সৎ এবং অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ আখ্যানটি পাঠককে সাক্ষীর লড়াইয়ের সঙ্গে একটা সংযোগ তৈরি করে। যে লড়াইটা শুধু কার্পেটে নয়, পরিবারেও, এবং সমাজেও।
ভারতীয় ক্রীড়াবিদদের আত্মজীবনী এবং স্মৃতিকথার বইয়ের অভাব নেই। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাঁদের উজ্জ্বল কেরিয়ারের গণ্ডীতেই আবদ্ধ থেকে যায়। যাতে আর যাই থাকুক, কোনও গল্প থাকে না। পাঠকরা তাঁর সাফল্য ও কর্মজীবনের কৃতিত্বটি জেনে রোমাঞ্চিত হন বটে, কিন্তু সবার আড়ালে থেকে যাওয়া তাঁদের ব্যক্তি জীবনের নাগালটুকু পান না। ফলে পাঠক তাঁকে হয়তো সম্পূর্ণরূপে মূল্যায়ণ করতে ব্যর্থ হয়। এর মধ্যেই কিছু জীবনীমূলক বই সেই ছাঁচটিকে ভেঙে দিয়ে ক্রীড়াবিদের ব্যক্তি জীবনের পরিসরে ঢুকে পড়ে, তাঁর ট্রানজিশন পিরিয়ডের লড়াই, মানসিক পরিস্থিতি, পারিপার্শ্বিক আবহকে সুস্পষ্টভাবে পাঠকের সামনে তুলে ধরতে সফল হয়। এর সাম্প্রতিক উদাহরণ হল ‘উইটনেস’ (Witness)। কুস্তিগীর সাক্ষী মালিকের (Sakshi Malik) আত্মজীবনী। পোড়খাওয়া ক্রীড়া সাংবাদিক জোনাথন সেলভারাজ সহ-লেখক।
সাক্ষী মালিকের মতো সফল ক্রিড়াবিদের আত্মজীবনী যদি ছকে বাঁধাই হত, তবে তাতে শুধুই থাকতো ভারতের প্রথম মহিলা হিসাবে ওলিম্পিকে কুস্তিতে তাঁর পদবিজয়ের সাফল্যের বিবরণটুকুই আমরা পেতাম। কিন্তু আমরা সেখানে দেখছি সাক্ষীর মানসিক ও সামাজিক লড়াইয়ের পথটি খোঁজা হচ্ছে। এই সৎ এবং অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ আখ্যানটি পাঠককে সাক্ষীর লড়াইয়ের সঙ্গে একটা সংযোগ তৈরি করে। যে লড়াইটা শুধু কার্পেটে নয়, পরিবারেও, এবং সমাজেও। প্রখ্যাত মেময়ার লেখক জে আর মোহরিঙ্গারের মন্তব্যটিকে প্রতিধ্বনিত করে, যেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘স্মৃতিকথা হল জীবন থেকে খোদাই করা একটি গল্প।’
অনেক ভারতীয় ক্রীড়াবিদদের স্মৃতিকথার মধ্যেই ত্রুটি থেকে গিয়েছে। কারণ কী, তাঁরা কেবলই আত্মপ্রচারের উপর জোর দিয়েছেন। সচরাচর পাঠকের জানা ঘটনাগুলিকেই চকচকে করে আবার উপস্থাপন করা হয়েছে। আসলে তাঁদের সাফল্য-কেন্দ্রীক একটি সংস্করণ মাত্র। টেনিস আইকন আন্দ্রে আগাসি, প্রিন্স হ্যারির আত্মজীবনীর সহ-লেখক মোহরিঙ্গার এই প্রবণতা নিয়ে সতর্ক করেছেন। তাঁর কথায়, “a memoir isn’t about you. It’s a story carved from your life, a particular series of events chosen because they have the greatest resonance for the widest range of people.”
সাক্ষী মালিকের স্মৃতিকথা অস্বস্তিকর সত্য থেকে দূরে সরে যায় না। এটি তাঁর সম্পর্কের জটিলতা, তাঁর যৌন হয়রানির অভিজ্ঞতা, তাঁর নিরাপত্তাহীনতা এবং এমনকি প্রতি ম্যাচের আগে তাঁর মুখোমুখি হওয়ার ভয়কে স্পর্শ করে। সাক্ষীর জয় করার ইচ্ছা তাঁর গল্পটিকে সাধারণ ‘বিজয়ের উদযাপন’ স্মৃতিকথা থেকে আলাদা করে এবং পাঠকদের তাঁর জগতে নিয়ে যায়।
উইটনেস-এর সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিকগুলির মধ্যে একটি হল, সাক্ষী এখানে একটি বহুমাত্রিক দৃষ্টিভঙ্গী প্রকাশ করেছেন। বস্তুত, তিনি শুধুমাত্র একজন কুস্তি চাম্পিয়ান তো নন, বরং জীবনের জটিলতার সঙ্গে লড়াই করা একজন মানুষও। সাক্ষীর গল্পটি দ্বন্দ্বে পূর্ণ– তিনি একজন আত্মবিশ্বাসী ক্রীড়াবিদ, তিনিই আবার শরীর সম্পর্কে আত্মসচেতন মহিলা– ফ্যাশনেবল পোশাকে নিজের পেশীবহুল শরীর দেখতে পছন্দ করেন না। বইটিতে তাঁর পরিচয়, সম্পর্ক এবং তাঁর নিজের রাজ্য হরিয়ানায় চির-বর্তমান পিতৃতন্ত্রের সঙ্গে তাঁর সংগ্রামের কথা বর্ণনা করেছেন, যেখানে একজন সফল মহিলা ক্রীড়াবিদকেও কুস্তির পোশাকে নিজেকে উপস্থাপিত করার জন্য সমালোচনায় বিদ্ধ হন।
সাক্ষীর গল্পটিকে আরও মর্মান্তিক করে তোলে তার চারপাশের পরিবেশ-পরিস্থিতি বর্ণনায় তাঁর সততা। তাঁর সাফল্যে পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা স্বীকার করার পাশাপাশি, তাঁর প্যাশন, কুস্তির প্রতি নিঃশর্ত ভালোবাসা কীভাবে খ্যাতি ও রোজাগার বৃদ্ধির সঙ্গে লোভে পরিণত হয়েছিল। এই ধরনের বিশুদ্ধ, অন্তর্নিহিত আত্ম-সচেতনতা খেলাধুলার স্মৃতিতে বিরল, যা প্রায়শই এই সাফল্যের পিছনে মানুষের সমর্থন এবং দ্বন্দ্বের চেয়ে কৃতিত্বের উপর বেশি প্রাধান্য দেয়।
কুস্তি খেলাটির সঙ্গে অপরিচিত পাঠকদের জন্য সাক্ষীর স্মৃতিকথায় খেলাটির প্রযুক্তিগত দিকগুলি জানা যাবে। যেমন ওয়েট লস এবং বিভিন্ন ধরণের টেকডাউন। অতিরঞ্জিত করে পাঠকদের অভিভূত করার পরিবর্তে, সাক্ষী সেলভারাজের কলমের মাধ্যমে উচ্চস্তরের কুস্তির জন্য প্রস্তুতি নেওয়া এবং অংশ নেওয়ার অর্থ কী তার স্পষ্ট ছবিটি এঁকেছেন।
উইটনেস-এর সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্বীকারোক্তি হল সাক্ষীর প্রতিটি লড়াইয়ের আগে তার ভয়ের স্বীকৃতি। এমন একটি বিশ্বে যেখানে ক্রীড়াবিদদের প্রায়শই নির্ভীক এবং মানসিকভাবে দৃঢ় হিসাবে চিত্রিত করা হয়, তাঁর ‘ভয়, কখনও কখনও প্রায় দুশ্চিন্তায় অসুস্থ’ হয়ে পড়ার অকপট স্বীকারোক্তি সেই স্টেরিওটাইপকে চ্যালেঞ্জ করে। এটি ‘চ্যালেঞ্জকে আলিঙ্গন করার’ স্বাভাবিক প্ল্যাটিটিউড থেকে একটি সতেজ পরিবর্তন যা ক্রীড়াবিদদের ভাষ্যে প্রাধান্য পেয়ে থাকে। তাঁর গল্পটি কেবল ময়দানে জয়ের কাহিনী নয় বরং অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ জয়েরও।
উইটনেস-এর সাফল্য শুধু সাক্ষীর আকর্ষণীয়, বৈচিত্রময় ও ঘটনাবহুল জীবনের গল্পেই নয়, জোনাথন সেলভারাজের দক্ষ গল্প বলার মধ্যেও রয়েছে। লেখক হিসাবে সেলভারাজের নৈপুণ্য সাক্ষীর কণ্ঠকে উজ্জ্বল করেছে। তাঁর জীবনযাপনের অভিজ্ঞতাকে প্রামাণ্যভাবে এবং অতিরঞ্জিত করা ছাড়াই উপস্থাপন করেছে। তাঁর বর্ণনামূলক দক্ষতায় গতি এবং ফোকাস টানটান থাকে, যা পাঠকের মনোযোগ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ধরে রাখে।
স্মৃতিকথা সম্পর্কে মোহরিঙ্গারের দর্শন, যা নিছক স্ব-প্রচারের চেয়ে গল্প বলার গুরুত্বের উপর জোর দেয়, উইটনেস-এর সমস্ত পাতায় তা স্পষ্ট। সাক্ষীর স্মৃতিকথা তার কৃতিত্বের উদযাপনের চেয়েও বেশি, একটি গভীর মানবিক গল্প যা এর বিশুদ্ধ সততা, ব্যক্তিগত ও সামাজিক সংগ্রামকে উন্মোচিত করার সাহস। একজন কুস্তিগীরই এই সাহস দেখাতে পারেন।
সাক্ষী মালিকের মতো সফল ক্রিড়াবিদের আত্মজীবনী যদি ছকে বাঁধাই হত, তবে তাতে শুধুই থাকতো ভারতের প্রথম মহিলা হিসাবে ওলিম্পিকে কুস্তিতে তাঁর পদবিজয়ের সাফল্যের বিবরণটুকুই আমরা পেতাম। কিন্তু আমরা সেখানে দেখছি সাক্ষীর মানসিক ও সামাজিক লড়াইয়ের পথটি খোঁজা হচ্ছে। এই সৎ এবং অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ আখ্যানটি পাঠককে সাক্ষীর লড়াইয়ের সঙ্গে একটা সংযোগ তৈরি করে। যে লড়াইটা শুধু কার্পেটে নয়, পরিবারেও, এবং সমাজেও। প্রখ্যাত মেময়ার লেখক জে আর মোহরিঙ্গারের মন্তব্যটিকে প্রতিধ্বনিত করে, যেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘স্মৃতিকথা হল জীবন থেকে খোদাই করা একটি গল্প।’
অনেক ভারতীয় ক্রীড়াবিদদের স্মৃতিকথার মধ্যেই ত্রুটি থেকে গিয়েছে। কারণ কী, তাঁরা কেবলই আত্মপ্রচারের উপর জোর দিয়েছেন। সচরাচর পাঠকের জানা ঘটনাগুলিকেই চকচকে করে আবার উপস্থাপন করা হয়েছে। আসলে তাঁদের সাফল্য-কেন্দ্রীক একটি সংস্করণ মাত্র। টেনিস আইকন আন্দ্রে আগাসি, প্রিন্স হ্যারির আত্মজীবনীর সহ-লেখক মোহরিঙ্গার এই প্রবণতা নিয়ে সতর্ক করেছেন। তাঁর কথায়, “a memoir isn’t about you. It’s a story carved from your life, a particular series of events chosen because they have the greatest resonance for the widest range of people.”
সাক্ষী মালিকের স্মৃতিকথা অস্বস্তিকর সত্য থেকে দূরে সরে যায় না। এটি তাঁর সম্পর্কের জটিলতা, তাঁর যৌন হয়রানির অভিজ্ঞতা, তাঁর নিরাপত্তাহীনতা এবং এমনকি প্রতি ম্যাচের আগে তাঁর মুখোমুখি হওয়ার ভয়কে স্পর্শ করে। সাক্ষীর জয় করার ইচ্ছা তাঁর গল্পটিকে সাধারণ ‘বিজয়ের উদযাপন’ স্মৃতিকথা থেকে আলাদা করে এবং পাঠকদের তাঁর জগতে নিয়ে যায়।
উইটনেস-এর সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিকগুলির মধ্যে একটি হল, সাক্ষী এখানে একটি বহুমাত্রিক দৃষ্টিভঙ্গী প্রকাশ করেছেন। বস্তুত, তিনি শুধুমাত্র একজন কুস্তি চাম্পিয়ান তো নন, বরং জীবনের জটিলতার সঙ্গে লড়াই করা একজন মানুষও। সাক্ষীর গল্পটি দ্বন্দ্বে পূর্ণ– তিনি একজন আত্মবিশ্বাসী ক্রীড়াবিদ, তিনিই আবার শরীর সম্পর্কে আত্মসচেতন মহিলা– ফ্যাশনেবল পোশাকে নিজের পেশীবহুল শরীর দেখতে পছন্দ করেন না। বইটিতে তাঁর পরিচয়, সম্পর্ক এবং তাঁর নিজের রাজ্য হরিয়ানায় চির-বর্তমান পিতৃতন্ত্রের সঙ্গে তাঁর সংগ্রামের কথা বর্ণনা করেছেন, যেখানে একজন সফল মহিলা ক্রীড়াবিদকেও কুস্তির পোশাকে নিজেকে উপস্থাপিত করার জন্য সমালোচনায় বিদ্ধ হন।
সাক্ষীর গল্পটিকে আরও মর্মান্তিক করে তোলে তার চারপাশের পরিবেশ-পরিস্থিতি বর্ণনায় তাঁর সততা। তাঁর সাফল্যে পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা স্বীকার করার পাশাপাশি, তাঁর প্যাশন, কুস্তির প্রতি নিঃশর্ত ভালোবাসা কীভাবে খ্যাতি ও রোজাগার বৃদ্ধির সঙ্গে লোভে পরিণত হয়েছিল। এই ধরনের বিশুদ্ধ, অন্তর্নিহিত আত্ম-সচেতনতা খেলাধুলার স্মৃতিতে বিরল, যা প্রায়শই এই সাফল্যের পিছনে মানুষের সমর্থন এবং দ্বন্দ্বের চেয়ে কৃতিত্বের উপর বেশি প্রাধান্য দেয়।
কুস্তি খেলাটির সঙ্গে অপরিচিত পাঠকদের জন্য সাক্ষীর স্মৃতিকথায় খেলাটির প্রযুক্তিগত দিকগুলি জানা যাবে। যেমন ওয়েট লস এবং বিভিন্ন ধরণের টেকডাউন। অতিরঞ্জিত করে পাঠকদের অভিভূত করার পরিবর্তে, সাক্ষী সেলভারাজের কলমের মাধ্যমে উচ্চস্তরের কুস্তির জন্য প্রস্তুতি নেওয়া এবং অংশ নেওয়ার অর্থ কী তার স্পষ্ট ছবিটি এঁকেছেন।
উইটনেস-এর সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্বীকারোক্তি হল সাক্ষীর প্রতিটি লড়াইয়ের আগে তার ভয়ের স্বীকৃতি। এমন একটি বিশ্বে যেখানে ক্রীড়াবিদদের প্রায়শই নির্ভীক এবং মানসিকভাবে দৃঢ় হিসাবে চিত্রিত করা হয়, তাঁর ‘ভয়, কখনও কখনও প্রায় দুশ্চিন্তায় অসুস্থ’ হয়ে পড়ার অকপট স্বীকারোক্তি সেই স্টেরিওটাইপকে চ্যালেঞ্জ করে। এটি ‘চ্যালেঞ্জকে আলিঙ্গন করার’ স্বাভাবিক প্ল্যাটিটিউড থেকে একটি সতেজ পরিবর্তন যা ক্রীড়াবিদদের ভাষ্যে প্রাধান্য পেয়ে থাকে। তাঁর গল্পটি কেবল ময়দানে জয়ের কাহিনী নয় বরং অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ জয়েরও।
উইটনেস-এর সাফল্য শুধু সাক্ষীর আকর্ষণীয়, বৈচিত্রময় ও ঘটনাবহুল জীবনের গল্পেই নয়, জোনাথন সেলভারাজের দক্ষ গল্প বলার মধ্যেও রয়েছে। লেখক হিসাবে সেলভারাজের নৈপুণ্য সাক্ষীর কণ্ঠকে উজ্জ্বল করেছে। তাঁর জীবনযাপনের অভিজ্ঞতাকে প্রামাণ্যভাবে এবং অতিরঞ্জিত করা ছাড়াই উপস্থাপন করেছে। তাঁর বর্ণনামূলক দক্ষতায় গতি এবং ফোকাস টানটান থাকে, যা পাঠকের মনোযোগ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ধরে রাখে।
স্মৃতিকথা সম্পর্কে মোহরিঙ্গারের দর্শন, যা নিছক স্ব-প্রচারের চেয়ে গল্প বলার গুরুত্বের উপর জোর দেয়, উইটনেস-এর সমস্ত পাতায় তা স্পষ্ট। সাক্ষীর স্মৃতিকথা তার কৃতিত্বের উদযাপনের চেয়েও বেশি, একটি গভীর মানবিক গল্প যা এর বিশুদ্ধ সততা, ব্যক্তিগত ও সামাজিক সংগ্রামকে উন্মোচিত করার সাহস। একজন কুস্তিগীরই এই সাহস দেখাতে পারেন।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন