অনুগল্প : অমলেট-টোস্ট-চা : দেবজিৎ ঘোষ

চা-এর কাপে চুমুক দিতে দিতে কত কথাই না মনে পড়ছে শিবশঙ্করবাবুর। অনুরাধার সঙ্গে ডিভোর্সটা হয়তো আটকানো যেত। 



'ইয়ং বেঙ্গল টি কর্ণার' এর কোণের দিকের কাঠের চেয়ারটাতে বসলেন শিবশঙ্করবাবু। মাথা ভর্তি পাকা চুল,চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা,চেহারায় বয়সের ছাপ স্পষ্ট। দীর্ঘ তেত্রিশ বছর উত্তর কলকাতার এক হাইস্কুলে শিক্ষকজীবনের শেষে আগামীকাল তিনি রিটায়ার করছেন। তিনি ইংরাজির শিক্ষক। কর্মজীবনটা ভয়েস চেঞ্জ, টেন্স, ন্যারেশন, শেক্সপীয়রের নাটক, ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতা এইসব ছাত্রদের শেখাতে শেখাতে কীভাবে যে কেটে গেল তা তিনি বুঝতেও পারলেন না।
---- "কী নেবেন ?", নতুন বেয়ারাটা জিজ্ঞেস করল।
---- "একটা অমলেট, কড়া করে সেঁকা টোস্ট...আর লাল চা।"
---- "চিনি ছাড়া নাকি চিনি দেওয়া ?"
---- "অল্প চিনি দিয়ে।"
নন্দ নামের এক বেশ পুরোন বেয়ারা ছিল দোকানটাতে। দীর্ঘদিনের পরিচয়,তাই তাকে আলাদা করে বলে দিতে হত না কী আনতে হবে। ছুটিতে নন্দ বিহারে গিয়েছিল তার বাড়িতে, সেখানেই নাকি এক বাস দুর্ঘটনায় সে মারা যায়।
কলেজ লাইফ থেকে এই দোকানটাতে শিবশঙ্করবাবু আসছেন। লীনাকে নিয়ে একবার এই দোকানটাতে এসেছিলেন এ কথা তাঁর বেশ মনে আছে ... যদিও লীনার সঙ্গে সম্পর্কটা শেষ পর্যন্ত এই পৃথিবীর সমস্ত ব্যর্থ প্রেমের তালিকায় নাম লিখিয়েছিল। পুরোনদিনের কাঠের এই চেয়ার-টেবিল, চিনেমাটির কাপ-প্লেট , ফ্যান, কড়ি-বরগা দেওয়া ছাদ এইসব শিবশঙ্করবাবুর কাছে ভীষণ নস্টালজিক। একটা আত্মিক টান জন্মে গিয়েছে শতাব্দীপ্রাচীন দোকানটার উপর।
বেয়ারাটা অমলেট আর টোস্ট দিয়ে গেল। অমলেটটা দারুণ বানিয়েছে , কাঁটা চামচ দিয়ে লঙ্কা-পিঁয়াজ আর একটু মাখন দিয়ে জম্পেশ করে ভাজা অমলেট থেকে একটুকরো মুখে দিতেই তৃপ্তিতে মন ভরে গেল ক্ষুধার্ত শিবশঙ্করবাবুর । যদিও দোকানটা এখন তৃতীয় প্রজন্মের মালিকানাধীন, তবুও ওরা ওদের খাবারের চিরাচরিত স্বাদটা বজায় রাখতে পেরেছে। শিবশঙ্করবাবুর মতো বয়স্ক মানুষরা তাই বারবার দোকানটাতে চলে আসেন তাঁদের নস্টালজিয়ার স্বাদ পেতে।
চা-এর কাপে চুমুক দিতে দিতে কত কথাই না মনে পড়ছে শিবশঙ্করবাবুর। অনুরাধার সঙ্গে ডিভোর্সটা হয়তো আটকানো যেত। আসলে সেই সময়টা শিক্ষকতার পাশাপাশি থিয়েটারের দিকেও ভীষণভাবে সময় দিয়ে ফেলেছিলেন শিবশঙ্করবাবু। এই নিয়ে নিত্যদিন অশান্তি হত, দোসর ছিল অনুরাধার সন্দেহবাতিক মন। শিবশঙ্করবাবু কিছুতেই বোঝাতে পারেননি দীপ্তির সঙ্গে মঞ্চে অভিনয়ের সূত্রে নিখাদ বন্ধুত্বের সম্পর্ক বাদে আর অন্য কোনরকম সম্পর্কই ছিল না। এইভাবে আর কতদিনই বা চলতে পারত। অতএব বিয়েটা ভাঙল। আচ্ছা , লীনার সঙ্গে বিয়ে হলেও কি একই পরিণতি হত ?
ADVERTISEMENT

দাম মিটিয়ে বাইরে এসে যখন একটা গোল্ডফ্লেক ধরালেন শিবশঙ্করবাবু , ঘড়িতে তখন বাজে সন্ধ্যে ছ'টা। অফিস সদ্য ভেঙেছে। মোড়ের মাথায় ঘরফেরতা জনতা-বাস-ট্যাক্সির জটলা। আজ রাতে শেষবারের মতো ঘড়িতে এলার্ম দিয়ে শোবেন , রুটিন-মাফিক জীবনের অদ্যই শেষ রজনী। "বৌবাজার চলো" একটা ট্যাক্সিতে উঠে ড্রাইভারকে হুকুম দিলেন শিবশঙ্করবাবু। পশ্চিম আকাশে ঢলে যাওয়া এক জীবনসূর্যকে নিয়ে শহরের ব্যস্ত রাজপথ দিয়ে ছুটে চলল এক হলুদ ট্যাক্সি , শহরের ভিড়ে ক্রমে মিশে যেতে থাকলেন জীবনযুদ্ধের এক বৃদ্ধ সৈনিক।

লেখক পরিচিতি :
দেবজিৎ ঘোষ । জন্ম হুগলির উত্তরপাড়ায়। বেড়ে ওঠা উত্তরপাড়া ও কলকাতাতে। উত্তরপাড়া রাষ্ট্রীয় উচ্চ বিদ্যালয়ে আড়াই বছর পড়াশুনা করার পর বদলি নিয়ে ভর্তি হন হিন্দু স্কুলে । সেখান থেকেই সসম্মানে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা পাস করেন। এরপর সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশুনা করেন। পরবর্তীকালে ডেটা সায়েন্স ও মেশিন লার্নিং নিয়েও চর্চা করেছেন। কর্মসূত্রে কলকাতার পূর্ব পুটিয়ারী-তে থাকেন। পেশাগত ভাবে প্রযুক্তিবিদ হলেও নেশা গত ভাবে লেখক। 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন