প্রকাশনা জগতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সাহিত্য ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্যে এসেছেন ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায় । সেই অভিজ্ঞতা তিনি ‘লেখালেখির গল্প’ শিরোনামে ফেসবুকে পর্ব করে লিখছেন। সেই সূত্রেই, তিনি সর্বশেষ পর্বে লেখক রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে লিখেছেন।
লেখক রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত পরিসরে আলাপচারিচতা ‘ফাঁস’ করে বেজায় সমালোচনার মুখে পড়েছেন পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক তথা কলেজস্ট্রিটের খ্যাতনামা প্রকাশক ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায়। গত রবিবার (২৫ জুন) তাঁর ফেসবুক পেজ-এ ‘লেখালেখির গল্প’ শীর্ষক ৫৯তম পর্বে রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক তুলে ধরতে গিয়ে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনটির দিকেই পাল্লা ভারী হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই বাংলা সাহিত্যজগতে সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় ও আলোচিত ব্যক্তিত্বদের মধ্যে অন্যতম রঞ্জনবাবুকে নিয়ে লেখাটি গোগ্রাসে গিলেছেন নেটিজেনরা। চারদিনেই এক হাজারের বেশি রিঅ্যাক্ট হয়েছে। ৮৫ বার শেয়ার হয়েছে পোস্টটি। দেড়শো ছাপিয়ে কমেন্ট এসেছে। কিন্তু, ব্যক্তিগত সম্পর্ক তুলে ধরতে গিয়ে একজন ব্যক্তির একেবারে একান্ত ব্যক্তিগত, তা যতই অ-গোপন হোক, বিষয় জনসমক্ষে তুলে ধরা সাহিত্য-নৈতিকতার সঙ্গে আদৌ খাপ খায় কিনা সেই নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায়। বাংলার বইজগতে অন্যতম সফল প্রকাশক। পত্রিকা সম্পাদক। তিনি সফল লেখকও। সাহিত্য জগতে এমন ত্রিবেণী সঙ্গমের দৃষ্টান্ত নজিরবিহীন না হলেও, অতি বিরল। ত্রিদিববাবু প্রকাশনা সংস্থা ‘পত্রভারতীর’ কর্ণধার। কিশোর সাহিত্য পত্রিকা ‘কিশোর ভারতী’-র সম্পাদক। তিনি শিশু ও কিশোর সাহিত্যে অবদানের জন্য ২০০৭ সালে তিনি রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পান। সুলেখক ত্রিদিববাবু পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ২০২৩ সালের সাহিত্য পুরস্কার বিদ্যাসাগর স্মৃতি পুরস্কার লাভ করেন। তিনি কলকাতা পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ডের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। প্রকাশনা জগতে বিভিন্ন সময় তিনি বিভিন্ন সাহিত্য ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্যে এসেছেন। সেই অভিজ্ঞতা তিনি ‘লেখালেখির গল্প’ শিরোনামে ফেসবুকে পর্ব করে লিখছেন। সেই সূত্রেই, তিনি সর্বশেষ পর্বে লেখক রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে লিখেছেন।
এর আগে প্রয়াত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় থেকে শুরু করে প্রচেত গুপ্ত সবার সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে লিখেছেন। কিন্তু কোথাও তাঁদের ব্যক্তিগত জীবন– পরিবার, সম্পর্ক, পেশার টানাপোড়েন ইত্যাদি বিষয়ে আলোকপাত হয়নি। তাহলে রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে কেন তাঁর ব্যক্তিগত জীবন টেনে আনা হল, সেই প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। এখানে কয়েকটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করছি (দুঃখিত, বইতন্ত্র কারও একান্ত ব্যক্তিগত পরিসরে ঢুকতে চায় না। তবে ফেসবুকে পোস্ট হয়ে যাওয়া বিষয় পাঠকের বোঝার সুবিধার জন্য উল্লেখ করতে বাধ্য হচ্ছি)। ত্রিদিববাবু তাঁর পোস্টে একজায়গায় লিখেছেন, কোনও একবার কলকাতা বইমেলার গিল্ডের অফিসে রঞ্জনবাবুর সঙ্গে তাঁর প্রথম আলাপের কথা। যেখানে রঞ্জনবাবু বলছেন, “উঁহু, ত্রিদিব । প্লিস ডোন্ট মিস্টেক। আয়াম নট গুরু, আই ক্যান বি ইয়োর সেক্সগুরু । দ্যাটস মাই আইডেন্টিটি । এই যে তোমার কাছে উড়ে বেড়াচ্ছে কত তরুণী, দু’একজনকে আমার কাছে পাঠাও, আমি দীক্ষা দিই।” যাঁরা রঞ্জনবাবুর সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত নন, তাঁদের কাছে প্রবীণ লেখক সম্পর্কে ভুল বার্তা যাওয়া স্বাভাবিক। আরেক জায়াগায় লিখেছেন, রঞ্জনবাবু কোনও এক ঘরোয়া আড্ডায় তাঁকে বলছেন, “দ্যাখো ত্রিদিব, আমি হিসেব করে চলতে শিখিনি। আমি আমার বাবাকে দেখেছি। মা ছাড়াও তাঁর জীবনে এক নারী ছিলেন, তিনি অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, সাদা চামড়া। সেই আন্টির কাছে আমি ইংরেজি শিখেছি, শিখেছি ব্রিটিশ এ্যাকসেন্ট। আর বাংলা সাহিত্য শিখেছি বুদ্ধদেব বসুর ভাষা অনুসরণ করে। আমার মতে অত সুললিত বাংলা গদ্য এযাবৎ কেউ লেখেননি। দুটো ভাষাই আমি শিখেছি ভালোবেসে। ছোটবেলায় সেই আন্টি আমায় স্বপ্ন দেখাত, লানডান শহরের। ছবি দেখতাম, আর ভাবতাম, কবে যেতে পারব।”
এরপর একের পরা এক রঞ্জনবাবুর বিবাহ, প্রেম, বিবাহবিচ্ছেদ, অর্থনৈতিক টানাপোড়েন, চাকরিচ্যুত হওয়া – সব ‘রঞ্জনদা’র মুখ দিয়ে পোস্টে বলিয়েছেন। আসলে, রঞ্জনবাবুক নিজের কিছুই গোপন করার নেই। তিনি খোলা খাতা। যে কোনও পরিসরের আড্ডায় অকপটে নিজের মনে কথা, ভাবনা ব্যক্ত করেন। তবে তা কারও লেখায় উঠে আসা দুর্ভাগ্যজনক বলেই মনে করছে পাঠকমহলের একাংশ। কারণ, যেখানে সেই ব্যক্তির এই নিয়ে কোনও ব্যাখ্যা দেওয়ার সুযোগ থাকে না। ‘বইতন্ত্র’ জানতে পেরেছে, এই পোস্টের জন্য রঞ্জনবাবুর কোনও মৌখিক অনুমতিটুকু নেওয়ারও প্রয়োজন বোধ করেননি লেখক। এ ব্যাপারে বক্তব্য জানার জন্য ত্রিদিববাবুকে ফোন করা হলে ফোন সে সময় নট রিচেবেল ছিল। তাঁকে হোয়াটসঅ্যাপ করেও জবাব মেলেনি। তাঁর মন্তব্য পেলেই আমরা এই নিউজ পোস্ট অপডেট করে দেব।
তাছাড়া, প্রতিভাস থেকে প্রকাশিত রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের আত্মজীবনী ‘আমার জীবন রঙের তাস’ বেশ কিছুদিন আগেই প্রকাশিত হয়েছে। এর বাইরে রঞ্জনবাবুকে পাঠকের কাছে চেনাবার কী প্রয়োজন হয়ে পড়ল। যেখানে রঞ্জনবাবুকে ‘জ্ঞানী’ বলে প্রশাংসার আড়ালে সুচারুভাবে ‘নারীআসক্ত’ পুরুষ হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে। অন্তত, পোস্টের কমেন্টগুলিতে প্রমাণ নেটিজেনরা তেমনটাই বুঝেছেন। তাতে ত্রিদিববাবু উৎসাহিত, আগামী সপ্তাহে তিনি এর দ্বিতীয় পর্ব লিখবেন বলে জানিয়েছেন। তাঁর ‘লেখালেখির গল্প’ খুব শীঘ্রই বই হয়ে প্রকাশিত হবে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন