‘সেল্ফ পাবলিশিং’ শুনে আর নাক সিটকাবেন না

বিশ্বব‌্যাপী সৃজনশীল ‘আত্মপ্রকাশ’ -এর একটি পথ খুব জনপ্রিয় হয়েছে। যাকে বলা হয় ‘সেল্ফ পাবলিশিং’। বহু জার্নাল, পত্রিকা বা পোর্টালে কিছু অর্থের বিনিময়ে লেখা ছাপানোর ও প্রচুর পাঠকের কাছে পৌঁছনোর সুযোগ রয়েছে।

‘সেল্ফ পাবলিশিং’ শুনে আর নাক সিটকাবেন না
কলেজ স্ট্রিটের একটি বইয়ের স্টল। ফাইল ছবি।

রজতাভ

দ্বিতীয় শ্রেণির পর আর স্কুলে যাওয়া হয়নি অখিল কে’র। পরিবারের ভরণপোষণের জন্য তাঁকে পড়াশোনায় ইতি টানতে হয়। অখিল রাতে একজন জেসিবি অপারেটর হিসাবে কাজ করতেন। ভোরবেলা বাড়ি-বাড়ি খবরের কাগজ বিলি করতেন। জেসিবি অপারেটার হিসাবে টানা আটঘণ্টার শিফট শেষ হওয়ার পর, পরের চারঘণ্টা ডুবে যেতেন লেখার মধ্যে। গল্প লিখতে বসতেন। বেশ কিছু গল্প জমে যায়। বন্ধু-বান্ধবরা অনেকেই সেইসব গল্প শুনে বই করার পরামর্শ দেয় অখিলকে।

কিন্তু একজন প্রকাশককে বই প্রকাশে রাজি করানো চ‌্যালেঞ্জ হিসাবে দেখা দেয় অখিলের কাছে। প্রায় চার বছর ধরে অখিল তাঁর লেখাগুলি প্রকাশের জন্য অসংখ্য প্রকাশক এবং পত্রিকার সঙ্গে যোগাযোগ করে। কয়েকজন প্রকাশকের গল্পগুলি পছন্দ হলেও, তাঁরা বই প্রকাশ করতে রাজি হননি। স্পষ্ট জানিয়ে দেন, অখিল যেহেতু পরিচিত নাম নয়, তাই বাজারে বই বিক্রি করা কঠিন হতে পারে। এই সময়েই ফেসবুকে একটি বিজ্ঞাপনে চোখ পড়ে অখিলের। যেখানে কোনও এক প্রকাশনী সংস্থা ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে বই প্রকাশের প্রস্তাব দিয়েছিল। সেইসময় অখিলের কাছে জমানো ১০ হাজার টাকা ছিল। তাঁর দিনমজুর মা আরও ১০ হাজার টাকা জোগাড় করে দেন। টাকা নিয়ে সেই প্রকাশকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন অখিল। এরপর তাঁর প্রথম বই ‘নীলাচাদয়ন’ প্রথমে শুধু অনলাইনের জন‌্যই প্রকাশিত হয়েছিল। এখন আপনারা জেনে গিয়েছেন, ২০২২-এর কেরালা সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পেয়েছেন অখিল কে, তাঁর ওই ‘নীলাচাদয়ন’ বইটির জন‌্য।

এবার বাংলার প্রখ‌্যাত সাহিত্যিক অমর মিত্রর নিজের কলমেই কয়েকটা লাইন এখানে তুলে ধরছি,–

“১৯৭৮ সালে আমার কর্মস্থল ঝাড়গ্রামের এক কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্ক থেকে ২০০০ টাকা ঋণ নিয়ে আমার প্রথম বই ‘মাঠ ভাঙে কালপুরুষ’ প্রকাশ করি। তখন আমি মাইনে পাই ৫০০ টাকা। ২০০০-এ চার কাঠা জমি হতো, কোনও এক সহকর্মী বলেছিলেন। তিনি জানতেন, আমি ভাড়াটে বাড়ির বাসিন্দা। প্রণবেশ মাইতি ‘মাঠ ভাঙে কালপুরুষ’-এর প্রচ্ছদ করে দিয়েছিলেন। একটি পয়সাও নেননি। কবি প্রভাত চৌধুরীর বাড়িতে বইটি প্রকাশিত হয় শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের হাতে। বন্ধুরা, তুষার, সমীর, পবিত্রদা, শচীন, দীপঙ্কর — ছিলেন।”

এখানে উল্লেখ করি, সে বই বিক্রি হবে এবং তা থেকে বিনিয়োগের কিছু অর্থ ফেরত আসবে, সে প্রত‌্যাশা করেননি অমরবাবু। কিন্তু তারপরের ৪৫টা বছর ইতিহাস। আর একটা কথা জেনে রাখুন, ১৯৭৭ সালে অমরবাবুর লেখা গল্প প্রথম কোনও পত্রিকায় প্রকাশিত হয়– শ‌্যামল গঙ্গোপাধ‌্যায়ের সম্পাদনায় ‘অমৃত’য়। পরের বছরই নিজের বই করার চিন্তাভাবনা।

সাম্প্রতিক সময়ের সর্বাপেক্ষা সফল ভারতীয় লেখক আমিশ ত্রিপাঠি। তবে তাঁর শুরুটা খুব সহজ ছিল না। ‘শিবা ট্রিলজি’র প্রথম বই ‘দ‌্য ইমমর্টালস অফ মেহুলা’ নিয়ে প্রকাশকের দোরে দোরে ঘুরতে হয়েছে তাঁকে। ২০ বার প্রকাশকরা তাঁর বই বাতিল করার পর নিজেই সেই বই প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নেন অমিশ। তাঁর পরিবার আর্থিকভাবে অতিসচ্ছ্বল ছিল না। কাজেই বইপ্রকাশের জন‌্য তাঁর এজেন্টকে বই ছাপার খরচের জন‌্য রাজি করান, নিজে বইয়ের প্রচারের খরচের দায়িত্ব নেন। ২০১০ সালে প্রকাশিত হয় ‘দ‌্য ইমমর্টালস অফ মেহুলা’। বাকিটা ইতিহাস। 

এই তিন লেখকের লেখকজীবনের শুরুটা অনেকটা একই রকম। কিন্তু হাঠাৎ কেন এর অবতারণা?

এখন পাঠক কমেছে। কিন্তু লেখক ও প্রকাশকের সংখ‌্যা বেড়েছে। প্রতি বছর প্রচুর বই বিক্রি হচ্ছে। ধ্রপদী বাংলা সাহিত‌্য ছাড়াও, সমসাময়িক প্রখ‌্যাত লেখক এবং নতুনদেরও অনেকের বই পাঠক কিনছে। বহু পত্র-পত্রিকাও প্রকাশিত হয় শহর কলকাতা ছাড়াও গ্রাম-মফস্বল থেকেও। সাহিত‌্য নিয়ে নিত‌্য-নতুন গবেষণা হচ্ছে। কিন্তু এর মধ্যেই একটি বিতর্ক মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে, একজন লেখকের পক্ষে কোনও পত্রিকায় বা প্রকাশক সংস্থা থেকে নিজের লেখা প্রকাশ কতটা যুক্তযুক্ত? তর্কটা এই অবধি থাকলেও মানা যেত, কিন্তু এরসঙ্গেই উঠে আসছে একজন লেখকের যোগ‌্যতা নিয়ে প্রশ্ন, একজন সম্পাদক বা প্রকাশকের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন। নিজের খরচে বই ছাপিয়ে লেখক তবু বেমালুম তা গোপন করে যেতে পারেন, কিন্তু সম্পাদক-প্রকাশকে, যাঁরা অর্থের বিনিময়ে পত্রিকায় লেখা প্রকাশ করেন বা বই প্রকাশ করেন, রীতিমতো ‘ভিলেন’, ‘চোর’, ‘ডাকাত’ বানিয়ে ফেলা হয়েছে। অথচ, এই নিজের খরচে প্রথম বই প্রকাশ, নিজের খরচে প্রথম গানের রেকর্ড, বিনা পারশ্রমিকে প্রথম সিনোময় পার্শ্বচরিত্র– এসব নতুন কিছু নয়। কারও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে স্বীকার করার ক্ষমতা থাকে, কেউ গোপন করতে ভালোবাসেন। যাক গে, সেটা যাঁর-যাঁর ব‌্যক্তিগত ব‌্যাপার।

তবে এখানে একটা কথা মনে রাখতে হবে বইপ্রকাশের জন‌্য লেখকের আত্মবিশ্বাসটা অত‌্যন্ত জরুরি। তিনি যদি মনে করেন তাঁর লেখার ধার আছে, আজ না হোক কাল পাঠন গ্রহণ করবেই, তবে তাঁকে ধৈর্য ধরতে হবে। এখন বিভিন্ন বাণিজ্যিক পত্র-পত্রিকায় গল্প-কবিতা প্রকাশের সুবিধা রয়েছে। দৈনিক সংবাদপত্রের সাহিত্যের পাতা ছাড়াও, পাক্ষিক, মাসিক বহু পত্রিকা রয়েছে যেখানে বিজ্ঞাপন দিয়ে লেখা অহ্বান করা হয়ে থাকে। ইমেলে বা পোস্টে যে কেউ নিজের লেখা পত্রিকা দফতরের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিতে পারেন। লেখা মনোনীত হলে দপ্তর থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়, প্রকাশিত হলে সাম্মানিকও মেলে। এর জন‌্য লেখকের কোনও পরিচিতি, প্রভাবশালীর তদ্বির, আর্থিক লেনদেন– কোনও কিছুর প্রয়োজন নেই। সম্পাদকমণ্ডলীর সেই লেখা পছন্দ হলে প্রকাশিত হবে। একটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি বলেই সেই লেখাটি খারাপ, এমনটাও ভাববেন না। অন‌্য পত্রিকায় হয়তো সেই গল্পই প্রকাশিত হবে এবং তা পাঠকদের প্রশংসাও পাবে।

তবে এই পদ্ধতি ধৈর্যের এবং দীর্ঘ সময়সাপেক্ষও। লেখক যদি মনে করেন, কোনও সম্পাদকমণ্ডলীর মনোনয়নের উপর ভরসা করবেন না, লেখা জমা দিয়ে দীর্ঘসময় উত্তরের জন‌্য হা-পিত্যেশ করে বসে থাকবেনা না, তবে তার পথও খোলা রয়েছে। এখন এমন অনেক পত্রপত্রিকা রয়েছে, যেখানে সামান‌্য অর্থের বিনিময়ে বা কয়েকটি বই কেনার শর্তে লেখা প্রকাশিত হতে পারে।

বই প্রকাশের ক্ষেত্রে বড়বড় প্রকাশনা সংস্থাগুলি মাঝেমাঝে নতুন লেখকদের পাণ্ডুলিপি আহ্বান করে। কোনও লেখক নিয়ম মেনে নিজে থেকেও প্রকাশনার দফতরে পাণ্ডুলিপি জমা করতে পারেন। প্রকাশনা সংস্থার সম্পাদরমণ্ডলী সেই পাণ্ডুলিপি প্রকাশের জন‌্য মনোনীত করে বা বাতিল করে। প্রকাশনা সংস্থা বই প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নিলে লেখকের সঙ্গে একটি চুক্তি হয়। সেই চুক্তিপত্রে বইয়ের স্বত্ত্ব, পরিবেশনা, রয়‌্যালটি ইত‌্যাদি বিষয়ে আইনি ভাষায় সমস্ত কিছু লেখা থাকে। প্রধান দু’টি শর্ত হল– বইটির স্বত্ত্ব কার হাতে থাকবে এবং বার্ষিক বই বিক্রির উপর প্রকাশনা সংস্থা লেখককে কত হারে রয়‌্যালটি দেবেন।

এই পদ্ধতিও ধৈর্য‌্যের এবং সময় সাপেক্ষ। এমন ভাগ‌্যবান লেখক খুব কমই আছেন, যাঁর প্রথম লেখা কোনও প্রকাশনা সংস্থা এভাবে প্রকাশ করেছেন। প্রকাশনা সংস্থাগুলির লক্ষ‌্য থাকে কোনও নামি বাণিজ্যিক পত্রিকায় প্রকাশিত উপন‌্যাস বই আকারে প্রকাশ কিংবা নামি ও জনপ্রিয় লেখকের নতুন লেখা একক উপন‌্যাস বা সংকলনের বই প্রকাশ। নতুন লেখকদের তাঁরা প্রায়শঃই পত্রপাঠ বিদায় করেন। দ্বিতীয়টি হল সেই পথ, যা সাড়ে চার দশক আগে নিয়েছিলেন অমর মিত্র, তারপর নতুন শতকে অমিশ ত্রিপাঠি থেকে আজকের অখিল কে। বিশ্বব‌্যাপী এই ‘আত্মপ্রকাশ’ -এর পথটি জনপ্রিয় হয়েছে। যাকে বলা হয় ‘সেল্ফ পাবলিশিং’। বহু জার্নাল, পত্রিকা, পোর্টালে কিছু অর্থের বিনিময়ে লেখা ছাপানোর ও প্রচুর পাঠকের কাছে পৌঁছনোর সুযোগ রয়েছে।

সমস্ত ক্ষেত্রেই জরুরি লেখকের আত্মবিশ্বাস। একজন লেখক নিজে যদি বই বিক্রির ব‌্যপারে নিশ্চিত হতে না পারেন, তবে প্রকাশক কীভাবে ঝুঁকি নেবেন। প্রকাশককে তো বইয়ের বাণিজ্যিক দিকটিও দেখতে হবে। দিনের শেষে কিন্তু প্রকাশনাও একটি ব‌্যবসা। কোনও একজন নতুন লেখকের যদি অার্থিক সঙ্গতি এবং আত্মবিশ্বাস থেকে থাকে, তবে তিনি এই পথে সফল হতেও পারেন। আমি তিন লেখকের কথাই এখানে উল্লেখ করেছি, তবে বিশ্বসাহিত্যে এমন বহু লেখক রয়েছেন, যাঁরা প্রথম বইটি নিজের খরচে ছেপেছেন, পরে তাঁরাই প্রভূত জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। বড় স্বীকৃতি পেয়েছেন।

সবশেষে, অভিনেতা নাসিরুদ্দিন শাহর একটি মন্তব‌্য উল্লেখ করতে চাই। একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “আমি যখন নতুনদের মধ্যে যাই, অনেকেই আমাকে একটা সুযোগ করে দেওয়ার জন‌্য অনুরোধ করে। আমি তাদের বলি, নিজেরাই একটা নাটকের আয়োজন করো। নিজের দু’চারজন আত্মীয়-বন্ধুকে দেখতে ডাকো। নাটক করো। কে তোমাদের বাধা দিয়েছে? তোমার মধ্যে যদি প্রতিভা থাকে তো একদিন সবার নজরে পরবেই। ওভাবে কেউ কাউকে সুযোগ দেয় না।”

বন্ধু-বান্ধব মিলে কিছু টাকা হাতে নিয়ে এবং ছোটখাটো বিজ্ঞাপন জোগাড় করে কিন্তু দিব্যি একটা লিটল ম‌্যগাজিন করা যায়। অনেক বড়বড় লেখকের প্রথম লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে কোনও লিটল ম‌্যাগাজিনে। লিটল ম‌্যগাজিনই লেখকের প্রকৃত অর্থে সূতিকাগৃহ।




Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন