বিশ্বসাহিত্যেও এর বাইরে ভূত-পিশাচের নতুন কোনও রূপ কেউ কল্পনাই করতে পারেননি।
![]() |
AI GENERATED |
ঠোঁটের কোনায় তাজা রক্ত। তীক্ষ্ম ফ্যাং-এর মতো দাঁত। মাথায় বিদ্যুৎ শক খাওয়ার মতো খাঁড়া-খাঁড়া ঝাঁকড়া চুল। ফ্যাকাশে মুখ। মনি-হীন বিস্ফোরিত চোখ। আজকের সিনেমা-সিরিজে এমন ভ্যাম্পায়ারের ছড়াছড়ি। অত্যাধুনিক গ্রাফিক্সে ফুটিয়ে তোলা কাল্পনিক ভ্যাম্পায়ারের উৎস যে এই ভারত, তা অবশ্য বিশ্বের খুব বেশি মানুষ জানে না। এটাও তাদের অজানা যে ভ্যাম্পায়ার যুগে-যুগে বিশ্ব গল্প-কাহিনীতে জনপ্রিয়তা পেলেও, ২০০৮-এর আমেরিকান রোমান্টিক ফ্যান্টাসি ‘টোয়াইলাইট’-এর এডওয়ার্ড কুলেন কিংবা ২০০৯-এর টিভি সিরিজ ‘দ্য ভ্যাম্পায়ার ডায়েরিজ’-এর ড্যামন সালভাতোরের সঙ্গে ভারতীয় পৌরানিক কাহিনীতে চিত্রিত ভ্যাম্পায়ারদের বহু মিল রয়েছে। তাদের ‘ভ্যাম্পায়ার’ না বলা হলেও, এখানে ভারতীয় পৌরানিক কাহিনীতে বর্ণিত কয়েকটি প্রজাতির কথা আলোচনা করছি, যাদের সঙ্গে আজকের সিনেমা-সিরিজের ভ্যাম্পায়ারদের সঙ্গে সাদৃশ্য রয়েছে। এমনকী, বিশ্বসাহিত্যেও এর বাইরে ভূত-পিশাচের নতুন কোনও রূপ কেউ কল্পনাই করতে পারেননি।
বেতাল
বেতাল সম্পর্কে আমরা যা জানি, তার বেশিরভাগটাই একাদশ শতাব্দীতে লেখা ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’র বিক্রম ও বেতালের গল্প থেকে। তবে বেতালের বিবরণ আরও ভয়ঙ্কর। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, বেতাল গোরস্থানে কোনও মৃতদেহে বাস করে। আশপাশের গ্রাম তাণ্ডব চালায়, মানুষকে রাতের বেলা একলা পেলে তাড়া করে। এমনকি, গ্রামে কোনও কারণ ছাড়া হঠাৎ পর পর শিশুর মৃত্যু কিংবা গর্ভের সন্তান নষ্ট হয়ে যাওয়ার জন্যও বেতালকে দায়ী করা হয়েছে। বেতাল আটকে থাকে একটি ‘গোধুলী অঞ্চলে’, যা না দিন-না রাত্রী। যেমনটা জীবন ও জীবন-পরবর্তী অবস্থার মাঝামাঝি। বেতালের বিনাশ নেই। বেতাল সম্পূর্ণরূপে মৃত বা জীবিত নয়। আজকের ভ্যাম্পায়রাদের সঙ্গে এই বেতালের হুবহু সাদৃশ্য রয়েছে।
রাক্ষস
হিন্দু পৌরাণিক কাহিনীতে থাকা সবচেয়ে ভয়ঙ্কর প্রাণীদের মধ্যে একটি হিসাবে বিবেচিত হয় রাক্ষস। তারা যে কোনও সময় নিরীহ পশু থেকে ভয়ঙ্কর দানবের রূপ ধরতে পারে। এমনকী রাক্ষসীরা পুরুষকে প্রলুব্ধ করার জন্য লাস্যময়ী নারীর রূপও ধারণ করতে পারে তারা। অনেকটা আজকের ভ্যাম্পায়রদের মতোই তারা সূর্যালোক বা আলোয় অদৃশ্য হয়ে যায়। অন্ধকারে সজিব হয়। তারা রাতে গোরস্থানের চারপাশে ঘুরে বেড়ায় আর ভয়ঙ্কর কার্যকলাপ করে থাকে। রাক্ষসদের দূরে রাখার জন্য লোকলয়ে রাতের বেলা আগুন জ্বালিয়ে রাখা হত। রামায়নে রাবন, সুর্পণখা কিংবা মহাভারতে পুতনা রাক্ষসীর বিবরণ পাওয়া যায়।
পেমাকিলির বা পে
আধুনিক রক্তচোষা ভ্যাম্পায়ারের সঙ্গে তামিল পৌরানিকে বর্ণিত পেমাকিলির বা পে’র হুবহু মিল দেখতে পাওয়া যায়। মৃতদেহের উপর নৃত্যের জন্য পেমাকিলির আরও বেশি জনপ্রিয় ছিল। তামিল লোককাহিনীর অংশ হিসাবে, পেমাকিলির বা পে ছিল যুদ্ধক্ষেত্র এবং যুদ্ধের অধিদেবতা। এই কারণে, তারা কখনও কখনও করুণার দূত হিসাবে বিবেচিত হত। তারা সৈন্যদের মুক্তি দেবে, যারা মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। রক্তপিপাসু ভ্যাম্পায়ারের আদর্শ জায়গাই ছিল যুদ্ধক্ষেত্র।
পিশাচ
আধুনিক ভ্যাম্পায়ারদের মতো লাল, ফুলে ওঠা চোখ– পিশাচ হল হিন্দু পুরাণ থেকে আসা প্রাণী, যারা নিশাচর এবং রাতে শ্মশানে শিকার করে। তাদের আকৃতি পরিবর্তন করার এবং অদৃশ্য হওয়ার ক্ষমতাও রয়েছে বলে বিশ্বাস করা হয়। স্পষ্টতই, তারা মানুষের দেহ দখল করতে পারে, তাদের পাগল করতে পারে।
![]() |
ADVERTISEMENT |
ভারতীয় পৌরাণিক কাহিনী ও লোককথায় বর্ণিত বেতাল-রাক্ষস-পিশাচদের সঙ্গে আধুনিক ভ্যাম্পায়ারদের অন্ধকার-বাস, রক্ততৃষ্ণা ইত্যাদির বৈশিষ্ট্যগত সব সাদৃশ্যই রয়েছে। একদিন ভারতীয় কল্প-সাহিত্যে যার যাত্রা শুরু হয়েছিল, আজ তা বিশ্ব মনোরঞ্জনের দুনিয়াতেও বছরের পর বছর ভুতুড়ে-আকর্ষণ যে বজায় রাখবে, তা কে ভেবেছিল!
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন