আমার কঠোরতম নিন্দুক সকল সমীপে : রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

আমার কঠোরতম নিন্দুক সকল সমীপে : রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়


এমন বদনাম আমার অন্তত নেই, আমি কৃপণ। কার্পণ্য খঞ্জ করেনি আমার জীবন, পরিসর কমায়নি উপভোগের। প্রতি সন্ধ্যায় ঠান্ডা হুইস্কির ঘামে ভেজে আমার স্ফটিক-গ্লাস-আশ্রিত, সংলাপ-সুরভিত, সানডাউনার! আমি জানি, অনেকেই পছন্দ করেননা আমার যাপনের ভঙ্গি ও দর্শন। তাঁদের অসহনীয় লাগে আমার মূল্যবোধ। প্রাণভরে নিন্দা করেন আমাকে। বলেছি তো, আমি কৃপণ নই। তাঁদের উদ্দেশেও আমি অনর্গল উড়িয়ে দিই আহ্বান ও আশ্লেষ। আমাকে ঘৃণাই করুন, বা ভালোবাসুন, কী যায় আসে বলুন। আমি বসবাস করি আমার প্রত্যয়ে, আমার সংশয়ে। কাউকে আঘাত করা আমার কাজ নয়। আমি বিশ্বাস করি মাধুর্যে। চর্চা করি মধুর রসের। এবং আমার এই মাধুর্য চর্চা জীবনের বহু পরতে প্রতত। জড়িয়ে আছে বেঁচে থাকার শিকড়ে।

আমি আমার আত্মজীবনী লিখেছি সম্প্রতি। নাম, ‘আমার জীবন রঙের তাস’। কোনওরকম আত্মশ্লাঘা থেকে উৎসারিত নয় এই নাম। এই নামে মিশে আছে আত্মশ্লেষ। এইটুকু যে-পাঠক বুঝতে পারবেন, তাঁরা ধরতে পারবেন কেন আমি শেষ করেছি এই আত্মজীবনী দুই বিপরীত সম্ভাবনায়। আত্মজীবনীটি ধারাবাহিক প্রকাশিত হয়েছিল ‘কৃত্তিবাস’-এ। গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে ‘প্রতিভাস’ থেকে। অনন্য স্টাইলিংয়ে সুদর্শন, দৃষ্টিনন্দন গ্রন্থটি বিক্রি হচ্ছে ভালোই। যদিও দাম ৭০০ টাকা! কারা কিনছেন? এই জিজ্ঞাসা আমাকে প্রবল অবাক করে। প্রকাশক বীজেশ সাহা ডাক দিয়েছে দ্বিতীয় খণ্ড লেখার জন্য। জানিনা তা সম্ভব হবে কি না। এই আত্মজীবনে আমি আমার মূল্যবোধ, বিশ্বাস, অবিশ্বাস, জীবন দর্শন এবং যাপন নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছি। কারোও কোথাও নিন্দা করেছি বলে মনে হয় না। আমার জীবনের সমস্ত বিপর্যয় দুঃখ এমনকী নিঃসঙ্গতার জন্য দায়ী করেছি নিজেকেই। কোনও শোচনা প্রকাশের জন্য নয়। কোনও করুণা ভিক্ষার জন্যও নয়। আমি লিখেছি অন্তরবার্তাটি দেওয়ার তপ্ত তাড়না থেকে। একটা কথা শুধু বলে রাখি, যা কিছু ঘটেছে আমার জীবনে, ঘটিয়েছে আমার লেখাপড়া। আমার কী ভাগ্য, আমার দর্শনের অধ্যাপক বিশ্বনাথ সেনের প্রণোদনায় পড়লাম নিৎসের ‘বিয়ন্ড গুড অ্যান্ড ইভিল্‌’। এবং এই দীর্ঘ গ্রন্থের অন্তরবার্তা, যতোটুকু বুঝতে পারলাম, হ্যাঁচকা টান দিয়ে ছিঁড়ে ফেলল আমার অস্তিত্বের শিকড়। এই বই আমাকে প্রথম বলল আমরা না-চিনি ঈশ্বরকে, না-চিনি শয়তানকে। নিৎসে জানাচ্ছেন দুটি কথা : ‘গড ইজ ডেড’। এবং ঈশ্বর ও শয়তান অঙ্গাঙ্গী! আলাদা করা যায় না! পাপ-পূণ্যকেও আলাদা করা যায় কি? আচ্ছা যদি পেরনো যায় ভালো-মন্দের সীমারেখা? যাওয়া যায় ভালো-মন্দের বাইরে? বিয়ন্ড গুড অ্যান্ড ইভিল্‌? ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল মুহূর্তে সমস্ত মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ, যাপনসংজ্ঞা! কবি জন মিল্টন আমাকে প্রথম দেখালেন শয়তানের দীপিত রূপ!

থাক সে সব কথা। এসব কথা অনেক লিখেছি আমার আত্মজীবনীতে। জীবন আমার কাছে ক্রমশ হয়ে উঠেছে শুধুমাত্র মনের মতো বই পড়া এবং সেই সব বই নিয়ে ‘কৃত্তিবাস’-এ নিয়মিত আমার ‘বইঘর’ ধারাবাহিক লেখার নিঃসঙ্গ পরিসর। ক্রমশ কমছে সংলাপ ও সংসর্গ। বাড়ছে সঙ্গহীন ভাবনার প্রিভেসি। ভাবছে উর্বর একাকিত্ব। তারই মধ্যে কানে আসে আমাকে নিয়ে নানা রোচক নিন্দায় অনেকে লেখালেখি করেন ফেসবুকে। আমি ফেসবুকে লিখি না। মূলত অসম্পাদিত লেখালেখির মধ্যে আমার রুচি নেই, তাই লিখি না। আমার প্রতিটি লেখা কোনও-না-কোনও প্রকাশক ও সম্পাদকের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। সেইভাবে একটি লেখা, আমার মতে, অর্জন করে প্রকাশের সম্মান। এবং অর্থও বটে।

এই প্রথম আমি ফেসবুকে যাচ্ছি। এবং এই শেষ। সংবাদ প্রতিদিন-এর সাংবাদিক দেবাশিস কর্মকার আমার সহকর্মী। তারই অনুরোধে আমার এই লেখা। তারই অনুরোধে কোনও রকমে সময়ে করে আমার এই ক্ষুদে লেখা শুধু এইটুকু বলতে যে, আমার প্রকাশকরাও আমার যাপনসংজ্ঞা, জীবনবোধ বিশ্বাস করেন না। তবু তাঁরা আমার বই প্রকাশ করেন। হয়তো বাণিজ্য মন্দ হয় না, একথা ভেবে। আবার অনেকে বলেন, আমি যাই লিখি পড়তে ভালো লাগে। ‘গুড রিড’–গদ্য পাঠক টানে। তা সত্যি। লেখকের সঙ্গে একমত হই বা না-হই, পড়তে বেশ লাগে। আমি নিজেও কী ছাই জানি, কেন আমার বই বাঙালি পড়ে! কিন্তু পড়ে যে তার প্রমাণ আমার জীবনের স্টাইলে! সবাই ভালো থাকবেন। যাঁরা আমার কঠোরতম নিন্দুক, তাঁদের বেশি ভালো থাকাটা আরও জরুরি। আমারই স্বার্থে।

সব শেষে বলি : আমার স্ত্রীরা, বন্ধুনিরা, সবাই আমার চেয়ে অনেক উঁচু মানের মানুষ।তাঁদের যোগ‌্য হতে পারিনি।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন