্শিত করেছিলেন! আনন্দ ভাবলেন এই অবস্থার ইঙ্গিত দিতেই বুঝি ভগবান তাঁর স্বপ্নে এসেছিলেন। আনন্দ ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন। বজ্রকন্ঠে বললেন, “খবর পাঠাও! তীর্থিকদের এবং রাজাকে। বলো গিয়ে, আচার্য আনন্দ আগামীকাল জাদু প্রদর্শন করবেন। যদি ভরদ্বাজ তৈরি থাকে, সে যেন সকালে রাজবাড়ির উদ্যানে উপস্থিত থাকে।”

ভরদ্বাজ খবর পেয়ে হা হা করে হেসে উঠলেন। তারপর বললেন, “আচার্য আনন্দ! তিনি তো বয়সের ভারে ন্যুব্জ! এমন একজন মানুষ করবেন জাদু প্রদর্শনী? আচ্ছা! স্পর্ধা যখন দেখিয়েছেন, তেমন ধর্মান্তরিত হয়েই তাঁকে ফিরতে হবে!”

সকাল থেকেই রাজবাড়ির উদ্যানে ভিড়ে ভিড়াক্কার। দূর থেকে আসা মানুষের ভিড় দেখে ভরদ্বাজের মনে দারুণ আনন্দ হল। নিজের জয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে তাঁর হাসি আরও উজ্জ্বল হল। দুজনেই উদ্যানের দু’-পাশে দাঁড়িয়ে আছেন, যথাক্রমে ভরদ্বাজ ও আচার্য আনন্দ।

শুরু হল প্রতিযোগিতা। ভরদ্বাজ প্রথমেই উদ্যানের জমিতে পুজোর উপাচারের ব্যবস্থা করতে লাগলেন। বহুক্ষণ মাটিতে কাপড় ঢাকা দিয়ে রেখে তিনি অনেকটা সময় ব্যয় করলেন। তারপর ঘন্টা বেজে উঠল। ভরদ্বাজ হাতের ইশারা করলেন। প্রতিযোগিতা শুরু হল। প্রথমেই ভরদ্বাজ চার রত্নের চারটে পাহাড় তৈরি করলেন, পাহাড়গুলো সোনা, রূপো, স্ফটিক, এবং বৈদূর্যমণি দিয়ে তৈরি। সেই রত্নপর্বতগুলি উদ্যানে সকলের সামনে দিনের আলোয় ঝলমল করতে লাগল। প্রতিটি পাহাড় ঘিরে তৈরি করলেন উদ্যান এবং চারটি উদ্যানে চারটি সরোবর তৈরি করলেন, যাতে পদ্ম ফুটেছিল।

এবার এআনন্দ বুদ্ধকে স্মরণ করে উদ্যানের সামনে জাদু প্রদর্শনীর স্থানে এলেন। মনে মনে বুদ্ধকে প্রণাম জানিয়ে বললেন,

“হে প্রভু! আমি ধ্যান তপস্যা কিছুই করিনি কেবল তোমার সেবা করেছি সারাজীবন। প্রতিবার আমার প্রয়োজনে তুমি আমাকে সাহায্য করেছো। সপ্তপর্ণী গুহায় প্রথমবার ধর্মসংগীতির অনুষ্ঠানে তুমি আমাকে একটি রাতের মধ্যে ঋদ্ধিপ্রতিহার্য সহ অর্হত্বলাভ করিয়েছিলে। তখন তোমারই ইঙ্গিতে আমি হাওয়ায় ভেসে দ্রুত চলে গেছিলাম সপ্তপর্ণী গুহায়। তারপর সামনের মণ্ডপের কাপড়ের ছাদ ভেদ করে প্রবেশ করেছিলাম কাশ্যপের পরিচালিত সেই ধর্মমহাসভায়। সেখানে সকলে আমাকে দেখে অবাক হয়েছিল। তারপর থেকে জীবনে কখনও আমি নিজের ঋদ্ধিশক্তির প্রদর্শন করিনি। তবে আজ তুমি সংঘের সম্মানের জন্য আমার শরীরে প্রবেশ করো প্রভু! আমাকে দিয়ে তোমার আরাধ্য কাজটুকু করিয়ে নাও! আমি যে তোমাকে ছাড়া আর কিছু জানি না! হে সর্বশক্তিমান! সদ্ধর্মকে তুমি রক্ষা করো। একে আমি যদি যথাযথভাবে পালন করে থাকি, তাহলে তীর্থিকদের সামনে সংঘের মান যেন অটুট থাকে।”

আনন্দ হঠাৎ অনুভব করলেন তাঁর শরীর পালকের মত হালকা হয়ে গেছে। পরক্ষণেই অসীম শক্তি অনুভব করলেন তিনি। আনন্দ উপলব্ধি করলেন গুরুশক্তি আজ তাঁকে চালনা করবে। তিনি হাতটা তুললেন। সে হাতও যেন অবশ হয়ে গেছে। কেউ যেন তাঁর শরীরটি চালনা করছেন। তিনি দেখলেন উদ্যানে প্রবেশ করল একপাল বুনো হাতি। তারা তীব্র বৃংহন করে পদ্মগুলোকে খেয়ে ফেলল এবং পুকুরগুলিকে পদদলিত করে দিল। ঝড় শুরু হল। হাওয়ার ঝাপটা উদ্যানের গাছপালা ধ্বংস হয়ে গেল, এবং চারটি পাহাড়ই প্রবল বজ্রপাতে ধ্বংস হয়ে গেল। এবার আনন্দ দৃপ্ত ভঙ্গীতে হেঁটে গেলেন। তাঁর শরীর থেকে শত শত শরীর সৃষ্টি হল। সেই শরীরগুলি কেউ আগুন কেউ বা জল এবং কেউ বজ্র বর্ষণ করল। সেই অকল্পনীয় ঋদ্ধি শক্তি দেখে অজাতশত্রু সব ভুলে ছুটে এসে আনন্দের পদতলে লুটিয়ে পড়লেন।

“প্রভু আমাকে ক্ষমা করুন! আমি আপনার এক অধম সেবক।”

আনন্দ কেবল গুরুর শরণ নিয়েছিলেন, তাঁর বাহ্যচেতনা লুপ্ত হয়েছিল। কী ঘটেছে তিনি নিজেও জানেন না। তিনি অজাতশত্রুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “অরণ্যের গভীরে জীবক এখন এক অতি জটিল পরীক্ষায় ব্যস্ত আছে। বর্তমানে সে রসায়ন নিয়ে কাজ করছে। রসায়ন হল সেইসব ঔষধি যা মানুষকে নবজীবন দেয়। এক কথায় সে অমর হওয়ার প্রক্রিয়া আবিষ্কারের চেষ্টায় বর্তমানে ব্যস্ত আছে। সে এখানকার সবকিছু ছেড়ে গেছে, আর ফিরে আসবে না বলেই। তাকে আর ফিরিয়ে আনা ঠিক হবে না। জীবকের গবেষণা মানব সভ্যতার বিশেষ উন্নতি সাধন করবে।”

অজাতশত্রু অবনত মস্তকে বললেন, “যথা আজ্ঞা ভন্তে।”

ব্রাহ্মণ ভরদ্বাজ তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে সবাই এসে আনন্দকে প্রণাম জানালেন। সকলেই জানালেন ধর্মান্তরিত হতে তাঁদের কারও কোনও আপত্তি নেই। সকলেই ত্রিশরণ উচ্চারণ করে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করলেন। চারিদিকে জয়জয়কার শুরু হল। সেই উদ্যানে প্রায় হাজার খানেক মানুষ বৌদ্ধধর্মের উপাসক হলেন। আবার মানুষের মন ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে! আনন্দ এতে মনে শান্তি পেলেন। এবার তিনি বৈশালি যেতে চাইলেন। সেদিন বিকেলের মধ্যেই সংঘসহ আনন্দ বৈশালির অন্ধবনের কাছে কূটাগারশালা বিহারে চলে গেলেন।





“ওঠো আনন্দ! তোমার যাত্রার প্রস্তুতি নাও। আমি এসেছি। জগতে তোমার কাজ শেষ হয়েছে। আজকের দিনটিতেও একটি অলৌকিক ঋদ্ধি প্রতিষ্ঠিত হবে তোমার মাধ্যমে। মনে আছে অগ্নিসম্বর মন্ত্রের কথা? এই মন্ত্র হল আত্মঘাতী। আজ এই মন্ত্র জপ করে শেষযাত্রায় যাবে। এই মন্ত্র স্মরণে শরীর উত্তপ্ত হতে হতে নিজে থেকেই একসময় জ্বলে ওঠে। আনন্দ সেই মন্ত্র এখনই জপ করে দেখো তোমার শরীরের উত্তাপ বাড়ছে কিনা! তারপর দিবাভাগে যখন সূর্যের উত্তাপ সবথেকে বেশি হবে সেই সময় এই মন্ত্র জপ করবে।”

বুদ্ধের নির্দেশ শুনে আনন্দ ভোর হতে না হতেই অগ্নিসম্বর মন্ত্র জপ করতে শুরু করেছেন। একটু পরে তাঁর কান নাক ও চোখ জ্বালা করতে শুরু করল। তারপর আর কোনও অনুভূতি রইল না।

ভিক্ষা নিয়ে শ্রামণেরদের দল উপস্থিত হল আনন্দের কক্ষে। তাঁরা আনন্দের শরীর ছুঁয়ে চমকে উঠল। তারা দেখল অসহ্য জ্বরে আচার্যের শরীর যেন পুড়ে যাচ্ছে। আনন্দ ধ্যান থেকে চোখ মেলে বললেন, “আমার শরীর ভাল আছে। তোমরা কেউ ব্যস্ত হয়ো না অযথা। সকলকে বলো, আমি গঙ্গায় অবগাহন করতে চাই। যারা আমার সঙ্গী হতে চায় তারা চাইলে আসতে পারে। কয়েকটি নৌকার ব্যবস্থাও করতে হবে। দিবা দুই প্রহরের মধ্যে আমি মাঝগঙ্গায় পৌঁছাতে চাই।”

আনন্দের কথামতো বেশকিছু নৌকার ব্যবস্থা করা হল। তিনি কয়েকজন ভিক্ষুকে বেছে নিলেন, তাঁর সঙ্গে যাঁরা গঙ্গা পার হবেন। আনন্দ নদীর স্রোতের দিকে তাকিয়ে তাঁর সঙ্গী ভিক্ষুদের বললেন, “জীবন থেকে একটু একটু করে সময়ও এভাবেই বয়ে চলেছে। ভিক্ষুরা ধ্যানে নিবিষ্ট হও।” একঘণ্টা নৌকা পরিভ্রমণের সময় মাঝনদীতে সেই ধ্যানেই তাঁরা সকলে অর্হত্বলাভ করলেন। এই অর্হত্বপ্রাপ্ত ভিক্ষুরা পরবর্তীতে পরিচিত হলেন মধ্যাহ্নিকা নামে। এঁদের মধ্যে আছেন ভিক্ষু শাণবাসিকও। আনন্দ তাঁর দিকে চেয়ে বললেন, “বুদ্ধ তোমার কল্যাণ করুন। আজ থেকে ধর্মরক্ষার দায়িত্ব আমি তোমাকে অর্পণ করলাম।”

আনন্দময় : নন্দিতা মিশ্র চক্রবর্তী

ভিক্ষুরা সবিস্ময়ে দেখল আনন্দের শরীর থেকে অগ্নিসম তাপ নির্গত হচ্ছে! নৌকা ওপারে পৌঁছালে আনন্দ অবতরণ না করে একাকী নৌকাটিকে নিয়ে মাঝনদীতে চলে গেলেন। নদীর বাতাস তাঁর ভাল লাগছে। ভিক্ষুরা আচার্যের দিকে তাকিয়ে আছেন। দু’পারেই ভিক্ষুরা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আনন্দ যখন মাঝনদীতে এলেন তাঁর শরীর একটা আগুনের গোলাতে পরিণত হয়েছে। তখন মধ্যাহ্ন-সূর্যও জ্বলন্ত হয়ে তাপ বিকিরণ করছে। আনন্দ একবার উচ্চারণ করলেন, “নমো বুদ্ধ!” তারপরেই তাঁর শরীরটা দাহ্য বস্তুর মত হঠাৎ জ্বলে উঠল। এবং তা হালকা হয়ে নৌকার অনেকটা উপরে উঠে গেল। একসময় জ্বলতে জ্বলতে তা দলা পাকিয়ে দুটি গোলাকার পিণ্ডে পরিণত হল। আশ্চর্যভাবে দুটি গোলা গঙ্গার দুটি দিকে ভেসে গেল। চোখের জলে ভাসতে ভাসতে মগধ ও বৈশালির ভিক্ষুরা তা নীরবে গ্রহণ করলেন। পূতাস্থি নিয়ে সংঘে কোনও বিবাদের এতটুকুও অবকাশ রইল না। নিজের জীবন দিয়ে থের আনন্দ সঙ্ঘকে রক্ষা করে গেলেন আজীবন। এমন অনন্য ঋদ্ধি প্রতিহার্য বুঝি একজন শ্রেষ্ঠ অর্হৎই করতে পারেন! এই কারণেই বুঝি বুদ্ধ তাঁর শ্রেষ্ঠ শিষ্য হিসেবে একমাত্র আনন্দকেই স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। আনন্দ আনন্দময় জগতে যাত্রা করলেন।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন