আন্তর্জাতিক পটভূমিতে রচিত উপন্যাসগুলিতে অতিরিক্ত প্রাপ্তি এবং বিরল নিদর্শন হিসাবে আমরা পেয়ে যাই বিদেশের চিত্রিত শহর বা দেশটি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য।
মানস ভাণ্ডারী
বাংলা কথাসাহিত্যের সাম্প্রতিক পর্বটিতে দেখা যাচ্ছে রহস্য-রোমাঞ্চ-অ্যাডভেঞ্চার প্রভৃতি থ্রিলার জাতীয় রচনার প্রতি পাঠকের আকর্ষণ অতি মাত্রায় বর্ধমান। ফলত লেখকদের মধ্যেও এই ধরনের লেখালেখিতে আগ্রহ, উৎসাহ ও মনোযোগ প্রকাশিত হচ্ছে। বাংলা সাহিত্যে ইত্যাকার রচনা সম্ভার ক্ষীণকায় তো নয়ই, পাঠকপ্রিয়ও যথেষ্ট ছিল সমকালে এবং এখনও সেগুলির কিছু কিছু উজ্জ্বল অবস্থানেই রয়েছে।কিন্তু বর্তমান সময়ের এই ধারার রচনারীতি, বিষয় এবং নির্মাণকৌশলে যেন স্বতন্ত্র স্বাদে বর্ণময়। তান্ত্রিক অনুষঙ্গ, মৃদু অথবা অতিরিক্ত বীভৎস রস এবং অন্যান্য উপকরণে সেগুলি অন্য মাত্রায় অবস্থিত। বেশির ভাগ পাঠকের কাছে এগুলি বেশ উপভোগ্যই।
সমকালীন এই ধারারই অন্যতম লেখক উপমন্যু রায়। তাঁর বিশেষত্ব এবং স্বাতন্ত্র যেখানে সেই ক্ষেত্রটিতে তিনি এই বিশেষ পর্যায়ে হাঁটলেও তাঁর রচনার মধ্যে অতিরিক্ত এবং দুর্লভ, এবং যেগুলি প্রয়োজনীয় এবং সুস্বাদু, সেই রকম উপকরণ বহুল পরিমাণে ব্যবহার করেন।
ইতিপূর্বে প্রকাশিত তাঁর গ্রন্থগুলিতে এগুলির উপস্থিতি আর প্রয়োগ সঠিক ভাবে প্রাসঙ্গিক। এখানেই তাঁর কৃতিত্ব এবং অনন্য স্বাক্ষর। তিনি অবশ্য তাঁর কোনও রচনায় এ পর্যন্ত অতিরিক্ত বীভৎস রস অথবা ভয়ঙ্করতাকে প্রশ্রয় দেননি। তাঁর আন্তর্জাতিক পটভূমিতে রচিত উপন্যাসগুলিতে অতিরিক্ত প্রাপ্তি এবং বিরল নিদর্শন হিসাবে আমরা পেয়ে যাই বিদেশের চিত্রিত শহর বা দেশটি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য।
কিন্তু সেই দেশ সংক্রান্ত তথ্যগুলি অবশ্যই গ্রন্থপ্রসঙ্গ সম্পর্কীয়। নির্দিষ্ট এবং লেখক-নির্বাচিত কাহিনির সঙ্গে সেগুলি সম্পূর্ণ ভাবেই সম্পৃক্ত এবং প্রয়োজনীয়। উপমন্যুর বিদেশের পটভূমিতে রচিত উপন্যাসে পাঠক পরিচিত হন সেই দেশ বা নির্দিষ্ট শহরটির সংস্কৃতি এবং বিষয়ানুগ বিষয়গুলির সঙ্গে অতিরিক্ত আন্তরিকতায়।
উপমন্যু রায়ের রচনার সবচেয়ে বড় এবং উল্লেখ্য বৈশিষ্ট্য তিনি কখনওই একটিও অপ্রয়োজনীয় শব্দ উচ্চারণ করেন না। প্রকৃত নির্মেদ তাঁর সমগ্র রচনার শরীর। অসাধারণ শব্দশিল্পীর মতোই তাঁর সার্বিক ও সচেতন প্রয়োগে অনবদ্য ও অনুপম হয়ে ওঠে বিস্ময়কর রচনা সম্ভার। স্পষ্ট ও প্রত্যক্ষ ভাবে তিনি অঙ্কন করেন তাৎক্ষণিক পটভূমি। তাঁর তথ্যনিষ্ট উচ্চারণগুলিও প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয়। পাঠকদের প্রচুর প্রাপ্তি ঘটে তাঁর এই রকমের উপন্যাসগুলিতে।
লেখকের নির্দিষ্ট বৃত্তটির মধ্যে অনেকখানি স্থান জুড়ে রয়েছে ভৌতিক এবং অলৌকিকত্বের রহস্য রোমাঞ্চের একটি বিস্তৃত ক্ষেত্র। এখানেও তাঁর কৃতিত্ব, নৈপুণ্য ও স্বাতন্ত্র প্রকাশিত এবং প্রমাণিত।
‘মৃত্যুর রং নীল’ শীর্ষক উপমন্যু রায়ের গ্রন্থটিতে রয়েছে দুটি উপন্যাস। প্রথম রচনার নাম ‘হেঁটে যায় দীর্ঘ ছায়া’ এবং দ্বিতীয়টি গ্রন্থনামের।
প্রথম উপন্যাসটি কয়েক বছর আগে একটি পত্রিকার শারদীয় সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল সন্ন্যাসী সেন লেখক-নামে।
এই উপন্যাসটিতে লেখক স্কটল্যান্ডের রাজধানী শহর এডিনবার্গের পটভূমিতে তীব্র এবং টানটান এক রহস্য কাহিনি, যেটি মূলত অলৌকিকতার উপাদানে জীবন্ত ভাবে সমৃদ্ধ, এঁকেছেন সহজ ও বিশ্বাসযোগ্য চিত্রায়ণের উচ্চারণে।
পাঠক এখানে তথ্যগত ভাবে শহরটির নানান বিষয়, বিশেষত সেখানকার বিস্ময়কর এবং ব্যাখ্যাতীত ঘটনাবলির বিবরণ পেয়ে যান। কাহিনির নায়ক শরদ্বানকে কেন্দ্র করে ঘটনাবলি, যেগুলি প্রকৃতই শিহরণময় এবং তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রেমিকা ক্লারা, বন্ধু অ্যানিস, কেনেথ, জ্যাক প্রমুখ চরিত্রের সুনিপুণ চিত্রণ, তাদের কাহিনিসূত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা উপন্যাসটিকে রুদ্ধশ্বাস একটি পঠনপ্রবাহে পৌঁছে দিয়েছে। পাঠক থামতেই পারেন না, শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত তঁার উৎকণ্ঠাময় পাঠগতি অব্যাহত থাকে! গ্রন্থপাঠক স্তম্ভিত হয়ে পড়েন রহস্যময়তার তীব্রতা এবং অভিনবত্বে। একই সঙ্গে তঁার ঘনিষ্ঠ এবং তথ্যময় পরিচয় হয়ে যায় একটি দেশ এবং সেটির প্রধান শহরের সঙ্গে।
অন্য উপন্যাসটির নাম ‘মৃত্যুর রং নীল’। এখানে লেখক তনুময় নামের এক যুবক, যে এই গ্রন্থটির নায়ক, তার সঙ্গে সমান্তরাল ভাবে বর্ণিত বন্ধু ঋষাঙ্ক চক্রবর্তীকে নিয়ে তীব্র এবং ভয়ানক শিহরণময় এক কাহিনির দ্রুতগামী স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে গেছেন পাঠ্যরস গ্রহীতাদের। অসাধারণ আবহে, অচিন্ত্যনীয় ঘটনা প্রবাহে, বিস্ময়কর পরিস্থিতির রুদ্ধশ্বাস তীব্রতায় সমগ্র কাহিনি নিপুণভাবে চিত্রিত হয়েছে।
আসলে তনুময়ের একদার প্রিয় বন্ধু ঋষাঙ্ক এখন মৃত। বিদেহী সে তনুময়কে তার বাড়িতে আমন্ত্রণ করে আনার পর একের পর এক ঘটতে থাকে হাড়হিম করা ঘটনাবলি।
উপমন্যুর গ্রন্থটি বিশেষ এই সাহিত্য ধারায় অবশ্যই একটি মূল্যবান ও স্বতন্ত্র সংযোজন।
মৃত্যুর রং নীল
পত্রপাঠ প্রকাশনী
মূল্য ৩২৫ টাকা

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন