কাস্তেটা দাও শান হো... গেরণ মুক্ত সূর্যে বার্তা সোস্যালিস্টদের

মাটির পৃথিবীতে রূঢ় বাস্তবটিকে মনে করিয়ে দিল সোস্যালিস্ট পার্টি অফ নর্থ ক‌্যারোলিনা-র একটি ফেসবুক পোস্ট। বলল, কাস্তেটা শান দেওয়ার সময় এসেছে আবার। লিখছেন দ্বৈপায়ন কর
 
কাস্তেটা দাও শান হো...গেরন মুক্ত সূর্য দেখিয়ে বার্তা সোশ্যালিস্টদের

‘ভোট দিন বাঁচতে, তারা হাতুড়ি কাস্তে’।

বাংলায় বহু পরিচিত নির্বাচনী স্লোগান ছিল সিপিআইএমের। বাংলায় রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ক্রমে সেই ভারতের মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টির নির্বাচনী প্রতিকের সেই স্লোগান যেমন ম্লান হয়েছে, তেমনই হয়তো মেহনতি মানুষের রুটি-রুজির প্রতিক কাস্তে-হাতুড়ির প্রতি আস্থাও কমে এসেছে! তবে, তা ফের মনে করিয়ে দিল একটি ফেসবুক পেজ।

আমেরিকার আকাশে সাম্প্রতিক পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ ঘিরে বিশ্ববাসী মার্কিনীদের মধ্যে উৎসবের মেজাজ লক্ষ‌্য করেছে। সেদেশের কত কবি হয়তো কবিতা লিখেছেন, না জানি কত শিল্পীর তুলিতে ক‌্যানভাসে তোলা থাকল সেই মুহুর্ত, আবার কত ফটোগ্রাফারের ক‌্যামেরায় ধরা থাকল ‌‘ডায়মন্ড রিং’। কত প্রেমিক-প্রেমিকা এই মহার্ঘ‌্য মহাজাগতিক মুহূর্তটিকে তাঁদের জীবনে অবিস্মরণীয় করে রাখলো বটে, কিন্তু সেই মাটির পৃথিবীতে রূঢ় বাস্তবটিকে মনে করিয়ে দিল সোস্যালিস্ট পার্টি অফ নর্থ ক‌্যারোলিনা (সোসালিস্ট পার্টি ইউএসএ ইন নর্থ ক‌্যারোলিনা) - একটি ফেসবুক পোস্ট।

সূর্য ও চন্দ্রের আবর্তন যখন আমেরিকার আকাশকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল, সেই সময় একটি সূক্ষ্ম অথচ গভীর রাজনৈতিক প্রতীকের আবির্ভাব মহাজাগতিক ক্ষেত্রকে অতিক্রম করে বিশ্বের সর্বত্র জীবনযুদ্ধে রত মানুষের মনে গভীর ছায়া ফেলে। নর্থ ক্যারোলিনার সোশ্যালিস্ট পার্টির ফেসবুক পৃষ্ঠায় একটি ছবিতে চাঁদের আড়াল থেকে উদিত বাঁকা সূর্যকে কাস্তের ফলা হিসাবে চিত্রিত করে তার সঙ্গে একটি হাতুড়ি যুক্ত করা হয়েছে, যা কমিউনিজমের কালজয়ী প্রতীক। এ ছবি পুঁজিবাদের ছায়ার মধ্যে বামপন্থী মতাদর্শের স্থায়ী সংগ্রামের প্রতীক হয়ে থাকবে চিরকাল। হয়তো, এ ছবি আমেরিকা এবং বৃহত্তরভাবে সমগ্র বিশ্বের বর্তমান রাজনীতির পরিস্থিতির একটি প্রতিফলন। অর্থাৎ, আবার কাস্তেটা শান দেওয়ার সময় এসেছে। তাতে সঙ্গত করবে হাতুড়ি।

hammer and sickle

বাংলা কাব্যে চাঁদকে বহুবার কাস্তের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। কবি জীবনানন্দ দাস তাঁর ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ (১৯৩৬) কাব‌্যগ্রন্থে ‘পিপাসার গান’ কবিতায় লিখেছিলেন, ‘কাস্তের মতো বাঁকা চাঁদ/ঢালিয়াছে আলো।’ কবিতাটি তারও দু’বছর আগে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘প্রগতি’ পত্রিকায়। এরপর কাস্তে– চাঁদের প্রতিকে প্রতিবাদের ভাষা হয়ে উঠেছে। কবি দিনেশ দাস-এর ‘কাস্তে’ কবিতাটি ১৯৩৮ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাঠক ও লেখক মহলে সাড়া পড়ে যায়। তাতে অনুপ্রাণিত হয়ে কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত এবং কবি বিষ্ণু দে ‘এ যুগের চাঁদ হল কাস্তে’ নামে দুটি কবিতা লেখেন। ‘অলকা’ পত্রিকায় ওই নামেই নারায়ণ গঙ্গোপাধ‌্যায়ের একটি ছোটগল্পও প্রকাশিত হয়।

‘হেই সামালো ধান হো, কাস্তেটা দাও শান হো’। সলিল চৌধুরীর গানে যৌবনে শিহরিত হননি এমন বাঙালি খুব কমই আছেন। সেই গানে বার্তা ছিল, নিজের পরিশ্রমে ফলানো সোনার ফসল কাটতে কাস্তে যেমন জরুরি, সেটি দিয়েই পরিশ্রমের ফসল রক্ষাও করতে হবে প্রয়োজনে। কাস্তে কৃষির প্রতিক। যে কোনও বাধা-বিঘ্ন, বৈজ্ঞানিক অস্ত্রশস্ত্রের বিরুদ্ধে আনায়াসে কাস্তে রুখে দাঁড়াতে পারে। সেটি প্রাণ হরণ করে না, তবে প্রাণ রক্ষাকারী বটে। আর এই কাস্তে যাদের হাতিয়ার সেইসব কৃষকদল মেহনতি মানুষের দল। আজ থেকে ৯০ বছর আগে কবি দিনেশ দাস ‘কাস্তে’ কবিতায় রূঢ় বাস্তবে চাঁদের মায়ায় আচ্ছন্ন না থেকে চাঁদকেই হাতিয়ার করার আহ্বান জানিয়েছিলেন।

আশ্চর্যজনকভাবে ৯০ বছর পূর্বে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দোরগড়ায় থাকা পৃথিবীর সঙ্গে আজকের পৃথিবীর বহু ক্ষেত্রেই মিল পাওয়া যাচ্ছে। সে কারণে ক‌্যারোলিনার সোস‌্যালিস্ট পার্টির ফেসবুক পেজের ছবিটি অত‌্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। শুধু বাঁকা চাঁদের জায়গা নিয়েছে গেরন-মুক্ত নব সূর্য। তারা মনে করিয়ে দিতে চেয়েছে, রূঢ় বাস্তবে ‘ডায়মন্ড রিং’-এর মায়ায় আচ্ছন্ন না থেকে সূর্যকেই ‘হাতিয়ার’ করতে হবে। যন্ত্রসভ‌্যতা ও আণবিক যুগের নিয়ন্ত্রকরা ভেবেছিল গোলা-বারুদই শক্তির উৎস। কিন্তু, দু’টি বিশ্বযুদ্ধ দেখিয়েছে এই শক্তি প্রতিযোগিতা কতটা মারাত্মক। মানবসভ‌্যতা ধংস করার খেলায় মেতে ওঠায় কোনও কৃতিত্ব নেই। তাই সৃষ্টির আহ্বান। তাই আকাশ নয়, মাটিতে তাকানোর আহ্বান।

বুর্জোয়া রোমান্টিকতাবাদে এই সূর্যগ্রহনকে বিস্ময়ের একটি ক্ষণস্থায়ী মুহূর্ত হিসাবে দেখা যেতে পারে এবং এটি প্রাত্যহিক জীবনের জাগতিকতায় ফিরে আসার আগে একটি মনোরম দৃশ‌্য মাত্র। তবুও, অন্যদের জন্য, বিশেষ করে উত্তর ক্যারোলিনার সোশ্যালিস্ট পার্টির মধ্যে। ওই মহাজাগতিক পর্বটি একটি গভীর তাৎপর্য বহন করে– যা পুঁজিবাদী নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং আরও ন্যায়সঙ্গত সমাজের সন্ধানের প্রতীক। বহু যুগ এই ছবি বিশ্বের মেহনতি মানুষকে উদ্বুদ্ধ করবে।


Post a Comment

Previous Post Next Post