দেখা গিয়েছে তথাকথিত বড় হাউসগুলি যে পাণ্ডুলিপিতে উৎসাহই দেখাননি, কোনও ছোট প্রকাশনা সংস্থা তা প্রকাশের পর হই-চই ফেলে দিয়েছে পাঠক মহলে। এমনকী বড় স্বীকৃতিও মিলেছে। পেয়েছে বুকার প্রাইজ।
দ্বৈপায়ন কর
বুকার প্রাইজ (Booker Prize) ইংরেজি ভাষার কথাসাহিত্যের জন্য একটি বড় স্বীকৃতি হিসাবে পরিগণিত হয়। এটি একজন লেখক এবং তাঁদের বইয়ের জন্য দুর্দান্ত সাফল্য। কিন্তু, সাম্প্রতিক বছরগুলিতে দেখা গিয়েছে যে বুকার প্রাইজ জয়ের পথটি প্রায়শই মসৃণ নয়। প্রত্যাখ্যান এবং হতাশার দীর্ঘ পথ পেরিয়ে তাদের এই জয়ে পৌঁঁছতে হয়েছে। এখানে কয়েকটি বইয়ের উল্লেখ করবো, যেগুলি বুকার প্রাইজ পেয়েছে বা বুকারের শর্ট লিস্টে জায়াগা পেয়েছে, কিন্তু সেগুলিই প্রকাশে উৎসাহ দেখায়নি বড় বড় প্রকাশনা সংস্থা। ফিরিয়ে দিয়েছে লেখকদের।
এই ধরনের বইগুলির মধ্যে প্রথমেই নাম করতে হয় ডগলাস স্টুয়ার্টের ‘শুগি বেইন’ (Shuggie Bain by Douglas Stuart)। বইটি ২০২০ সালে বুকার প্রাইজ পায়। স্টুয়ার্ট পেশায় একজন সফল ফ্যাশন ডিজাইনার। তাঁর কাজের ব্যস্ততার মধ্যেও এক দশক ধরে ‘শুগি বেইন’ লিখেছিলেন তিনি। পাণ্ডুলিপিটি আমেরিকান স্বাধীন প্রকাশক গ্রোভ আটলান্টিক কেনার আগে ৪০ জনের বেশি প্রকাশক সেটিকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয় আমেরিকায় ২০২০-র ১১ ফেব্রুয়ারি। গ্রোভ প্রেস হার্ডকভারে প্রকাশ করেছিল। পরে, ২০ ফেব্রুয়ারি প্যান ম্যাকমিলানের পিকাডর এটিকে প্রথমে ব্রিটেনে একটি সফটব্যাক ওপেন মার্কেট সংস্করণ হিসাবে প্রকাশ করে এবং ৬ আগস্ট হার্জ কভার আনে। ২০২১-এর এপ্রিল নাগাদ ডাচ, ফিনিশ, জর্জিয়ান, কোরিয়ান, মঙ্গোলিয়ান, পর্তুগিজ, সার্বিয়ান, তুর্কি , ইউক্রেনীয় এবং ভিয়েতনামী, মারাঠি, তামিল সহ ৩৮টি ভাষায় বইটির স্বত্ব বিক্রি করা হয়। ক্রিয়েটিভ স্কটল্যান্ডের সহায়তায় পাবলিশিং স্কটল্যান্ড ট্রান্সলেশন ফান্ড থেকে অনুদানের মাধ্যমে অনুবাদগুলি প্রকাশে অর্থায়ন করা হয়েছে।
বইটির প্রাথমিক প্রকাশ, সেই সময়ের কোভিড-১৯ অতিমারী পরিস্থিতি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। গ্রোভ প্রেস বইবিপণিগুলিতে প্রায় ৭০০০ কপি পাঠিয়েছিল, তবে এনপিডি বুকস্ক্যান ডেটা অনুসারে, প্রকাশের প্রথম দুই মাসে প্রায় ১ হাজার হার্ডকভার কপি বিক্রি হয়েছিল। ২০২০ সালের শেষের দিকে, বইটি পাঠকের মনোযোগ পায়, যখন সেটি অনেকগুলি সাহিত্য পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়। ২০২০-র অক্টোবর পর্যন্ত, গ্রোভ ৩০,০০০ কপি মুদ্রণ করেছিল। উপন্যাসটি লস এঞ্জেলেস টাইমসের বেস্টসেলার তালিকার শীর্ষে এবং নিউইয়র্ক টাইমসের তালিকায় ৩ নম্বরে উঠে আসে। ২০২২-এর এপ্রিল পর্যন্ত উপন্যাসটির বিশ্বব্যাপী ১৫ লক্ষের বেশি বেশি কপি বিক্রি করেছে।
দ্বিতীয়টি হল শ্রীলঙ্কার লেখক শিয়ান করুণাতিলাকার ‘দ্য সেভেন মুন অফ মালি আলমিদিয়া’ (The Seven Moons of Maali Almeida by Shehan Karunatilaka)। ২০২২ সালে তাঁর এই বইটি বুকার প্রাইজ পায়। প্রকৃতপক্ষে, এই শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধের পটভূমিতে লেখা উপন্যাসটি প্রথমে ২০২০ সালে ‘চ্যাটস উইথ দ্য ডেড’ নামে ভারতে প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু, সেটি ব্রিটেনে বিক্রির জন্য বন্দোবস্ত করা যায়নি। লেখকের এজেন্ট সরাসরি লণ্ডনের বড় প্রকাশনা সংস্থা জোনাথন কেপ-এ কথা বলতে গিয়েছিলেন। তবে তারা ফিরিয়ে দেয়। এরপর ২৫টি প্রকশন সংস্থার দরজা থেকে ফিরে আসতে হয়েছে তাঁদের। লেখকের কথায় ব্রিটেনের প্রকাশকরা একে একটি কঠিন বিষয় হিসাবে দেখেছিলেন। তাঁরা বইটি পশ্চিমী পাঠকদের কাছে বিক্রির সম্ভাবনা নিয়ে সন্দিহান ছিলেন।
এর মধ্যেই তাঁরা পৌঁছে যান একটি ক্ষুদ্র স্বাধীন প্রকাশনী ‘শর্ট অফ বুকস’-এ। নাটানিয়া জোনস আর মার্ক এলিংহাম, স্বামী-স্ত্রী মিলে প্রকাশনা সংস্থাটি চালান। ন্যাট নিজে শ্রীলঙ্কা থেকে এসেছিলেন, তাই তিনি করুণাতিলাকেকে আগে থেকেই চিনতেন। তাঁরা বইটি প্রকাশে রাজি হন, কিন্তু শর্ত দেন যে উপন্যাসটি অনেক সংশোধন করতে হবে। একটি লেখা বই আবার সংশোধন লেখকের কাছে অত্যন্ত চাপের। কিন্তু, তাতেও রাজি হয়ে যান করুণাতিলাকে। কারণ, তাঁর উদ্দেশ ছিল বেশি সংখ্যক পাঠকের কাছে পৌঁছনো। লেখক বলেছেন, প্রত্যাখ্যান বেশ হতাশাজনক ছিল। তাই যখন কেউ কিছু সংশোধনের শর্তে, সেটি তাঁর গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছিল। এটাই তাঁকে উপন্যাসটি পুনরায় লিখতে বাধ্য করেছিল। আবার এ কারণেই এই বইটির জন্য, একজন ছোট প্রকাশকই তাঁর সঠিক পছন্দ ছিল। তিনি বলেন, “যদি বড় কোনও সংস্থা বইটি প্রকাশ করতে রাজি হত, তারা কি তাদের প্রকাশনার সময়সূচী এবং অন্যান্য প্রচুর বই বই প্রকাশের ব্যস্ততায় এটিকে সংশোধন করতে দু-তিন বছর ব্যয় করত? তারা কি বুকার পুরস্কারের জন্য জমা দিতেন বইটি? সম্ভবত না।” তাঁর কথায়, এই সুযোগ একজন ছোট প্রকাশক দিতে পারে যা একটি বড় হাউস সক্ষম নাও হতে পারে। বৃহত্তর প্রকাশকদের সঙ্গে কাজ করে অবশ্যই, লেখকদের অগ্রগতি বেশি হতে পারে, অর্থ তাঁদের কাছে কোনও সমস্যা নয়। আসলে এমন একজনকে খুঁজে পেতে হবে, যারা বইটিতে আস্থা রাখবে। কখনও কখনও তাঁদের প্রচুর অর্থ থাকে কিন্তু উত্সাহ থাকে না।
কানাডিয়ান লেখক ইয়ান মার্টেলের ‘লাইফ অফ পাই’ (Life of Pi by Yann Martel) কে না পড়েছেন? অন্তত সিনেমার পর্দায় তো দেখছেন বটে। তা না হলেও নাম তো শুনেছেন অবশ্যই। অথচ, ২০০২ সালে বুকার প্রাইজ পাওয়া উপন্যাসটি প্রথমে লন্ডনের সমস্ত প্রকাশক ফিরিয়ে দিয়েছিল। মার্টেলের প্রথম বই– একটি উপন্যাস ও কয়েকটি গল্পের সংকলনের প্রকাশ করেছিল লন্ডনের স্বাধীন প্রকাশনা সংস্থা ফেবার অ্যান্ড ফেবার। তারা বইটির পাণ্ডুলিপি গ্রহণ করেছিল বটে, কিন্তু কোনও উৎসাহ দেখাচ্ছিল না। অথচ, মার্টেলের প্রথম দুটি বইয়ের রিভিউ মন্দ ছিল না। বিক্রি যদিও কম ছিল।
মার্টেল যখন নতুন উপন্যাসটি লিখে ফেললেন, নিজেই সেটা নিয়ে অত্যন্ত আশাবাদী ছিলেন। ভেবেছিলেন ভাল বিক্রি হবে বইটি। কারণস এটি একেবারে অন্য ধরণের একটি নৌকায় একটি বাঘের সঙ্গে এক কিশোর। যার সঙ্গে আর কোনও বইয়ের মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। কেউ বলতে পারবেন না, এটি ওই রকম। তবু, প্রায় সব প্রকাশকই সেই পাণ্ডুলিপি ফিরিয়ে দিলেন।
সেই শূন্যতা পূরণ করতে এগিয়ে এসেছিলেন একজন বহিরাগত। লন্ডনের বাইরের, এবং সেই সময়ে মূলধারার প্রকাশনারও বাইরে। ‘ক্যাননগেট’ স্কটল্যান্ডের একটি প্রকাশন সংস্থা, যারা তখন পর্যন্ত পর্বতারোহণের বই প্রকাশের জন্য পরিচিত ছিল। তার মালিক জেমি বাইং ‘লাইফ অফ পাই’ সম্পর্কে ‘অত্যন্ত উত্সাহী’ ছিলেন। ক্যাননগেটের একজন জুনিয়র সম্পাদক, ফ্রান্সিস বিকমোরের উৎসাহে বাইংকে রাজি করানো হয়েছিল। প্রথমে তিনি এক নিঃশ্বাসে পাণ্ডুলিপিটি শেষ করার পর বাইকিংকে পড়তে বলেন। তাঁরও পছন্দ হয় পাণ্ডুলিপিটি। তাঁরা উপন্যাসটি প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেন।
ফেবার অ্যান্ড ফেবারের মতোই অর্থ অফার করেছিল ক্যাননগেট। মার্টেলের কথায়, “কিন্তু অনেক বেশি উৎসাহ ছিল তাদের। আমাকে তো পেট চালাতে হবে। তাই আমি ক্যাননগেটের সঙ্গেই চুক্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। যা কিছুটা পাহাড় চূড়া থেকে লাফ দেওয়ার মতো মনে হয়েছিল। তবে সত্যি বলতে কি আমার কাছে অন্য অনেক বিকল্প ছিল না।” তারপর ‘লাইফ অফ পাই’ ইতিহাস সৃষ্টি করেছে।
২০১৯ সালে বুকার সংক্ষিপ্ত তালিকায় স্থান পেয়েছিল লুসি এলম্যানের ‘ডাকস, নিউবারিপোর্ট’ (Ducks, Newburyport by Lucy Ellmann review)। বইটি ২০১৯ সালেই গোল্ডস্মিথ পুরস্কার জিতেছিল। অথচ এই বইটির ভাগ্যেও জুটেছিল প্রত্যাখ্যান। নতুন একটি আঙ্গিকে লেখা হাজার পৃষ্ঠার বইটি প্রকাশের ঝুঁকি নেয়নি প্রায় কোনও প্রকাশকই। তাঁদের মধ্যে ব্লুমসবারি’র মতো কয়েকজনের সঙ্গে লুসি দীর্ঘ সময় কাজ করেছেন। প্রকাশকরা এই বলে নাকচ করে দিয়েছিল যে এটি অনেক দীর্ঘ, এর খুব বেশি পাঠক নেই। সেখানে কোনও গল্প নেই।”
অথচ ততদিনে সাহিত্য রচনার শৈলী অনেক বদলে যাচ্ছে। যেমন, লুসির উপন্যাসটি রচিত হয়েছে চেতনার বর্ণনামূলক শৈলীর স্রোতে, এবং একটি দীর্ঘ বাক্য নিয়ে গঠিত, সংক্ষিপ্ত ধারাগুলি যা ‘দ্যা ফ্যাক্ট দ্যাট’ বাক্যাংশ দিয়ে শুরু হয়। এটি উপন্যাসে ১৯ হাজার বারের বেশি ব্যবহার হয়েছে। কিন্তু, নামি প্রকাশকরা ঝুঁকি নিয়ে রাজি ছিলেন না। ব্লুমসবারির কাছে হতাশ হয়ে লুসির এজেন্ট সরাসরি ফোন এলোইস মিলারকে। তিনি তাঁর স্বামী স্যাম জর্জিসনের সঙ্গে গ্যারি বেগার প্রেস নামে একটি প্রকাশনা সংস্থা চালাচ্ছে। ভিন্ন ধারার বই প্রকাশে তাদের বেশ নাম-ডাকও হয়েছে। তারা রাজি হয় লুসির নতুন বইটি প্রকাশে। জর্ডিসন পরে বলেছিলেন, “যদি আপনার একটি সাধারণ প্রকাশনার সময়সূচি এবং আরও ২০টি বই থাকে যা মনোযোগের জন্য দাবি রাখে যে সেগুলি নির্দিষ্ট নিয়মে করতে হবে, তাহলে একটি হাজার পৃষ্ঠার বই একটি ঝুঁকির মতো মনে হয়। তবে এটি আমাদের কাছে খুব বেশি ঝুঁকির মতো মনে হয়নি কারণ আমরা লুসির মতো বই বের করার জন্য পৃথিবীতে আছি। পরে বইটি সাফল্য পায়। বইটি যত বেশি সাফল্য পেয়েছে ব্লুমসবারি আতঙ্কিত হয়েছে। সংস্থার এক প্রাক্তন কর্তা পরে বলেছিলেন, তবে তাঁরা ভুল করেনি, কারণ তারা যদি এটি প্রকাশ করত তবে এটি কখনওই বুকারের প্রতিযোগিতায় প্রবেশ করত না। ইটি নিয়ে গ্যারি বেগারের কাছে যাওয়া লুসির একদম সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল।
একটি বই শুধু তখনই সফল হতে পারে যদি প্রকাশকের তার উপর আস্থা থাকে। প্রকাশনায় আবেগ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অন্তত বড় প্রকাশকদের ক্ষেত্রে বিক্রয় এবং বিপণন টিমের সমর্থনের অভাবকে অস্বীকার করা যায় না, যাদের ইনপুট আজকের দিনে আরও শক্তিশালী।
আলেকজান্দ্রা প্রিংলের ‘ডেবোরা লেভি’র সঙ্গেও একই ঘটনা ঘটে। তাঁর উপন্যাস ‘সুইমিং হোম’ (Swimming Home by Deborah Levy) ২০১১ সালে বুকার প্রাইজের জন্য সংক্ষিপ্ত তালিকাভুক্ত হয়েছিল। লেভির প্রাক্তন এজেন্ট, ব্লুমসবারির একজন অন্যতম সম্পাদক খুব আশাবাদী ছিলেন বইটি নিয়ে। কিন্তু, সম্পাদকীয় টিমকে তিনি বইটি নিয়ে বোঝাতে ব্যর্থ হন। উপন্যাসের চরিত্রগুলি তাঁদের পছন্দ হয়নি। তাঁরা উপন্যাসটি প্রকাশের প্রস্তাব পত্রপাঠ নাকচ করে দেন। বইটি পরে প্রকাশ করে শেফিল্ডের একটি ইন্ডিপেন্ডেন্ট প্রকাশনা সংস্থা ‘অ্যান্ড আদার স্টোরিজ’। সেই বই-ই পরে পাঠক মহলে দুর্দান্ত সাড়া ফেলে।
‘সুইমিং হোম’ বা ‘ডাকস, নিউবারিপোর্ট’-এর মতো উপন্যাসগুলি যখন কোনও মূলধারার বড় প্রকাশন সংস্থাগুলি প্রকাশ করতে পারে না, বা ‘শুগি বেইন’-এর মতো কোনও উপন্যাসকে একটি প্রকাশক পেতে লড়াই করতে হয়, তখন এই প্রশ্ন জাগে যে এটি কি প্রকাশনা জগতের বড় ব্যর্থতা নয়?
দ্বৈপায়ন কর
বুকার প্রাইজ (Booker Prize) ইংরেজি ভাষার কথাসাহিত্যের জন্য একটি বড় স্বীকৃতি হিসাবে পরিগণিত হয়। এটি একজন লেখক এবং তাঁদের বইয়ের জন্য দুর্দান্ত সাফল্য। কিন্তু, সাম্প্রতিক বছরগুলিতে দেখা গিয়েছে যে বুকার প্রাইজ জয়ের পথটি প্রায়শই মসৃণ নয়। প্রত্যাখ্যান এবং হতাশার দীর্ঘ পথ পেরিয়ে তাদের এই জয়ে পৌঁঁছতে হয়েছে। এখানে কয়েকটি বইয়ের উল্লেখ করবো, যেগুলি বুকার প্রাইজ পেয়েছে বা বুকারের শর্ট লিস্টে জায়াগা পেয়েছে, কিন্তু সেগুলিই প্রকাশে উৎসাহ দেখায়নি বড় বড় প্রকাশনা সংস্থা। ফিরিয়ে দিয়েছে লেখকদের।
এই ধরনের বইগুলির মধ্যে প্রথমেই নাম করতে হয় ডগলাস স্টুয়ার্টের ‘শুগি বেইন’ (Shuggie Bain by Douglas Stuart)। বইটি ২০২০ সালে বুকার প্রাইজ পায়। স্টুয়ার্ট পেশায় একজন সফল ফ্যাশন ডিজাইনার। তাঁর কাজের ব্যস্ততার মধ্যেও এক দশক ধরে ‘শুগি বেইন’ লিখেছিলেন তিনি। পাণ্ডুলিপিটি আমেরিকান স্বাধীন প্রকাশক গ্রোভ আটলান্টিক কেনার আগে ৪০ জনের বেশি প্রকাশক সেটিকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয় আমেরিকায় ২০২০-র ১১ ফেব্রুয়ারি। গ্রোভ প্রেস হার্ডকভারে প্রকাশ করেছিল। পরে, ২০ ফেব্রুয়ারি প্যান ম্যাকমিলানের পিকাডর এটিকে প্রথমে ব্রিটেনে একটি সফটব্যাক ওপেন মার্কেট সংস্করণ হিসাবে প্রকাশ করে এবং ৬ আগস্ট হার্জ কভার আনে। ২০২১-এর এপ্রিল নাগাদ ডাচ, ফিনিশ, জর্জিয়ান, কোরিয়ান, মঙ্গোলিয়ান, পর্তুগিজ, সার্বিয়ান, তুর্কি , ইউক্রেনীয় এবং ভিয়েতনামী, মারাঠি, তামিল সহ ৩৮টি ভাষায় বইটির স্বত্ব বিক্রি করা হয়। ক্রিয়েটিভ স্কটল্যান্ডের সহায়তায় পাবলিশিং স্কটল্যান্ড ট্রান্সলেশন ফান্ড থেকে অনুদানের মাধ্যমে অনুবাদগুলি প্রকাশে অর্থায়ন করা হয়েছে।
বইটির প্রাথমিক প্রকাশ, সেই সময়ের কোভিড-১৯ অতিমারী পরিস্থিতি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। গ্রোভ প্রেস বইবিপণিগুলিতে প্রায় ৭০০০ কপি পাঠিয়েছিল, তবে এনপিডি বুকস্ক্যান ডেটা অনুসারে, প্রকাশের প্রথম দুই মাসে প্রায় ১ হাজার হার্ডকভার কপি বিক্রি হয়েছিল। ২০২০ সালের শেষের দিকে, বইটি পাঠকের মনোযোগ পায়, যখন সেটি অনেকগুলি সাহিত্য পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়। ২০২০-র অক্টোবর পর্যন্ত, গ্রোভ ৩০,০০০ কপি মুদ্রণ করেছিল। উপন্যাসটি লস এঞ্জেলেস টাইমসের বেস্টসেলার তালিকার শীর্ষে এবং নিউইয়র্ক টাইমসের তালিকায় ৩ নম্বরে উঠে আসে। ২০২২-এর এপ্রিল পর্যন্ত উপন্যাসটির বিশ্বব্যাপী ১৫ লক্ষের বেশি বেশি কপি বিক্রি করেছে।
দ্বিতীয়টি হল শ্রীলঙ্কার লেখক শিয়ান করুণাতিলাকার ‘দ্য সেভেন মুন অফ মালি আলমিদিয়া’ (The Seven Moons of Maali Almeida by Shehan Karunatilaka)। ২০২২ সালে তাঁর এই বইটি বুকার প্রাইজ পায়। প্রকৃতপক্ষে, এই শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধের পটভূমিতে লেখা উপন্যাসটি প্রথমে ২০২০ সালে ‘চ্যাটস উইথ দ্য ডেড’ নামে ভারতে প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু, সেটি ব্রিটেনে বিক্রির জন্য বন্দোবস্ত করা যায়নি। লেখকের এজেন্ট সরাসরি লণ্ডনের বড় প্রকাশনা সংস্থা জোনাথন কেপ-এ কথা বলতে গিয়েছিলেন। তবে তারা ফিরিয়ে দেয়। এরপর ২৫টি প্রকশন সংস্থার দরজা থেকে ফিরে আসতে হয়েছে তাঁদের। লেখকের কথায় ব্রিটেনের প্রকাশকরা একে একটি কঠিন বিষয় হিসাবে দেখেছিলেন। তাঁরা বইটি পশ্চিমী পাঠকদের কাছে বিক্রির সম্ভাবনা নিয়ে সন্দিহান ছিলেন।
এর মধ্যেই তাঁরা পৌঁছে যান একটি ক্ষুদ্র স্বাধীন প্রকাশনী ‘শর্ট অফ বুকস’-এ। নাটানিয়া জোনস আর মার্ক এলিংহাম, স্বামী-স্ত্রী মিলে প্রকাশনা সংস্থাটি চালান। ন্যাট নিজে শ্রীলঙ্কা থেকে এসেছিলেন, তাই তিনি করুণাতিলাকেকে আগে থেকেই চিনতেন। তাঁরা বইটি প্রকাশে রাজি হন, কিন্তু শর্ত দেন যে উপন্যাসটি অনেক সংশোধন করতে হবে। একটি লেখা বই আবার সংশোধন লেখকের কাছে অত্যন্ত চাপের। কিন্তু, তাতেও রাজি হয়ে যান করুণাতিলাকে। কারণ, তাঁর উদ্দেশ ছিল বেশি সংখ্যক পাঠকের কাছে পৌঁছনো। লেখক বলেছেন, প্রত্যাখ্যান বেশ হতাশাজনক ছিল। তাই যখন কেউ কিছু সংশোধনের শর্তে, সেটি তাঁর গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছিল। এটাই তাঁকে উপন্যাসটি পুনরায় লিখতে বাধ্য করেছিল। আবার এ কারণেই এই বইটির জন্য, একজন ছোট প্রকাশকই তাঁর সঠিক পছন্দ ছিল। তিনি বলেন, “যদি বড় কোনও সংস্থা বইটি প্রকাশ করতে রাজি হত, তারা কি তাদের প্রকাশনার সময়সূচী এবং অন্যান্য প্রচুর বই বই প্রকাশের ব্যস্ততায় এটিকে সংশোধন করতে দু-তিন বছর ব্যয় করত? তারা কি বুকার পুরস্কারের জন্য জমা দিতেন বইটি? সম্ভবত না।” তাঁর কথায়, এই সুযোগ একজন ছোট প্রকাশক দিতে পারে যা একটি বড় হাউস সক্ষম নাও হতে পারে। বৃহত্তর প্রকাশকদের সঙ্গে কাজ করে অবশ্যই, লেখকদের অগ্রগতি বেশি হতে পারে, অর্থ তাঁদের কাছে কোনও সমস্যা নয়। আসলে এমন একজনকে খুঁজে পেতে হবে, যারা বইটিতে আস্থা রাখবে। কখনও কখনও তাঁদের প্রচুর অর্থ থাকে কিন্তু উত্সাহ থাকে না।
কানাডিয়ান লেখক ইয়ান মার্টেলের ‘লাইফ অফ পাই’ (Life of Pi by Yann Martel) কে না পড়েছেন? অন্তত সিনেমার পর্দায় তো দেখছেন বটে। তা না হলেও নাম তো শুনেছেন অবশ্যই। অথচ, ২০০২ সালে বুকার প্রাইজ পাওয়া উপন্যাসটি প্রথমে লন্ডনের সমস্ত প্রকাশক ফিরিয়ে দিয়েছিল। মার্টেলের প্রথম বই– একটি উপন্যাস ও কয়েকটি গল্পের সংকলনের প্রকাশ করেছিল লন্ডনের স্বাধীন প্রকাশনা সংস্থা ফেবার অ্যান্ড ফেবার। তারা বইটির পাণ্ডুলিপি গ্রহণ করেছিল বটে, কিন্তু কোনও উৎসাহ দেখাচ্ছিল না। অথচ, মার্টেলের প্রথম দুটি বইয়ের রিভিউ মন্দ ছিল না। বিক্রি যদিও কম ছিল।
মার্টেল যখন নতুন উপন্যাসটি লিখে ফেললেন, নিজেই সেটা নিয়ে অত্যন্ত আশাবাদী ছিলেন। ভেবেছিলেন ভাল বিক্রি হবে বইটি। কারণস এটি একেবারে অন্য ধরণের একটি নৌকায় একটি বাঘের সঙ্গে এক কিশোর। যার সঙ্গে আর কোনও বইয়ের মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। কেউ বলতে পারবেন না, এটি ওই রকম। তবু, প্রায় সব প্রকাশকই সেই পাণ্ডুলিপি ফিরিয়ে দিলেন।
সেই শূন্যতা পূরণ করতে এগিয়ে এসেছিলেন একজন বহিরাগত। লন্ডনের বাইরের, এবং সেই সময়ে মূলধারার প্রকাশনারও বাইরে। ‘ক্যাননগেট’ স্কটল্যান্ডের একটি প্রকাশন সংস্থা, যারা তখন পর্যন্ত পর্বতারোহণের বই প্রকাশের জন্য পরিচিত ছিল। তার মালিক জেমি বাইং ‘লাইফ অফ পাই’ সম্পর্কে ‘অত্যন্ত উত্সাহী’ ছিলেন। ক্যাননগেটের একজন জুনিয়র সম্পাদক, ফ্রান্সিস বিকমোরের উৎসাহে বাইংকে রাজি করানো হয়েছিল। প্রথমে তিনি এক নিঃশ্বাসে পাণ্ডুলিপিটি শেষ করার পর বাইকিংকে পড়তে বলেন। তাঁরও পছন্দ হয় পাণ্ডুলিপিটি। তাঁরা উপন্যাসটি প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেন।
ফেবার অ্যান্ড ফেবারের মতোই অর্থ অফার করেছিল ক্যাননগেট। মার্টেলের কথায়, “কিন্তু অনেক বেশি উৎসাহ ছিল তাদের। আমাকে তো পেট চালাতে হবে। তাই আমি ক্যাননগেটের সঙ্গেই চুক্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। যা কিছুটা পাহাড় চূড়া থেকে লাফ দেওয়ার মতো মনে হয়েছিল। তবে সত্যি বলতে কি আমার কাছে অন্য অনেক বিকল্প ছিল না।” তারপর ‘লাইফ অফ পাই’ ইতিহাস সৃষ্টি করেছে।
২০১৯ সালে বুকার সংক্ষিপ্ত তালিকায় স্থান পেয়েছিল লুসি এলম্যানের ‘ডাকস, নিউবারিপোর্ট’ (Ducks, Newburyport by Lucy Ellmann review)। বইটি ২০১৯ সালেই গোল্ডস্মিথ পুরস্কার জিতেছিল। অথচ এই বইটির ভাগ্যেও জুটেছিল প্রত্যাখ্যান। নতুন একটি আঙ্গিকে লেখা হাজার পৃষ্ঠার বইটি প্রকাশের ঝুঁকি নেয়নি প্রায় কোনও প্রকাশকই। তাঁদের মধ্যে ব্লুমসবারি’র মতো কয়েকজনের সঙ্গে লুসি দীর্ঘ সময় কাজ করেছেন। প্রকাশকরা এই বলে নাকচ করে দিয়েছিল যে এটি অনেক দীর্ঘ, এর খুব বেশি পাঠক নেই। সেখানে কোনও গল্প নেই।”
অথচ ততদিনে সাহিত্য রচনার শৈলী অনেক বদলে যাচ্ছে। যেমন, লুসির উপন্যাসটি রচিত হয়েছে চেতনার বর্ণনামূলক শৈলীর স্রোতে, এবং একটি দীর্ঘ বাক্য নিয়ে গঠিত, সংক্ষিপ্ত ধারাগুলি যা ‘দ্যা ফ্যাক্ট দ্যাট’ বাক্যাংশ দিয়ে শুরু হয়। এটি উপন্যাসে ১৯ হাজার বারের বেশি ব্যবহার হয়েছে। কিন্তু, নামি প্রকাশকরা ঝুঁকি নিয়ে রাজি ছিলেন না। ব্লুমসবারির কাছে হতাশ হয়ে লুসির এজেন্ট সরাসরি ফোন এলোইস মিলারকে। তিনি তাঁর স্বামী স্যাম জর্জিসনের সঙ্গে গ্যারি বেগার প্রেস নামে একটি প্রকাশনা সংস্থা চালাচ্ছে। ভিন্ন ধারার বই প্রকাশে তাদের বেশ নাম-ডাকও হয়েছে। তারা রাজি হয় লুসির নতুন বইটি প্রকাশে। জর্ডিসন পরে বলেছিলেন, “যদি আপনার একটি সাধারণ প্রকাশনার সময়সূচি এবং আরও ২০টি বই থাকে যা মনোযোগের জন্য দাবি রাখে যে সেগুলি নির্দিষ্ট নিয়মে করতে হবে, তাহলে একটি হাজার পৃষ্ঠার বই একটি ঝুঁকির মতো মনে হয়। তবে এটি আমাদের কাছে খুব বেশি ঝুঁকির মতো মনে হয়নি কারণ আমরা লুসির মতো বই বের করার জন্য পৃথিবীতে আছি। পরে বইটি সাফল্য পায়। বইটি যত বেশি সাফল্য পেয়েছে ব্লুমসবারি আতঙ্কিত হয়েছে। সংস্থার এক প্রাক্তন কর্তা পরে বলেছিলেন, তবে তাঁরা ভুল করেনি, কারণ তারা যদি এটি প্রকাশ করত তবে এটি কখনওই বুকারের প্রতিযোগিতায় প্রবেশ করত না। ইটি নিয়ে গ্যারি বেগারের কাছে যাওয়া লুসির একদম সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল।
একটি বই শুধু তখনই সফল হতে পারে যদি প্রকাশকের তার উপর আস্থা থাকে। প্রকাশনায় আবেগ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অন্তত বড় প্রকাশকদের ক্ষেত্রে বিক্রয় এবং বিপণন টিমের সমর্থনের অভাবকে অস্বীকার করা যায় না, যাদের ইনপুট আজকের দিনে আরও শক্তিশালী।
আলেকজান্দ্রা প্রিংলের ‘ডেবোরা লেভি’র সঙ্গেও একই ঘটনা ঘটে। তাঁর উপন্যাস ‘সুইমিং হোম’ (Swimming Home by Deborah Levy) ২০১১ সালে বুকার প্রাইজের জন্য সংক্ষিপ্ত তালিকাভুক্ত হয়েছিল। লেভির প্রাক্তন এজেন্ট, ব্লুমসবারির একজন অন্যতম সম্পাদক খুব আশাবাদী ছিলেন বইটি নিয়ে। কিন্তু, সম্পাদকীয় টিমকে তিনি বইটি নিয়ে বোঝাতে ব্যর্থ হন। উপন্যাসের চরিত্রগুলি তাঁদের পছন্দ হয়নি। তাঁরা উপন্যাসটি প্রকাশের প্রস্তাব পত্রপাঠ নাকচ করে দেন। বইটি পরে প্রকাশ করে শেফিল্ডের একটি ইন্ডিপেন্ডেন্ট প্রকাশনা সংস্থা ‘অ্যান্ড আদার স্টোরিজ’। সেই বই-ই পরে পাঠক মহলে দুর্দান্ত সাড়া ফেলে।
‘সুইমিং হোম’ বা ‘ডাকস, নিউবারিপোর্ট’-এর মতো উপন্যাসগুলি যখন কোনও মূলধারার বড় প্রকাশন সংস্থাগুলি প্রকাশ করতে পারে না, বা ‘শুগি বেইন’-এর মতো কোনও উপন্যাসকে একটি প্রকাশক পেতে লড়াই করতে হয়, তখন এই প্রশ্ন জাগে যে এটি কি প্রকাশনা জগতের বড় ব্যর্থতা নয়?
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন