মনোসংযোগে ত্রুটি হলে টেলিফোনে রং নাম্বার লেগে যাওয়ার মতো অনাহুত, অতৃপ্ত আত্মারা চলে আসে। এমন অভিজ্ঞতা আমার বহু প্রেত বৈঠকেই হয়েছে।
বলাই চলে গেল। আমি ওকে আটকালাম না। কোনও চেষ্টা করিনি। তাতে লাভও কিছু হত না। ও আমার কথা শুনতো না। বলাই যাবে বলে আগের রাতেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল। দুপুরে বউ রান্না করেছিল। মুগের ডাল, মুলো শাক, রুই মাছের মাথা দিয়ে ঘণ্ট, কাতলার ঝোল। তাই দিয়ে আমার সঙ্গেই খেতে বলেছিলাম বলাইকে। সে সেই অনুরোধ রেখেছিল বটে, তবে খাওয়ায় তার যে তেমন মন ছিল না, তা ওকে দেখেই বেশ টের পাচ্ছিলাম। তৃপ্তি করে খেয়েছে বলে মনে হল না।
খাওয়া-দাওয়া সেরে উঠে বারান্দাতে বসে কিছুক্ষণ একথা-সেকথা বলতে বলতে বেলা গড়াতেই সে উঠে পড়ল। তার তল্পি-তল্পা আমাদের বাড়িতেই রাখা ছিল। বিশেষ কিছুই নয়। দুটো টিনের বাক্স। আমাকে প্রণাম করে ঝোলাটা কাঁধে আর সে দুটো হাতে নিয়ে সে রওনা হওয়ার উপক্রম করতেই আমার বউ ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালো। বলাইকে থামতে হল। সে হাতের বাক্সগুলো নামিয়ে রেখে তাকেও প্রণাম করল। বউ বলল, মাঝে-মধ্যে ছুটি-ছাটা পেলে এদিকে চলে আসবেন ঠাকুরপো। বলাই মুখে কিছু না বলে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল বটে, কিন্তু আমার মন বলছিল যে বলাই আর এ গাঁয়ে আসবে না।
বলাই ফিরবে কলকাতায়। বিকেলে ট্রেন ছিল। আমি তাকে স্টেশনে ট্রেনে উঠিয়ে দিতে গেছিলাম। ও মাঝে-মধ্যে গ্রামে আসত, সপ্তাহ খানেক থেকে আবার ফিরে যেত। তখন ও একাই স্টেশনে গিয়ে ট্রেন ধরে ফিরে যেত। এবার অবশ্য বরাবরের জন্য গাঁ ছেড়ে যাচ্ছে বলাই। সে কারণেই ওকে স্টেশনে ছাড়তে গেছিলাম। না হলে ওদিন আবার রাতে আমার একটা বিশেষ কাজ ছিল। আমি সখে প্ল্যানচেট করি। আমার দুই ভাইপো তাতে সঙ্গে থাকে। ওরাও সন্ধে্যর পরে কলকাতা থেকে আসবে। প্ল্যানচেটে বসার জন্য সকাল থেকেই মনসংযোগের একটা প্রক্রিয়া জরুরি। তা না হলে এ কাজে বিঘ্ন ঘটতে পারে। তাতে সমূহ বিপদ। কিন্তু, দিনটা কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেল।
বলাইয়ের যা যতটুকু পৈতৃত জমি-জমা ছিল, বসত ভিটে সমস্ত কিছু বিক্রি করে দিয়েছে। প্রায় জলের দামেই সব দিয়ে দিতে হয়েছে। সময় কম বলে সেভাবে দরাদরি করতে পারেনি। বলাই ছোট থেকে আমাদের বাড়ি আসে। আত্মীয় নয়, গ্রাম-স্বজন। বাপ মরা ছেলেটার উপর আমার মায়ের বড় মায়া ছিল। বলাই আমাকে দাদা বলে ডাকে। আমিও ওকে ভাইয়ের মতো স্নেহ করি। বছর পাঁচেক হল কলকাতায় চাকরিতে ঢুকেছে। সরকারি চাকরি।
ছোটবেলায় বলাইয়ের বাবা যক্ষ্মায় মারা যান। বিধবা মা ছেলেকে বড় করেছে। ক্ষেতের কলাটা-মুলটা বাজারে বিক্রি করে যেভাবে দু’জনের সংসার চলে, ওদেরও সেভাবেই চলেছে। তবে শত অর্থাভাবে বা সংকটেও বলাইয়ের স্কুলে যাওয়াটা তিনি বন্ধ হতে দেননি। তিনবছর আগে আচমকা মায়ের মৃত্যুর পর গ্রাম-স্বজনের পরামর্শে পাশের গাঁয়ের মিত্তিরদের বড়মেয়েকে বিয়ে করে বলাই। তখনও সে এই চাকরিটা অবশ্য পায়নি। গাঁয়ের ছেলেপুলেদের বাড়িতে এনে টিউশন পড়াতো।
স্টেশনের কাঠের বেঞ্চে পাশাপাশি বসে আমার মনটা ভারি হয়ে এল। সে মেয়ে, জুঁই, দেখতে-শুনতে আহামরি না হলেও, সংসারী। বাচ্চা-কাচ্চা হয়নি। আহা, বড় ভালো ছিল মেয়েটা। আমাদের সামনে দিয়ে চলে যাওয়া এই রেল লাইনেই শেষ হয়ে গেছে সে। এখনও যেন বিশ্বাসই হয় না। আমার পাশে মাথা নিচু করে চুপ হয়ে বসেছিল বলাই। আমার খব অস্বস্তি হচ্ছিল। ওর মনের অবস্থাটা বেশ টের পাচ্ছিলাম আমি। শত হলেও স্বামী তো, এতগুলো বছর একসঙ্গে ঘর করেছে। আমিও চুপ করে থেকে ট্রেন আসার অপেক্ষা করতে থাকলাম। আপের ট্রেন পেরিয়ে গিয়ে পরের স্টেশনে ক্রশিং হবে। তারপর ডাউনের ট্রেন আসবে। আপের ট্রেনই এখনও যায়নি। টিকিট কাউন্টারের লোকটি বলল, ট্রেন লেট আছে। রাস্তায় কোথায় কী একটা যেন ঘটেছে। আমি যে সময়কার কথা বলছি, তখন শিয়ালদা-লালগোলা লাইন সিঙ্গেল ছিল। স্টিম ইঞ্জিন চলতো। সিগন্যাল ছিল কেরোসিনের কুপি।
আমাদের সামনে দিয়ে চলে যাওয়া কলকাতামুখী সমান্তরাল দুটো ইস্পাত লাইন একটু আগে গিয়ে পূবদিকে বেঁকে গেছে। ট্রেন আসলে বা গেলে দেখা যায় না। লাইনটা যেখানে বেঁকেছে, সেই জায়গাতেই জুঁইয়ের ছিন্ন-ভিন্ন দেহটা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছিল। খুব ভোরের দিকে গাঁয়ের কয়েকজন চাষি লাইন পার করে মাঠে যাওয়ার সময় সেটা লক্ষ্য করে। তারা সঙ্গে সঙ্গে স্টেশন মাস্টারকে খবর দেয়। তখনও সেই ছিন্ন দেহের পরিচয় পাওয়া যায়নি। জানাজানি হতে গাঁয়ের মেয়ে-পুরুষ ভেঙে পড়ল সেই জায়গায়। আমি অবিশ্য যাইনি। অমন দৃশ্ব্য আমি সহ্য করতে পারতাম না। লাইনে ট্রেন চলাচল কিছুক্ষণ বন্ধ রেখে রেলের ডোমেরা সেই দেহাংশগুলো তুলে পোস্টমর্টেমের জন্য মর্গে পাঠিয়ে দেওয়ার পর গাঁয়ের লোকজন গাঁয়ে ফিরে যায়। এটা মাস খানেক আগের কথা।
এরপর বেলা বাড়তে জানা গেল, জুঁই বেপাত্তা। তাকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। আমাদের বাড়িতই প্রথম খোঁজটা এসেছিল। কারণ, সময়ে অসময়ে সে মেয়ে আমার বউয়ের কাছে আসতো। জানলাম, গাঁয়েক এক চাষির বউ তাদের খেতে ফলা কুমোরো আর কিছু পালংশাক নিয়ে জুঁইকে বাড়িতে দিতে গেছিল। সদর দরজায় তালা দেখে সে প্রথমে খানিকটা অবাকই হয়। ছোট গাঁ আমাদের, সবাই সবার খোঁজ-খবর রাখে। অন্তত, তখনও রাখতো। জুঁই যে বাইরে-দূরে কোথাও বা বাপের বাড়ি যাবে, এমনটা সে জানতো না। তাই আশপাশের বাড়িতে জুঁইকে না পেয়ে খবর নিতে আমাদের বাড়ি সটান চলে এসেছে।
আমার বউ এসে আমাকে সব কথা জানালো। শুনে আমিও বড় চিন্তায় পড়ে গেলাম। কী মনে হতে একটা ছেলেকে পাঠিয়ে দিলাম পাশের গাঁয়ে তার বাপের বাড়িতে খোঁজ নিতে। এমনও তো হতে পারে যে বাড়িতে কোনও দুর্ঘটনা ঘটেছে তাই তার কোনও আত্মীয় ভোর-ভোর এসে তাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেছে।
কিন্তু, দুপুরের দিকে সে ছেলেটি শুকনো মুখে ফিরে এল। সঙ্গে প্রবল উদ্বেগ মাখা চোখে জুঁইয়ের বাবা। সে বাপের বাড়ি যায়নি। তবে, মেয়েটা গেল কোথায়! যুবতী বউ, একটা বাড়িতে একলা থাকে। তা হলেও কোনও বিপদ-আপদের সম্ভাবনা তেমন নেই। তেমন খারাপ ঘটনা এ গাঁয়ে কখনও ঘটেছে শোনা যায়নি। মন সায় না দিলেও, একটা আশঙ্কা উঁকি দিচ্ছিল আমার মনে। বলা যায় না, মেয়েটার কারও সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল কিনা। পরক্ষণেই বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠলো। আমার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল।
মনে পড়ল, আজ ভোরেই তো একটা মেয়ে ট্রেনে কাটা পড়েছে বলে শুনেছি। জুঁইয়ের বাবাকে আসতে দেখে কয়েকজন প্রতিবেশি আশাপাশে জমা হয়ে কৌতূহল নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাদের সবতেই কৌতূহল। তারা ভোরে ট্রেনে কাটা লাশও দেখতে গেছিল। আমি তাদের একজনকে কাছে ডেকে নিচুস্বরে জিজ্ঞাসা করলাম, “আচ্ছা ভোরে যে ট্রেনে কাটা লাশটা তোমরা দেখেছো, সেটা কি কোনও বিবাহিত স্ত্রীলোকের?”
রীতিমতো চমকে উঠলো লোকটা। আমার দিকে বড়বড় চোখ করে বলল, “আজ্ঞে, হ্যাঁ ঠাকুরমশাই। বিবাহিতই ছিল মেয়েটা।”
“চিনতে পারা গেছে?”
সে বলল, “না তখন চিনতে পারিনি। মুখের একদিকটা থেঁতলে গেছিলো তো, কিন্তু এখন কেমন যেন মনে হচ্ছে, আপনি যা ভাবছেন, তা হলেও হতে পারে।”
জুঁইয়ের বাবাকে তখনই কিছু বললাম না। তাঁকে ঘরে এনে জলবাতাসা খেয়ে ঠান্ডা হতে বলে বাইরে এসে জনা-চারেক লোককে সদরের রেলমর্গে লাশটা দেখতে পাঠিয়ে দিলাম। আমি জানি মেয়েটার গলার ডান দিকে একটা জরুল আছে। তাদের সেইটে বিশেষভাবে লক্ষ্য করতে বললাম। আমি জানি, ট্রেনে কাটা পড়া লাশ সনাক্ত করা কী ঝক্কি। ওভাবে মৃত কোনও হতভাগ্যের মুখ একেবারে বদলে যায়। বাপ নিজের ছেলেকে, স্বামী নিজের স্ত্রীকেও চিনতে ভুল করে। আমার এবারে কিঞ্চিত অভিজ্ঞতা রয়েছে। সে গল্প আরেকদিন বলবো। আজ বরং থাক।
সে ছেলেরা বিকেলের দিকে দুঃসংবাদটা নিয়ে এল। জুঁইয়ের বাবাকে ততক্ষণ আমি সামান্য ডাল-ভাত খাইয়ে শান্ত করে বসিয়ে রেখেছিলাম। এবার খবরটা শুনে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়লেন। আমি তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, “একি, মিত্তিরমশাই। আপনি এখনই এভাবে ভেঙে পড়লে চলবে কীভাবে? শক্ত হন। তাছাড়া ওরা যে খবর এনেছে তা তো ভুলও হতে পারে। ওরা চিনতে তো ভুলও করতে পারে। আপনি বরং নিজে একবার দেখবেন চলুন। চলুন আমিও আপনার সঙ্গে যাচ্ছি।”
এই বলে একটা গরুর গাড়ি ডেকে মিত্তির মশাই আর আরও কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। মিত্তিরমশাইও তাঁর মেয়েকে সনাক্ত করতে পারলেন। একজন বাবা হিসাবে তার যুবতী বিবাহিত মেয়ের লাশ সনাক্ত করা যে কি কঠিন কাজ...
সরকারি ডাক্তারের সঙ্গে কিছু চেনাজানা থাকায় সেদিনই দেহের পোস্টমর্টেম করার ব্যবস্থা করা হল। পুলিশ কেস হল। সব সরকারি কাজকর্ম মিটিয়ে মাঝরাতের দিকে জুঁইয়ের দেহ হাতে পেলেন মিত্তিরমশাই। খবর পেয়ে তাদের আত্মীয়-স্বজনরাও চলে এসেছিল মর্গে। তারা মেয়ের দেহ নিয়ে নিজেদের গাঁয়ে ফিরে গেল।
বিকেলের পরের এই ট্রেনটাতেই একজনকে কলকাতায় পাঠানো হয়েছিল বলাইকে খবর দিতে। বলাই পরদিন ভোরে তার সঙ্গে সরাসরি শ্বসুরবাড়িতে চলে গেছিল। ততক্ষণে জুঁইয়ের চিতা সাজানো হয়ে গেছিল। আমি শ্মশানে যাইনি। এ সবই পরে লোকমুখে শোনা। গাঁয়ের যে ছেলেরা শ্মশানযাত্রী হয়েছিল, তারাই বলেছে। তারাই বলছিল, মৃতা স্ত্রীর দেহের সামনে নিজেকে ভীষণভাবে সামলে রেখেছিল বলাই। অত্যন্ত মনের জোর দেখিয়েছিল। আর তা হবে না-ই বা কেন, সেই ছোটোবেলায় বাবাকে মরতে দেখেছে। তারপর মাকে হারিয়েছে। জীবনে অনেক যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে। শোক আর তাকে বিহ্বল করবে কেন? এমন সুন্দর সংসার, মেয়েটা ওই রাতে কোন নিশির ডাকে একাএকা রেললাইনে গেল কে জানে!
ট্রেন এল। বাক্স হাতে তুলে তাতে উঠে বসল বলাই। ট্রেনের জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে আমার হাত দুটো চেপে ধরে কিছু বলার বোধহয় চেষ্টা করল, পারল না। ওর চোখদুটো ছলছল করছিল।
ট্রেন ছেড়ে দিল। গড়াতে গড়াতে পূবের বাঁকে সেটা যতক্ষণ না হারিয়ে যাচ্ছে, আমি সেইদিকে তাকিয়ে রইলাম।
কার্তিক মাসের শেষ। দিনের বেলায় যেমন গুমোট, তেমনই সন্ধ্যা নামলেই গা শিরশিরানি ঠাণ্ডা আমেজ। পশ্চিমে সূর্য হেলে গেছে অনেকক্ষণ। কেবলমাত্র গোলাপি আভা ছড়িয়ে রয়েছে আকাশে। প্রায়ান্ধকারে রেললাইনটা পার করে এসে গা ছমছম করে উঠল। আমি ভূত-প্রেতে বিশ্বাস করি, কিন্তু কোনওদিনই তাদের ভয় করি না। আমি প্রেতবৈঠকে তাদের ডাকি। অনেক সময় ভুলভ্রান্তিতে কাছের ট্রেন লাইনে কাটা পড়া আত্মারা চলে আসে। তারা আকুতি নিয়ে জানায় যে বড় কষ্টে আছে। বাড়ির কেউ যেন তাদের জল-পিণ্ড দেয়।
আমি পিছন ফিরে চাইলাম। কিছু দেখতে পেলাম না বটে, তবে আমার শরীর জানান দিল– কেউ আছে। আমার সর্বাঙ্গে লোম খাঁড়া হয়ে উঠেছে তখন। অন্ধকার গাঢ় হওয়ার আগে দ্রুত বাড়ির দিকে পা বাড়ালাম।
যে আশঙ্কা করেছিলাম ঘটলও তাই। আমি আগেই রাতের খাওয়া-দাওয়া সেরে নিয়েছিলাম। ট্রেন লেটের জন্য আমার দুই ভাইপো আমাদের বাড়ি এসে পৌঁছল রাত দশটা নাগাদ। তারা খাওয়া-দাওয়া করে রাত বারোটায় আমার সঙ্গে প্ল্যানচেটে বসবে বলে ঠিক করে ফেললুম। আমার ইচ্ছে করিছিল না, তবু ছেলে দুটোর কথা ফেলতে পারলাম না। তাদের বয়স অল্প, দারুন উৎসাহ এসবে।
যাই হোক, আমি আগে থাকতেই ধুপ-ধুনো জ্বালিয়ে রেখেছিলাম ঘরে। ওরা আসতে সব লাইট নিভিয়ে দিয়ে গোল টেবিলের মাঝে শুধুমাত্র একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে সেটা ঘিরে আমরা তিনজন চেয়ারে গোল হয়ে বসলাম। ঠিক করাই ছিল আমার দিদিমাকে ডাকা হবে। দিদিমার প্রেতের কাছে সিপাহি বিদ্রোহের কথা শুনতে চাইবে ওরা। আমি গভীরভাবে আমার প্রয়াত দিদিমাকে স্মরণ করতে থাকলাম।
বহুক্ষণ বসে থাকার পর আজ আর কিছু হবে না ধরে নিয়ে রণে ভঙ্গ দিয়ে উঠে পড়ব ভাবছি, এই সময় ঘাড়ের কাছে একটা ঠান্ডা নিশ্বাস যেন অনুভব করলাম। ঘরে আমরা তিনজন ছাড়াও চতুর্থ কারও উপস্থিতি আমি বেশ টের পেলাম। বুঝলাম কেউ একজন এসে পড়েছে। চাপাস্বরে বললাম, “দিদুন এলে?”
প্রথমটায় কোনও সাড়াশব্দ পেলাম না। আবার বললাম, “দিদুন, তুমি কি এসেছো।”
এবার একটা ক্ষীণ মহিলা কণ্ঠস্বর পেলাম, “আজ্ঞে, আমি আপনার দিদুন নই।”
“দিদুন নও,...তাহলে কে?”
এবার সেই কণ্ঠস্বর বলল, “আমি জুঁই।”
আমার বুকের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। বললাম, “জুঁই কে...মানে আমাদের বলাইয়ের বউ?”
“আজ্ঞে, হ্যাঁ দাদাবাবু।”
আগেই বলেছি, মনোসংযোগে ত্রুটি হলে টেলিফোনে রং নাম্বার লেগে যাওয়ার মতো অনাহুত, অতৃপ্ত আত্মারা চলে আসে। এমন অভিজ্ঞতা আমার বহু প্রেত বৈঠকেই হয়েছে। আমি প্রশ্ন করলাম, “মা, তুমি কেন এসেছো? তোমার স্বামী তো তোমাকে জল-পিণ্ড দিয়েছে। তুমি তাই নিয়ে মর্তলোক ছেড়ে প্রেতলোকে যাও। কেন এখানে পড়ে আছো এখানে?”
সে বললে, “দাদাবাবু আমি যে বড় কষ্ট পাচ্ছি।”
আমরা জানতাম, জুঁই আত্মহত্যা করেছে। কেন সেটা আমরা কেউই জানি না, জানার কথাও নয়। কার মনের মধ্যে কোন অশান্তি বাসা বেঁধে থাকে, সবসময় তো বাইরে থেকে বোঝা যায় না। বললাম, “আত্মহত্যা করতে গেলে কেন? জানতে না আত্মহত্যা মহাপাপ? আত্মা কষ্ট পায়।”
আমি কথা শেষ করার প্রায় সঙ্গেসঙ্গে জুঁইয়ের প্রেতাত্মা বলল, “ছিঃ-ছিঃ, অমন কথা বলবেন না। আমি তো আত্মহত্যা করিনি। আমাকে খুন করা হয়েছে।”
“খুন করা হয়েছে? তুমি আত্মহত্যা করোনি?”
“না দাদাবাবু, আমি সেই কথা কবে থেকে আপনাকে বলতে চাইছি। আজও আপনি যখন ওকে ট্রেনে উঠিয়ে দিয়ে লাইন পার হচ্ছিলেন, তখনও একবার বলবার জন্য এসেছিলাম। কিন্তু সুযোগ হল না।”
“কে এমন কাজ করল?”
কিছুক্ষণ কোনও সাড়াশব্দ নেই। আমার দুই ভাইপোর সাহস আছে বটে, বলতেই হয়। ওরা চুপ হয়ে আমাদের কথা শুনে যাচ্ছে। অবশ্য, আগেও ওরা আমার সঙ্গে প্রেত বৈঠকে এমন ঘটনা দেখেছে। আমি আবার বললাম, “জুঁই, তোমায় কে খুন করেছে?”
সে বলল, “আমার স্বামী...আমার স্বামীই আমাকে খুন করেছে। ওইদিন সন্ধ্যার গাড়িতে ও কলকাতা থেকে ফিরেছিল। হঠাৎই, ও আসার আমি অবাক হয়েছিলাম। রাতের বেলা খুব সুন্দর জ্যোৎস্না উঠেছিল। ও আমাকে নিয়ে বেড়াতে বেড়াতে রেললাইনের দিকে নিয়ে গেল। আমরা রেললাইনের পাশ ধরে হাঁটছিলাম। এই সময় কলকাতার দিক থেকে রাতের গাড়িটা আসছিল। ওটা পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় ও আমাকে আচমকা ধাক্কা মেরে চলন্ত ট্রেনের নীচে ফেলে দিল।”
আমি ঘামছিলাম। ছোট হয়ে আসা মোমবাতির আবছা আলোয় দেখলাম আমার দুই ভাইপো স্থানুর মতো বসে রয়েছে। আমি কোনওক্রমে বললাম, “তারপর?”
জুঁই বলল, “তার পরপরই ডাউন ট্রেনটা ঢুকলো। ও তাতেই উঠে আবার কলকাতায় ফিরে গেল। অন্ধকারে যেমন চুপিচুপি এসেছিল, সেভাবেই চলে গেল। গাঁয়ের কেউ জানতেই পারল না ওর আসার কথা।”
প্রেতাত্মা তো মিথ্যা বলে না! পার্থিব সমস্ত কিছু চাওয়া-পাওয়া, আশা-আকাঙ্খা, চাতুরি-চালাকির ঊর্ধ্বে চলে গেছে সে। আমি তবু বললাম, “তোমাদের স্বামী-স্ত্রীর সংসার তো বেশ সুখেরই ছিল। তবু বলাই তোমাকে খুন করল কেন?”
মনে হল যেন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল জুঁইয়ের প্রেতাত্মা। তারপর সে বলল, “দাদাবাবু, কী বলবো, খুবই লজ্জার ব্যাপার। সেখেনে সে একটা মেয়েমানুষের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। অনেকদিন ধরেই এসব চলছে, আমি তো কিছুটি টেরই পাইনি। ওরা বিয়ে করবে। আমি তাতে পথের কাঁটা হয়ে ছিলাম। তাই আমাকে সরিয়ে দিল।”
আরও কিছু হয়তো জিজ্ঞাসা করতাম, কিন্তু জুঁইয়ের আর কোনও সাড়াশব্দ পেলাম না। বুঝলাম, সে চলে গেছে। ঘরের বাতাস হালকা হয়ে গেছে।
আমরা কিছুক্ষণ কিংকর্তব্যের মতো বসে থাকলাম। বলাই খুনি, বিশ্বাস করতে না চাইলেও, জুঁইয়ের প্রেতাত্মা যা বলে গেল তা নেহাত মিথ্যা বলে ফেলে দিতেও মন সায় দিচ্ছিল না। জুঁইয়ের প্রেতাত্মা যা বলেছে, তা আমি একা নয়, আমরা তিনজনই সে সব শুনেছি। তাই এটা মনের ভুল বা শোনার ভুল নয়। মোমবাতিটা প্রায় নিভু-নিভু হয়ে এসেছিল। আমার ইশারায় এক ভাইপো উঠে লাইট জ্বালিয়ে দিল।
আদালতে প্রেতাত্মার বয়ান গ্রাহ্য হবে না। তবু সব জানার পর একজন নরহত্যাকারীকে তো তা বলে রেহাই দেওয়ায় যায় না। প্রমাণ জোগাড় করার দায় পুলিশ-গোয়েন্দাদের। ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখলাম রাত দেড়টা বাজে। আমার কলকাতার ভাইপো দুটো বড় করিৎকর্মা। তারা যে কাজে এসেছিল, সেটা হল না বলে, তাদের মনে কোনও খেদ নেই। তারা তখনই বেরিয়ে গেল স্টশনের দিকে। স্টেশনমাস্টারের ঘরে গিয়ে সোজা ফোন করল কলকাতা পুলিশের সদর দফতর লালবাজারে।
এরপর ভোররাতে বলাইকে তার বাড়ি থেকেই পুলিশ গ্রেফতার করেছিল। জেরায় সে স্বীকার করে খুনের কথা। তবে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী না থাকায় সে ফাঁসির দড়ি থেকে বেঁচে গেলও, দশ বছরের কারাবাস হয়েছিল।
সেই ঘটনার পর বহুকাল কেটে গেছে। বলাই আর কখনও গাঁয়ে ফেরেনি। দু’একজনের মুখে ভাসাভাসা শুনেছি, বারাণসীর অলিগলিতে নাকি তাকে উন্মাদ অবস্থায় ঘোরাফেরা করতে দেখেছে তারা। জানি খুনি, তবু বলাইয়ের কথা মনে ভাবলে বড় কষ্ট হয়।
বলাই চলে গেল। আমি ওকে আটকালাম না। কোনও চেষ্টা করিনি। তাতে লাভও কিছু হত না। ও আমার কথা শুনতো না। বলাই যাবে বলে আগের রাতেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল। দুপুরে বউ রান্না করেছিল। মুগের ডাল, মুলো শাক, রুই মাছের মাথা দিয়ে ঘণ্ট, কাতলার ঝোল। তাই দিয়ে আমার সঙ্গেই খেতে বলেছিলাম বলাইকে। সে সেই অনুরোধ রেখেছিল বটে, তবে খাওয়ায় তার যে তেমন মন ছিল না, তা ওকে দেখেই বেশ টের পাচ্ছিলাম। তৃপ্তি করে খেয়েছে বলে মনে হল না।
খাওয়া-দাওয়া সেরে উঠে বারান্দাতে বসে কিছুক্ষণ একথা-সেকথা বলতে বলতে বেলা গড়াতেই সে উঠে পড়ল। তার তল্পি-তল্পা আমাদের বাড়িতেই রাখা ছিল। বিশেষ কিছুই নয়। দুটো টিনের বাক্স। আমাকে প্রণাম করে ঝোলাটা কাঁধে আর সে দুটো হাতে নিয়ে সে রওনা হওয়ার উপক্রম করতেই আমার বউ ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালো। বলাইকে থামতে হল। সে হাতের বাক্সগুলো নামিয়ে রেখে তাকেও প্রণাম করল। বউ বলল, মাঝে-মধ্যে ছুটি-ছাটা পেলে এদিকে চলে আসবেন ঠাকুরপো। বলাই মুখে কিছু না বলে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল বটে, কিন্তু আমার মন বলছিল যে বলাই আর এ গাঁয়ে আসবে না।
বলাই ফিরবে কলকাতায়। বিকেলে ট্রেন ছিল। আমি তাকে স্টেশনে ট্রেনে উঠিয়ে দিতে গেছিলাম। ও মাঝে-মধ্যে গ্রামে আসত, সপ্তাহ খানেক থেকে আবার ফিরে যেত। তখন ও একাই স্টেশনে গিয়ে ট্রেন ধরে ফিরে যেত। এবার অবশ্য বরাবরের জন্য গাঁ ছেড়ে যাচ্ছে বলাই। সে কারণেই ওকে স্টেশনে ছাড়তে গেছিলাম। না হলে ওদিন আবার রাতে আমার একটা বিশেষ কাজ ছিল। আমি সখে প্ল্যানচেট করি। আমার দুই ভাইপো তাতে সঙ্গে থাকে। ওরাও সন্ধে্যর পরে কলকাতা থেকে আসবে। প্ল্যানচেটে বসার জন্য সকাল থেকেই মনসংযোগের একটা প্রক্রিয়া জরুরি। তা না হলে এ কাজে বিঘ্ন ঘটতে পারে। তাতে সমূহ বিপদ। কিন্তু, দিনটা কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেল।
বলাইয়ের যা যতটুকু পৈতৃত জমি-জমা ছিল, বসত ভিটে সমস্ত কিছু বিক্রি করে দিয়েছে। প্রায় জলের দামেই সব দিয়ে দিতে হয়েছে। সময় কম বলে সেভাবে দরাদরি করতে পারেনি। বলাই ছোট থেকে আমাদের বাড়ি আসে। আত্মীয় নয়, গ্রাম-স্বজন। বাপ মরা ছেলেটার উপর আমার মায়ের বড় মায়া ছিল। বলাই আমাকে দাদা বলে ডাকে। আমিও ওকে ভাইয়ের মতো স্নেহ করি। বছর পাঁচেক হল কলকাতায় চাকরিতে ঢুকেছে। সরকারি চাকরি।
ছোটবেলায় বলাইয়ের বাবা যক্ষ্মায় মারা যান। বিধবা মা ছেলেকে বড় করেছে। ক্ষেতের কলাটা-মুলটা বাজারে বিক্রি করে যেভাবে দু’জনের সংসার চলে, ওদেরও সেভাবেই চলেছে। তবে শত অর্থাভাবে বা সংকটেও বলাইয়ের স্কুলে যাওয়াটা তিনি বন্ধ হতে দেননি। তিনবছর আগে আচমকা মায়ের মৃত্যুর পর গ্রাম-স্বজনের পরামর্শে পাশের গাঁয়ের মিত্তিরদের বড়মেয়েকে বিয়ে করে বলাই। তখনও সে এই চাকরিটা অবশ্য পায়নি। গাঁয়ের ছেলেপুলেদের বাড়িতে এনে টিউশন পড়াতো।
স্টেশনের কাঠের বেঞ্চে পাশাপাশি বসে আমার মনটা ভারি হয়ে এল। সে মেয়ে, জুঁই, দেখতে-শুনতে আহামরি না হলেও, সংসারী। বাচ্চা-কাচ্চা হয়নি। আহা, বড় ভালো ছিল মেয়েটা। আমাদের সামনে দিয়ে চলে যাওয়া এই রেল লাইনেই শেষ হয়ে গেছে সে। এখনও যেন বিশ্বাসই হয় না। আমার পাশে মাথা নিচু করে চুপ হয়ে বসেছিল বলাই। আমার খব অস্বস্তি হচ্ছিল। ওর মনের অবস্থাটা বেশ টের পাচ্ছিলাম আমি। শত হলেও স্বামী তো, এতগুলো বছর একসঙ্গে ঘর করেছে। আমিও চুপ করে থেকে ট্রেন আসার অপেক্ষা করতে থাকলাম। আপের ট্রেন পেরিয়ে গিয়ে পরের স্টেশনে ক্রশিং হবে। তারপর ডাউনের ট্রেন আসবে। আপের ট্রেনই এখনও যায়নি। টিকিট কাউন্টারের লোকটি বলল, ট্রেন লেট আছে। রাস্তায় কোথায় কী একটা যেন ঘটেছে। আমি যে সময়কার কথা বলছি, তখন শিয়ালদা-লালগোলা লাইন সিঙ্গেল ছিল। স্টিম ইঞ্জিন চলতো। সিগন্যাল ছিল কেরোসিনের কুপি।
আমাদের সামনে দিয়ে চলে যাওয়া কলকাতামুখী সমান্তরাল দুটো ইস্পাত লাইন একটু আগে গিয়ে পূবদিকে বেঁকে গেছে। ট্রেন আসলে বা গেলে দেখা যায় না। লাইনটা যেখানে বেঁকেছে, সেই জায়গাতেই জুঁইয়ের ছিন্ন-ভিন্ন দেহটা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছিল। খুব ভোরের দিকে গাঁয়ের কয়েকজন চাষি লাইন পার করে মাঠে যাওয়ার সময় সেটা লক্ষ্য করে। তারা সঙ্গে সঙ্গে স্টেশন মাস্টারকে খবর দেয়। তখনও সেই ছিন্ন দেহের পরিচয় পাওয়া যায়নি। জানাজানি হতে গাঁয়ের মেয়ে-পুরুষ ভেঙে পড়ল সেই জায়গায়। আমি অবিশ্য যাইনি। অমন দৃশ্ব্য আমি সহ্য করতে পারতাম না। লাইনে ট্রেন চলাচল কিছুক্ষণ বন্ধ রেখে রেলের ডোমেরা সেই দেহাংশগুলো তুলে পোস্টমর্টেমের জন্য মর্গে পাঠিয়ে দেওয়ার পর গাঁয়ের লোকজন গাঁয়ে ফিরে যায়। এটা মাস খানেক আগের কথা।
এরপর বেলা বাড়তে জানা গেল, জুঁই বেপাত্তা। তাকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। আমাদের বাড়িতই প্রথম খোঁজটা এসেছিল। কারণ, সময়ে অসময়ে সে মেয়ে আমার বউয়ের কাছে আসতো। জানলাম, গাঁয়েক এক চাষির বউ তাদের খেতে ফলা কুমোরো আর কিছু পালংশাক নিয়ে জুঁইকে বাড়িতে দিতে গেছিল। সদর দরজায় তালা দেখে সে প্রথমে খানিকটা অবাকই হয়। ছোট গাঁ আমাদের, সবাই সবার খোঁজ-খবর রাখে। অন্তত, তখনও রাখতো। জুঁই যে বাইরে-দূরে কোথাও বা বাপের বাড়ি যাবে, এমনটা সে জানতো না। তাই আশপাশের বাড়িতে জুঁইকে না পেয়ে খবর নিতে আমাদের বাড়ি সটান চলে এসেছে।
আমার বউ এসে আমাকে সব কথা জানালো। শুনে আমিও বড় চিন্তায় পড়ে গেলাম। কী মনে হতে একটা ছেলেকে পাঠিয়ে দিলাম পাশের গাঁয়ে তার বাপের বাড়িতে খোঁজ নিতে। এমনও তো হতে পারে যে বাড়িতে কোনও দুর্ঘটনা ঘটেছে তাই তার কোনও আত্মীয় ভোর-ভোর এসে তাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেছে।
কিন্তু, দুপুরের দিকে সে ছেলেটি শুকনো মুখে ফিরে এল। সঙ্গে প্রবল উদ্বেগ মাখা চোখে জুঁইয়ের বাবা। সে বাপের বাড়ি যায়নি। তবে, মেয়েটা গেল কোথায়! যুবতী বউ, একটা বাড়িতে একলা থাকে। তা হলেও কোনও বিপদ-আপদের সম্ভাবনা তেমন নেই। তেমন খারাপ ঘটনা এ গাঁয়ে কখনও ঘটেছে শোনা যায়নি। মন সায় না দিলেও, একটা আশঙ্কা উঁকি দিচ্ছিল আমার মনে। বলা যায় না, মেয়েটার কারও সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল কিনা। পরক্ষণেই বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠলো। আমার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল।
মনে পড়ল, আজ ভোরেই তো একটা মেয়ে ট্রেনে কাটা পড়েছে বলে শুনেছি। জুঁইয়ের বাবাকে আসতে দেখে কয়েকজন প্রতিবেশি আশাপাশে জমা হয়ে কৌতূহল নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাদের সবতেই কৌতূহল। তারা ভোরে ট্রেনে কাটা লাশও দেখতে গেছিল। আমি তাদের একজনকে কাছে ডেকে নিচুস্বরে জিজ্ঞাসা করলাম, “আচ্ছা ভোরে যে ট্রেনে কাটা লাশটা তোমরা দেখেছো, সেটা কি কোনও বিবাহিত স্ত্রীলোকের?”
রীতিমতো চমকে উঠলো লোকটা। আমার দিকে বড়বড় চোখ করে বলল, “আজ্ঞে, হ্যাঁ ঠাকুরমশাই। বিবাহিতই ছিল মেয়েটা।”
“চিনতে পারা গেছে?”
সে বলল, “না তখন চিনতে পারিনি। মুখের একদিকটা থেঁতলে গেছিলো তো, কিন্তু এখন কেমন যেন মনে হচ্ছে, আপনি যা ভাবছেন, তা হলেও হতে পারে।”
জুঁইয়ের বাবাকে তখনই কিছু বললাম না। তাঁকে ঘরে এনে জলবাতাসা খেয়ে ঠান্ডা হতে বলে বাইরে এসে জনা-চারেক লোককে সদরের রেলমর্গে লাশটা দেখতে পাঠিয়ে দিলাম। আমি জানি মেয়েটার গলার ডান দিকে একটা জরুল আছে। তাদের সেইটে বিশেষভাবে লক্ষ্য করতে বললাম। আমি জানি, ট্রেনে কাটা পড়া লাশ সনাক্ত করা কী ঝক্কি। ওভাবে মৃত কোনও হতভাগ্যের মুখ একেবারে বদলে যায়। বাপ নিজের ছেলেকে, স্বামী নিজের স্ত্রীকেও চিনতে ভুল করে। আমার এবারে কিঞ্চিত অভিজ্ঞতা রয়েছে। সে গল্প আরেকদিন বলবো। আজ বরং থাক।
সে ছেলেরা বিকেলের দিকে দুঃসংবাদটা নিয়ে এল। জুঁইয়ের বাবাকে ততক্ষণ আমি সামান্য ডাল-ভাত খাইয়ে শান্ত করে বসিয়ে রেখেছিলাম। এবার খবরটা শুনে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়লেন। আমি তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, “একি, মিত্তিরমশাই। আপনি এখনই এভাবে ভেঙে পড়লে চলবে কীভাবে? শক্ত হন। তাছাড়া ওরা যে খবর এনেছে তা তো ভুলও হতে পারে। ওরা চিনতে তো ভুলও করতে পারে। আপনি বরং নিজে একবার দেখবেন চলুন। চলুন আমিও আপনার সঙ্গে যাচ্ছি।”
এই বলে একটা গরুর গাড়ি ডেকে মিত্তির মশাই আর আরও কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। মিত্তিরমশাইও তাঁর মেয়েকে সনাক্ত করতে পারলেন। একজন বাবা হিসাবে তার যুবতী বিবাহিত মেয়ের লাশ সনাক্ত করা যে কি কঠিন কাজ...
সরকারি ডাক্তারের সঙ্গে কিছু চেনাজানা থাকায় সেদিনই দেহের পোস্টমর্টেম করার ব্যবস্থা করা হল। পুলিশ কেস হল। সব সরকারি কাজকর্ম মিটিয়ে মাঝরাতের দিকে জুঁইয়ের দেহ হাতে পেলেন মিত্তিরমশাই। খবর পেয়ে তাদের আত্মীয়-স্বজনরাও চলে এসেছিল মর্গে। তারা মেয়ের দেহ নিয়ে নিজেদের গাঁয়ে ফিরে গেল।
বিকেলের পরের এই ট্রেনটাতেই একজনকে কলকাতায় পাঠানো হয়েছিল বলাইকে খবর দিতে। বলাই পরদিন ভোরে তার সঙ্গে সরাসরি শ্বসুরবাড়িতে চলে গেছিল। ততক্ষণে জুঁইয়ের চিতা সাজানো হয়ে গেছিল। আমি শ্মশানে যাইনি। এ সবই পরে লোকমুখে শোনা। গাঁয়ের যে ছেলেরা শ্মশানযাত্রী হয়েছিল, তারাই বলেছে। তারাই বলছিল, মৃতা স্ত্রীর দেহের সামনে নিজেকে ভীষণভাবে সামলে রেখেছিল বলাই। অত্যন্ত মনের জোর দেখিয়েছিল। আর তা হবে না-ই বা কেন, সেই ছোটোবেলায় বাবাকে মরতে দেখেছে। তারপর মাকে হারিয়েছে। জীবনে অনেক যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে। শোক আর তাকে বিহ্বল করবে কেন? এমন সুন্দর সংসার, মেয়েটা ওই রাতে কোন নিশির ডাকে একাএকা রেললাইনে গেল কে জানে!
ট্রেন এল। বাক্স হাতে তুলে তাতে উঠে বসল বলাই। ট্রেনের জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে আমার হাত দুটো চেপে ধরে কিছু বলার বোধহয় চেষ্টা করল, পারল না। ওর চোখদুটো ছলছল করছিল।
ট্রেন ছেড়ে দিল। গড়াতে গড়াতে পূবের বাঁকে সেটা যতক্ষণ না হারিয়ে যাচ্ছে, আমি সেইদিকে তাকিয়ে রইলাম।
কার্তিক মাসের শেষ। দিনের বেলায় যেমন গুমোট, তেমনই সন্ধ্যা নামলেই গা শিরশিরানি ঠাণ্ডা আমেজ। পশ্চিমে সূর্য হেলে গেছে অনেকক্ষণ। কেবলমাত্র গোলাপি আভা ছড়িয়ে রয়েছে আকাশে। প্রায়ান্ধকারে রেললাইনটা পার করে এসে গা ছমছম করে উঠল। আমি ভূত-প্রেতে বিশ্বাস করি, কিন্তু কোনওদিনই তাদের ভয় করি না। আমি প্রেতবৈঠকে তাদের ডাকি। অনেক সময় ভুলভ্রান্তিতে কাছের ট্রেন লাইনে কাটা পড়া আত্মারা চলে আসে। তারা আকুতি নিয়ে জানায় যে বড় কষ্টে আছে। বাড়ির কেউ যেন তাদের জল-পিণ্ড দেয়।
আমি পিছন ফিরে চাইলাম। কিছু দেখতে পেলাম না বটে, তবে আমার শরীর জানান দিল– কেউ আছে। আমার সর্বাঙ্গে লোম খাঁড়া হয়ে উঠেছে তখন। অন্ধকার গাঢ় হওয়ার আগে দ্রুত বাড়ির দিকে পা বাড়ালাম।
যে আশঙ্কা করেছিলাম ঘটলও তাই। আমি আগেই রাতের খাওয়া-দাওয়া সেরে নিয়েছিলাম। ট্রেন লেটের জন্য আমার দুই ভাইপো আমাদের বাড়ি এসে পৌঁছল রাত দশটা নাগাদ। তারা খাওয়া-দাওয়া করে রাত বারোটায় আমার সঙ্গে প্ল্যানচেটে বসবে বলে ঠিক করে ফেললুম। আমার ইচ্ছে করিছিল না, তবু ছেলে দুটোর কথা ফেলতে পারলাম না। তাদের বয়স অল্প, দারুন উৎসাহ এসবে।
যাই হোক, আমি আগে থাকতেই ধুপ-ধুনো জ্বালিয়ে রেখেছিলাম ঘরে। ওরা আসতে সব লাইট নিভিয়ে দিয়ে গোল টেবিলের মাঝে শুধুমাত্র একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে সেটা ঘিরে আমরা তিনজন চেয়ারে গোল হয়ে বসলাম। ঠিক করাই ছিল আমার দিদিমাকে ডাকা হবে। দিদিমার প্রেতের কাছে সিপাহি বিদ্রোহের কথা শুনতে চাইবে ওরা। আমি গভীরভাবে আমার প্রয়াত দিদিমাকে স্মরণ করতে থাকলাম।
বহুক্ষণ বসে থাকার পর আজ আর কিছু হবে না ধরে নিয়ে রণে ভঙ্গ দিয়ে উঠে পড়ব ভাবছি, এই সময় ঘাড়ের কাছে একটা ঠান্ডা নিশ্বাস যেন অনুভব করলাম। ঘরে আমরা তিনজন ছাড়াও চতুর্থ কারও উপস্থিতি আমি বেশ টের পেলাম। বুঝলাম কেউ একজন এসে পড়েছে। চাপাস্বরে বললাম, “দিদুন এলে?”
প্রথমটায় কোনও সাড়াশব্দ পেলাম না। আবার বললাম, “দিদুন, তুমি কি এসেছো।”
এবার একটা ক্ষীণ মহিলা কণ্ঠস্বর পেলাম, “আজ্ঞে, আমি আপনার দিদুন নই।”
“দিদুন নও,...তাহলে কে?”
এবার সেই কণ্ঠস্বর বলল, “আমি জুঁই।”
আমার বুকের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। বললাম, “জুঁই কে...মানে আমাদের বলাইয়ের বউ?”
“আজ্ঞে, হ্যাঁ দাদাবাবু।”
আগেই বলেছি, মনোসংযোগে ত্রুটি হলে টেলিফোনে রং নাম্বার লেগে যাওয়ার মতো অনাহুত, অতৃপ্ত আত্মারা চলে আসে। এমন অভিজ্ঞতা আমার বহু প্রেত বৈঠকেই হয়েছে। আমি প্রশ্ন করলাম, “মা, তুমি কেন এসেছো? তোমার স্বামী তো তোমাকে জল-পিণ্ড দিয়েছে। তুমি তাই নিয়ে মর্তলোক ছেড়ে প্রেতলোকে যাও। কেন এখানে পড়ে আছো এখানে?”
সে বললে, “দাদাবাবু আমি যে বড় কষ্ট পাচ্ছি।”
আমরা জানতাম, জুঁই আত্মহত্যা করেছে। কেন সেটা আমরা কেউই জানি না, জানার কথাও নয়। কার মনের মধ্যে কোন অশান্তি বাসা বেঁধে থাকে, সবসময় তো বাইরে থেকে বোঝা যায় না। বললাম, “আত্মহত্যা করতে গেলে কেন? জানতে না আত্মহত্যা মহাপাপ? আত্মা কষ্ট পায়।”
আমি কথা শেষ করার প্রায় সঙ্গেসঙ্গে জুঁইয়ের প্রেতাত্মা বলল, “ছিঃ-ছিঃ, অমন কথা বলবেন না। আমি তো আত্মহত্যা করিনি। আমাকে খুন করা হয়েছে।”
“খুন করা হয়েছে? তুমি আত্মহত্যা করোনি?”
“না দাদাবাবু, আমি সেই কথা কবে থেকে আপনাকে বলতে চাইছি। আজও আপনি যখন ওকে ট্রেনে উঠিয়ে দিয়ে লাইন পার হচ্ছিলেন, তখনও একবার বলবার জন্য এসেছিলাম। কিন্তু সুযোগ হল না।”
“কে এমন কাজ করল?”
কিছুক্ষণ কোনও সাড়াশব্দ নেই। আমার দুই ভাইপোর সাহস আছে বটে, বলতেই হয়। ওরা চুপ হয়ে আমাদের কথা শুনে যাচ্ছে। অবশ্য, আগেও ওরা আমার সঙ্গে প্রেত বৈঠকে এমন ঘটনা দেখেছে। আমি আবার বললাম, “জুঁই, তোমায় কে খুন করেছে?”
সে বলল, “আমার স্বামী...আমার স্বামীই আমাকে খুন করেছে। ওইদিন সন্ধ্যার গাড়িতে ও কলকাতা থেকে ফিরেছিল। হঠাৎই, ও আসার আমি অবাক হয়েছিলাম। রাতের বেলা খুব সুন্দর জ্যোৎস্না উঠেছিল। ও আমাকে নিয়ে বেড়াতে বেড়াতে রেললাইনের দিকে নিয়ে গেল। আমরা রেললাইনের পাশ ধরে হাঁটছিলাম। এই সময় কলকাতার দিক থেকে রাতের গাড়িটা আসছিল। ওটা পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় ও আমাকে আচমকা ধাক্কা মেরে চলন্ত ট্রেনের নীচে ফেলে দিল।”
আমি ঘামছিলাম। ছোট হয়ে আসা মোমবাতির আবছা আলোয় দেখলাম আমার দুই ভাইপো স্থানুর মতো বসে রয়েছে। আমি কোনওক্রমে বললাম, “তারপর?”
জুঁই বলল, “তার পরপরই ডাউন ট্রেনটা ঢুকলো। ও তাতেই উঠে আবার কলকাতায় ফিরে গেল। অন্ধকারে যেমন চুপিচুপি এসেছিল, সেভাবেই চলে গেল। গাঁয়ের কেউ জানতেই পারল না ওর আসার কথা।”
প্রেতাত্মা তো মিথ্যা বলে না! পার্থিব সমস্ত কিছু চাওয়া-পাওয়া, আশা-আকাঙ্খা, চাতুরি-চালাকির ঊর্ধ্বে চলে গেছে সে। আমি তবু বললাম, “তোমাদের স্বামী-স্ত্রীর সংসার তো বেশ সুখেরই ছিল। তবু বলাই তোমাকে খুন করল কেন?”
মনে হল যেন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল জুঁইয়ের প্রেতাত্মা। তারপর সে বলল, “দাদাবাবু, কী বলবো, খুবই লজ্জার ব্যাপার। সেখেনে সে একটা মেয়েমানুষের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। অনেকদিন ধরেই এসব চলছে, আমি তো কিছুটি টেরই পাইনি। ওরা বিয়ে করবে। আমি তাতে পথের কাঁটা হয়ে ছিলাম। তাই আমাকে সরিয়ে দিল।”
আরও কিছু হয়তো জিজ্ঞাসা করতাম, কিন্তু জুঁইয়ের আর কোনও সাড়াশব্দ পেলাম না। বুঝলাম, সে চলে গেছে। ঘরের বাতাস হালকা হয়ে গেছে।
আমরা কিছুক্ষণ কিংকর্তব্যের মতো বসে থাকলাম। বলাই খুনি, বিশ্বাস করতে না চাইলেও, জুঁইয়ের প্রেতাত্মা যা বলে গেল তা নেহাত মিথ্যা বলে ফেলে দিতেও মন সায় দিচ্ছিল না। জুঁইয়ের প্রেতাত্মা যা বলেছে, তা আমি একা নয়, আমরা তিনজনই সে সব শুনেছি। তাই এটা মনের ভুল বা শোনার ভুল নয়। মোমবাতিটা প্রায় নিভু-নিভু হয়ে এসেছিল। আমার ইশারায় এক ভাইপো উঠে লাইট জ্বালিয়ে দিল।
আদালতে প্রেতাত্মার বয়ান গ্রাহ্য হবে না। তবু সব জানার পর একজন নরহত্যাকারীকে তো তা বলে রেহাই দেওয়ায় যায় না। প্রমাণ জোগাড় করার দায় পুলিশ-গোয়েন্দাদের। ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখলাম রাত দেড়টা বাজে। আমার কলকাতার ভাইপো দুটো বড় করিৎকর্মা। তারা যে কাজে এসেছিল, সেটা হল না বলে, তাদের মনে কোনও খেদ নেই। তারা তখনই বেরিয়ে গেল স্টশনের দিকে। স্টেশনমাস্টারের ঘরে গিয়ে সোজা ফোন করল কলকাতা পুলিশের সদর দফতর লালবাজারে।
এরপর ভোররাতে বলাইকে তার বাড়ি থেকেই পুলিশ গ্রেফতার করেছিল। জেরায় সে স্বীকার করে খুনের কথা। তবে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী না থাকায় সে ফাঁসির দড়ি থেকে বেঁচে গেলও, দশ বছরের কারাবাস হয়েছিল।
সেই ঘটনার পর বহুকাল কেটে গেছে। বলাই আর কখনও গাঁয়ে ফেরেনি। দু’একজনের মুখে ভাসাভাসা শুনেছি, বারাণসীর অলিগলিতে নাকি তাকে উন্মাদ অবস্থায় ঘোরাফেরা করতে দেখেছে তারা। জানি খুনি, তবু বলাইয়ের কথা মনে ভাবলে বড় কষ্ট হয়।
All rights reserved. No part of this publication may be reproduced, distributed, or transmitted in any form or by any means, including photocopying, recording, or other electronic or mechanical methods, without the prior written permission of the author and publisher.
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন