হলের শক্তি, পুরোনো সিনেমার মুক্তি

প্রয়ানের এক দশক পরেও উত্তমকুমার অভিনীত ‘স্ত্রী’, ‘অমানুষ’ ‘আনন্দআশ্রম’-এর মতো সিনেমা চুটিয়ে চলেছে প্রেক্ষাগৃহে। নতুন হিট-এর অভাবে ধুঁকতে থাকা সিনেমা শিল্পের ত্রাতা হয়েছে। লিখছেন অনুচর

হলের শক্তি, পুরানো সিনেমার মুক্তি

সম্প্রতি পুরোনো কিছু ‘হিট’ ছবি নতুন করে মুক্তি পেয়েছে সিনেমা হলে। তবে এই ধারণাটি মোটেই নতুন নয়। এক সময় পুরানো সিনেমার হলে নতুন মুক্তি এই ক্ষেত্রটির পরিত্রাতা হয়েছিল। আশির দশকের মাঝ দিকটায় হঠাৎ সিনেমা জগতে একটা ভাঁটা এল। বলিউড, টলিউড এমনকী দক্ষিণেও একই পরিস্থিতি। হিন্দির মারপিটের সিনেমা, টলিউডের কান্নাকাটি আর দক্ষিণের ফ‌্যান্টাসি দেখতে দেখতে দর্শক তখন ক্লান্ত। এদিকে, ততদিনে টেলিভিশনের দৌলতে ঘরে বসে সিনেমা দেখা রপ্তও হয়ে গিয়েছে শহর-মফস্বলে। রঙিন টিভি এসেছে। রিলে সেন্টারের মাধ‌্যমে সম্প্রচার হয়েছে আরও ব‌্যাপক ও আরও সুষ্ঠ। ফলে বাংলা-হিন্দি বা দক্ষিণের হিন্দি ডাব সিনেমা চালানো প্রেক্ষাগৃহগুলো দর্শকের অভাবে ধুঁকতে শুরু করল।ধর্মতলার অভিজাত কয়েকটি প্রেক্ষাগৃহ অবশ‌্য তখনও এই সংকটের বাইরে। সেখানে বিদেশী সিনেমা চলতে থাকলো রমরমিয়ে। কিন্তু সেই পরিস্থিতিতে অপেক্ষাকৃত ছোট হলগুলি সমস‌্যায় পড়ল বেশি। কিছু হল দরজায় সাসপেনসেনের অর্ডার ঝুলিয়ে দিল। পাল্টা কর্মী সংগঠনও লাল রঙের ব‌্যানার টাঙিয়ে আন্দোলনে বসল। ধর্মতলা বা বাজার-কারখানা এলাকার সিনেমাহলগুলি একটি পন্থা বের করল, তা হল নুন শো ও নাইট শোয়ে ‘‌অ‌্যাডাল্ট’ সিনেমা চালানো।
সম্প্রতি পুরানো কিছু ‘হিট’ ছবি নতুন করে মুক্তি পেয়েছে সিনেমা হলে। তবে এই ধারণাটি মোটেই নতুন নয়। এক সময় পুরানো সিনেমার হলে নতুন মুক্তি এই ক্ষেত্রটির পরিত্রাতা হয়েছিল। সিনেমা হল মালিক, কর্মী, কর্মীদের পরিবার বেঁচে গিয়েছিল। সেই কঠিন সময়ে এই ফর্মুলা বেশ কার্যকর হয়েছিল, কারণ পুরোনো ছবি পরিবেশকদের কাছ থেকে কম খরচে পাওয়া যেত, সেগুলি সবই হিট ছবি ছিল বলে কোনও ব‌্যবসায়িক ঝুঁকিও ছিল না। এই সময়ে পুরোনো ছবির নতুন মুক্তির প্রেক্ষিত অবশ‌্য ভিন্ন।
সাধারণত, সেইসময় সিনেমাহলগুলিতে তিনটি শো চলত– একটা, চারটে, সাতটা কিংবা দুটো, পাঁচটা, আটটা। অর্থাৎ, ম‌্যাটিনি শো, ইভনিং শো এবং নাইট শো। এর সঙ্গে যোগ হল নুন শো। সেটা সকাল ১১টায় এবং বেলা ১২টায়। সেই নুন ও নাইট শোয়ে প্রদর্শিত হত প্রধানত হিন্দিতে ডাব করা দক্ষিণী ‘সি’ গ্রেডের ছবি। তার সঙ্গে মাঝে-মাঝে জুড়ে দেওয়া হত পর্ন। হল বিশেষে তার দৈর্ঘ কম-বেশি হতে পারত। মুশকিল হল, প্রেক্ষাগৃহে আনসেন্সরড কনটেন্ট দেখানো হচ্ছে জানতে পেরে পুলিশ-প্রশাসন নড়েচড়ে বসল। শুরু হল পুলিশের অভিযান, ধড়পাকড়। ধরা পড়ে বেশ কিছু হলের জরিমানা হল, এমনকী লাইসেন্সও বাতিল হতে থাকল।
নতুন সমস‌্যা হাজির হল সেই সিনেমা হলগুলির সামনে। আর্থিক ক্ষতি তো হলই, সেই সঙ্গে তাদের ভাবমূর্তিও ধাক্কা খেল। কলেজের ছাত্র, বেকার যুবক, কুলি-মজুররা সেই সব শোয়ে আসত। মহিলারা তার আশপাশেও ঘেঁষতো না। ‘খারাপ ছবি চলে’ বলে রক্ষণশীল আম বাঙালি তাদের প্রত‌্যাখান করল। ‘ভুল’ বুঝতে পেরে পিছু হঠল তারা। একেকটা সিনেমা হলকে টিকিট কাউন্টারে নোটিশ টাঙাতে হল– ‘এখানে অশ্লীল ছবি দেখানো হয় না। বুঝিয়া টিকিট কাটিবেন।’ কেননা, ততদিনে আবার ‘এ’ মার্কা সিনেমার দর্শক প্রত‌্যাশা নিয়ে সিনেমা হলে ঢুকে হতাশ হলে হল ভাঙচুর করতে শুরু করছিল।
তাহলে বিকল্প কী? এই সময় সিনেমা হলগুলি পুরানো সিনেমা ফের চালানোর সিদ্ধান্ত নিল। সহায় হলেন প্রয়াত উত্তমকুমার আর সেইসময়ে বলিউডে জমি হারাতে থাকা অমিতাভ বচ্চন। তাঁদের পুরানো ছবিগুলি হলে নতুন করে মুক্তি পেতে দর্শক আবার হলে ফিরতে শুরু করল। একদিকে, প্রবীণরা হলে এসে তাঁদের যৌবনের দিনগুলোকে যেমন ফিরে পেতেন, তেমনই ইয়ং জেনারেশনও দুই ‘কিংবদন্তি’কে বড়পর্দায় দেখতে ছুটে এল। ১৯৮৮ সালে মুক্তি পাওয় অমিতাভ বচ্চনের ‘শাহেনশা’ যেখানে সুপারফ্লপ, সেই বাজারেই রমরমিয়ে চলেছে ‘শোলে’, দেশপ্রেমী’, ‘কালিয়া’র মতো ছবি। আবার, উত্তমকুমারের ‘স্ত্রী’, ‘অমানুষ’ ‘আনন্দআশ্রম’-এর মতো সিনেমা চুটিয়ে চলেছে। এই ট্রেন্ডটাও অবশ‌্য বেশিদিন টিকল না। তখন সাতদিনে সাত ছবির ‘কনসেপ্ট’ এল। সপ্তাহের সাতদিন তিনটি শোয়ে একটি করে পুরানো ছবি। এই ট্রেন্ডটাও হিট করল। অর্থাৎ, দর্শকের ভালো লাগল। তখন আবার সবচেয়ে বেশি হিট করল হিন্দি হরর ফিল্ম।
এই সংকটটা চলেছিল বছর তিনেক। এরপরেই ফের সিনেমা জগতে জোয়ার এল। সেই '৮৮ সালেই মুক্তি পেল আমির খান - জুহি চাওলা জুটির প্রথম ছবি ‘কয়ামত সে কয়ামত তক’। দেখুন যে বছর সুপারস্টার অমিতাভ বচ্চনের বিগবাজেটের অ‌্যাকশন ড্রামা ‘শাহেনশা’ সুপারফ্লপ, সেই বছরই রোমান্টিক ছবি ‘কয়ামত সে...’ সুপার-ডুপার হিট। এরপরেই শুরু হল রোমান্টিক সিনেমার মিছিল। আর সুপারহিট গান। সেই ‘নাইন্টিন’ ভারতীয় সিনেমায় অক্ষয় হয়ে রয়েছে। তাতে ভূমিকা রয়েছে বাংলা সিনেমারও। তারও ধারা পাল্টালো সেই সময়।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন