একজন লেখকের সাফল্যের অনেকটাই নির্ভর করে তাঁর লেখাটি সঠিক পাঠকের হাতে পৌঁছচ্ছে কিনা, তার উপর। তাই কোনও পাণ্ডুলিপি প্রকাশকের হাতে তুলে দেওয়ার আগে দুবার ভাবুন।
দ্বৈপায়ণ কর
দোরগড়ায় বইপ্রেমীদের সর্বশ্রেষ্ঠ উৎসব ‘কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা’। বেশিরভাগ লেখক-প্রকাশকই তাঁদের বই প্রকাশের জন্য বইয়ের ‘মহাকুম্ভ’ কলকাতা বইমেলাকে লক্ষ্য করেন। কারণ, এই সময় বই প্রকাশ হলে প্রচারটাও পাওয়া যায়, তাছাড়া অতিরিক্ত বিক্রিবাটাও হয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচুর প্রকাশিতব্য বইয়ের খবর দেখতে পাচ্ছি। এর বাইরেও নিশ্চয় আরও বই প্রকাশিত হবে এবারের বইমেলা উপলক্ষে্য। সে কারণে লেখক-প্রকাশক-প্রচ্ছদ শিল্পী-মুদ্রক-বাঁধাইকর্মীদের চূড়ান্ত ব্যস্ততা। বলা যায় এই সময় বই ঘিরে এক কর্মযজ্ঞ চলেছে। আমার ধারণা এবার ছোট-বড়-মাঝারি প্রকাশক মিলিয়ে বই প্রকাশের সংখ্যাটা গতবারের সংখ্যাকে ছাড়িয়ে যাবে।
বাংলার ঘরের বেশিরভাগ মেয়ে যেমন সরস্বতী পুজোয় প্রথম শাড়ি পরে, তেমনই বাংলার বহু লেখকেরই প্রথম বইটি প্রকাশিত হয় কলকাতা বইমেলায়। এমন লেখকদের বই এবারও বইমেলায় প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে বা অনেকেই প্রকাশকের সঙ্গে এখনও কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছেন। এখন তিন ভাবে লেখকের বই প্রকাশ হতে পারে– এক) প্রকাশকের নিজস্ব খরচে, ২) লেখকের নিজস্ব খরচে, এবং তিন) প্রকাশক-লেখক যৌথ খরচে। কিন্তু, মনে লেখকদের মনে রাখতে হবে যে আপনার লেখনি আপনার মেধাসম্পদ। অনভিজ্ঞ ও অদক্ষ হাতে তা তুলে দেবার আগে দু’বার ভাবুন।
একজন লেখকের সাফল্যের অনেকটাই নির্ভর করে তাঁর লেখাটি সঠিক পাঠকের হাতে পৌঁছচ্ছে কিনা, তার উপর। প্রকাশকের গোডাউনে পড়ে থাকা বা লেখকের আলমারিতে সাজানো বইয়ের কোনও সার্থকতা নেই। তাই সবার প্রথমে বিক্রির কথা ভাবুন। আপনার প্রকাশকের বই বিক্রির নেটওয়ার্ক জানুন। তাদের কাজকর্ম সম্পর্কে খোঁজ নিন। বইবাজারে তাদের ট্র্যাক রেকর্ড দেখুন।
প্রচ্ছদ দিয়ে কোনও বইকে বিচার করা উচিত নয়। তবে আকর্ষণীয় গেট-আপ বইটি সম্পর্কে সম্ভাব্য ক্রেতার আগ্রহ বাড়াতে পারে। তাই আপনার প্রকাশকের আগের প্রকাশিত বইগুলি নেড়েচেড়ে দেখুন, সেগুলির গেটআপ কেমন। গেটআপ বলতে বইয়ের কাগজ, ছাপা ও বাঁধাইয়ের গুনমান, কম্পোজ, বানান– সবকিছুই বোঝায়। এগুলি ঠিক না থাকলে, বইয়ের বিষয়বস্তু যতই ভালো ও আকর্ষণীয় হোক না কেন, তার নম্বর কমে যায়।
বিজ্ঞাপনের ব্যাপারটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখক নিজে বা প্রকাশকের তরফে আসন্ন বা প্রকাশিত বইয়ের প্রচ্ছদ দিয়ে পোস্ট করা একটি পদ্ধতি। তবে এটা ভীষণ অপেশাদার পথ। সোশ্যাল মিডিয়ায় চেনা গণ্ডির মধ্যে খবর ছড়িয়ে দিয়ে ‘অভিনন্দন’ পাওয়া গেলেও বইটি প্রচারের সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ। উপরোধের ঢেঁকি গিয়ে বা অনুকম্পা দেখিয়ে কেউ বইটি কিনলেও, তা না পড়েই হয়তো ফেলে রাখবেন। তাতে আপনার প্রতিভার প্রকৃত মূল্যায়ন সম্ভব নয়। বেশিরভাগ সম্ভাব্য পাঠকের কাছে পৌঁছতে জনপ্রিয় পত্র-পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিন। আজকাল বই সংক্রান্ত পোর্টালেও বিজ্ঞাপন দিয়ে বড় সংখ্যায় সম্ভাব্য ক্রেতার কাছে পৌঁছনো যাচ্ছে। লেখক-প্রকাশকের উচিত বিজ্ঞাপনের জন্য একটা বাজেট রাখা। বই বিক্রি শুধু প্রচারের জন্য নয়, এটা লেখকের পেশাদারি মনোভাবও। যা প্রতে্যক লেখকের থাকা উচিত। তবে নিজে বই বিক্রির দায়িত্ব নেবেন না। ওটা প্রকাশকেরই দায়িত্ব। বই প্রকাশের আগে জেনে নিন, আপনি কতগুলি বই লেখক কপি হিসাবে পাবেন বা আদৌ পাবেন কিনা।
খোঁজ নিয়ে দেখুন আপনার প্রকাশের জনসংযোগ কেমন। অর্থাৎ, কতগুলি পত্র-পত্রিকার সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগ রয়েছে। দৈনিক সংবাদপত্র থেকে শুরু করে জনপ্রিয় পত্রিকাগুলিতে বইয়ের খবর বা সমালোচনা প্রকাশ কিন্তু পাঠকের কাছে পৌঁছতে সাহায্য করে। অনেক প্রকাশক-লেখক এর জন্য বইয়ের দু’টি কপিও পত্র-পত্রিকায় পাঠাতে চান না। এই হেতু কিছু বই আলাদাভাবে রাখা উচিত।
কে বলতে পারে যে আপনার আগামী বইটি কোনও পুরস্কারে সম্মানিত হবে না। আপনি বই প্রকাশের আগে খোঁজ নিন, আপনার প্রকাশক এই বিষয়টিতে কতটা সচেতন এবং কতটা খোঁজ-খবর রাখেন। বিভিন্ন পুরস্কারের জন্য মনোনয়নে বই পাঠানোর পদ্ধতিগুলি জানেন কিনা। এটিও কিন্তু একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বইবিশ্বে এমন নজিরও আছে, কোনও লেখকের প্রথম বইটিই বড় পুরস্কার পেয়েছে। পুরস্কার কিন্তু একজন লেখকের কাছে বড় স্বীকৃতি।
সর্বোপরি, যে কোনও মৌলিক পাণ্ডুলিপি প্রকাশকের হাতে তুলে দেওয়ার আগে লিখিত চুক্তি করে নেবেন। এর আগে পাণ্ডুলিপিটিও কপিরাইট করে নিতে পারেন। প্রকাশকের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন করতে হবে কপিরাইট আইন মেনে। চুক্তিতে অবশ্যই স্বত্বের অধিকার, মেয়াদ, রয়্যালটির পরিমাণ উল্লেখ থাকতে হবে। মনে রাখবেন, চুক্তিনামাটিও কপিরাইট অফিস থেকে নিবন্ধন করে নেওয়ার সুযোগ আছে।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন