একটি ইতিহাসের অপ্রকাশিত পর্বের অনুসন্ধান

স্বাধীনতার ৭৫ বছরে দেশে যারা শাসনক্ষমতায় থেকেছে, কোনও উদ্দেশে তারও দুই সম্প্রদায়ের সামাজিক শান্তিপূর্ণ সহবাসের কথাগুলি তুলে ধরার চেষ্টা করেনি। সেই দিক থেকে আমিনুল ইসলামের ‘ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অপ্রকাশিত ইতিহাস’ একটি আকর।



সম্রাট : ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহকে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম বড় কোনও সংগঠিত প্রতিরোধ বলে দাবি করে থাকেন বেশিরভাগ ইতিহাসবিদ। সিপাহি বিদ্রোহে দেশর হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায় একযোগে, ঐক‌্যবদ্ধভাবে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় জাতীয়তাবাদের এই উত্থান নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। কিছু লেখকের মতে, এর পরেই তারা হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক আবেগ জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছিল, যাতে তারা আর একত্রিত হয়ে ব্রিটশ শাসনকে উৎখাত করার চেষ্টা করতে না পারে।

সেই থেকেই ভারতে নিজেদের মসনদ নিরঙ্কুশ করতে ব্রিটিশ শাসক ‘ডিভাইড অ‌্যান্ড রুল’ নীতি নেয়। দুই সম্প্রদায়কে একে অপরের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দেওয়া হয়। ‘মুত্তাহিদা কওমিয়াত অর ইসলাম’ (সমন্বিত জাতীয়তাবাদ ও ইসলাম, প্রকাশ ১৯৩৮) গ্রন্থে লেখক মাওলানা হুসেইন আহমদ মাদানি বলেন, “মুসলিমদের এই কল্পনা করিয়ে ভয় দেখানোর চেষ্টা হয় যে স্বাধীন ভারতে মুসলিমরা তাদের স্বতন্ত্র পরিচয় হারাবে, এবং হিন্দুদের সঙ্গে মিশে যাবে। যার লক্ষ্য ছিল মুসলিমদের রাজনৈতিক উদ্দেশে ব‌্যবহার, তাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া।” এমনটা দেখা গিয়েছিল আগেও। সৈয়দ আহমেদ খানকে আলীগড় আন্দোলনের সাহায্য করেছিলেন আলিগড় কলেজের অধ্যক্ষ থিওডোর বেক। তিনি আহমদ খানকে বলেছিলেন যে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের উদ্দেশ্যের প্রতি মুসলিমদের কোনও সহানুভূতি থাকা উচিত নয় এবং ‘অ‌্যাংলো-মুসলিম ঐক্য সম্ভব, কিন্তু হিন্দু-মুসলিম ঐক্য কখনওই সম্ভব নয়।’

সুপ্রিম কোর্টের বিচারক মার্কন্ডে কাটজু ‘দ্য নেশন’-এ একটি নিবন্ধে লিখেছেন, ‘সমস্ত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়েছিল ১৮৫৭ সালের পর, ব্রিটিশ প্রশাসনের দ্বারা কৃত্রিমভাবে তৈরি। বৃটিশ কালেক্টর গোপনে হিন্দু পণ্ডিতকে ডেকে পাঠাতেন, টাকা দিতেন এবং মুসলিমদের বিরুদ্ধে কথা বলতে বলতেন, একইভাবে তিনি গোপনে মৌলবীদের ডেকে, টাকা দিতেন এবং হিন্দুদের বিরুদ্ধে কথা বলতে বলতেন। এই সাম্প্রদায়িক বিষ আমাদের শরীরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে বছরের পর বছর এবং দশকের পর দশক।’
ইতিহাস বিজয়ীরাই লেখে। রাষ্ট্র ক্ষমতা যাঁদের হাতে, ইতিহাসের পাঠ্যসূচিতে তাঁদের রাজনৈতিক অভিসন্ধির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব পড়ে। আমরা ভারতের যে ইতিহাস পড়ে বড় হয়েছি, তা ব্রিটশ শাসকের লেখা। তাতে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের কথা যতটা না বলা হয়েছে, তার থেকেও বড় করে দেখানো হয়েছে বিভেদের অংশগুলিই। স্বাধীনতার ৭৫ বছরে দেশে যারা শাসনক্ষমতায় থেকেছে, কোনও উদ্দেশে তারও দুই সম্প্রদায়ের সামাজিক শান্তিপূর্ণ সহবাসের কথাগুলি তুলে ধরার চেষ্টা করেনি। সেই দিক থেকে আমিনুল ইসলামের ‘ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অপ্রকাশিত ইতিহাস’ একটি আকর।

বিশিষ্ট গবেষক ও প্রাবন্ধিক আমিনুল ইসলাম তাঁর এই বইটিতে কয়েকটি পর্বে তুলে ধরেছেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের ঐক‌্যবদ্ধ আন্দোলনের ইতিহাস। যা শুরু হচ্ছে ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহের ৯৭ বছর আগে। ফকির-সন্ন্যাসী আন্দোলন বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আধিপত্যের বিরুদ্ধে মুসলিম ফকির (সুফি) ও হিন্দু যোগী সন্ন্যাসীদের সম্মিলিত সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলন। ১৭৬০ সালে এ আন্দোলন শুরু হয় এবং চার দশকেরও অধিককাল তা অব্যাহত থাকে। এটাই ছিল ব্রিটিশ আধাপত্যের বিরুদ্ধে ভারতবাসীর প্রথম সম্মিলিত প্রতিরোধ।

ভারতে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের বিভিন্ন পর্যায়ে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে যে সহযোগিতার উপস্থিতি লক্ষ‌্য করা গিয়েছিল, তাতে ব্রিটিশরা খুবই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল। ফকির-সন্ন‌্যাসী বিদ্রোহ, উপজাতি বিদ্রোহ, কৃষক আন্দোলন, সংগ্রামশীল তথা বিপ্লবী জাতিয়তাবাদী আন্দোলন, কংগ্রেসের মঞ্চ থেকে নরমপন্থী ও চরমপন্থী আন্দোলন, কমিউনিস্ট আন্দোলন, আজাদ হিন্দ বাহিনীর সংগ্রাম, নৌবিদ্রোহ– সবমিলিয়ে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন এক বহমান ধারা। এই বিভিন্ন আন্দোলনের মধ্যে কাজ করেছে বিভিন্ন মতাদর্শ ও আশা-আকাঙ্খা। কিন্তু এই বইয়ের আলোচ‌্য বিষয় হল এই আন্দোলনগুলির মধ্যে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের যে ধারাবিহিক ঐতিহ‌্য তার অনুসন্ধান। যেখানে ১৭৬৩ থেকে ১৯৪৭ কালপর্বের সেই ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। যে সময় ইতিহাস গোপন করার, পাল্টে ফেলার চেষ্টা শুরু হয়েছে, তখন আমিনুল ইসলামের লেখা এই বই ইতিহাসকে সমৃদ্ধই করবে। 

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অপ্রকাশিত ইতিহাস। আমিনুল ইসলাম। প্রকাশক - শিখা প্রকাশনী। মূল‌্য ৬৭০ টাকা

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন