লেখক গল্পগুলিতে সেই নাগরিক জীবন ও গ্রামীণ জীবন উভয় পরিপ্রেক্ষিতকেই উপস্থাপন করেছেন নিজস্বতায়।
একজন বিদ্ধস্ত মানুষ কখনও কখনও বারান্দার এসে রেলিংয়ে হাত রেখে অন্ধকার আকাশের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তখন সে শেষ দেখার সংকল্প করে। ঘুরে দাঁড়াবে বলে স্থির করে। অন্ধকার আকাশে তারকারাজির বিন্দু-বিন্দু আলোক-যুদ্ধের পরাক্রম তার মনে বিপুল শক্তি সঞ্চার করে। আমার হাতে আসা এই বইটির প্রচ্ছদের ছবিটি জীবনের সেই আশ্বাসের।
প্রথমে অতটা অবশ্য অনুধাবন করতে পারিনি। বইটি পড়তে পড়তে যত এগিয়েছে, ততই এই ছবির মর্মবোধ হয়েছে। এটাই বুঝেছি, আমাদের সবারই আপাত সহজ-সচ্ছন্দ্য জীবযাত্রা আসলে অভ্যাসে বাস। কখনও প্রিয়জন বিচ্ছেদের শোক, কিংবা কখনও প্রিয় সময় হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণা। এবার কলকাতা বইমেলা শুরু আগেই প্রকাশিত হয়েছে দেবাশিস কর্মকারের গল্প সংকলন ‘অভ্যাসে বাস’। বইটিতে ২৩টি গল্প রয়েছে। প্রতিটি গল্পই ভিন্ন, কিন্তু কোথায় যেন এক সুরে গাঁথা।
বর্তমান বাংলা বইয়ের বাজারে থ্রিলার, ভূত-প্রেত কিংবা উগ্র যৌনতার ছড়াছড়ি। সেগুলেও সাহিত্য, এবং তারও পাঠক আছে। জনপ্রিয়তাও বেড়েছে। চাহিদা রয়েছে। কিন্তু তার মধ্যেই কিছু-কিছু লেখক এর সম্পূর্ণ বিপরীতে গিয়ে সমসাময়িক আর্থ-সমাজিক প্রেক্ষাপটে গল্প-উপন্যাস লিখছেন। বই বিক্রির নিশ্চয়তা না থাকাতেও এই ধরনের বই লেখা ও প্রকাশ করতে হলে লেখক ও প্রকাশকের মনের জোর থাকতে হয়। সেই সাহস ও মনের জোর হল ‘অভ্যাসে বাস’।
বইটিতে রয়েছে সহজ গদ্যে লেখা ২৩টি গল্প। যেখানে ধরা রয়েছে এমন এক অস্থির সময়, যখন পুঁজিবাদী অর্থনীতির একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ, তথ্য-প্রয়ুক্তির অপরিহার্য উত্থান ও শাসন টালমাটাল করেছে পূর্বেকার সকল প্রথা মূল্যবোধকে মানুষের জীবন ও সমাজ অনেক নতুন। লেখক এই গল্পগুলিতে সেই নাগরিক জীবন ও গ্রামীণ জীবন উভয় পরিপ্রেক্ষিতকেই উপস্থাপন করেছেন নিজস্বতায়। অত্যন্ত সাবলীলতার সঙ্গে জীবনের কোনও খণ্ডমুহূর্ত বা স্বল্প অবকাশকে মূর্ত করে তুলেছেন লেখক।
এটি লেখকের প্রথম বই। তবে লিখছেন দীর্ঘ সময় ধরে। ৩৫ বছর ধরে সাংবাদিকতার পাশাপাশি লিখেছন অজস্র গল্প। সাংবাদিকতার সূত্রেই বাংলার বিভিন্ন অংশে ঘুরেছেন, বহু মানুষ ও পরিবেশের সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন।তাঁর গল্পে সেইসব ছাপ রয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, জ্ঞানগর্ভ বিবরণের পাণ্ডিত্য প্রদর্শণের চেয়ে সংক্ষিপ্ত ছবি তুলে ধরেছেন লেখক। সংবাদ লেখেন বলেই বোধহয় খুব অল্প শব্দে পুরো বিষয়টা প্রকাশ করতে পারেন লেখক। সে কারণে, বইয়ের বেশিরভাগ গল্পই খুব সংক্ষিপ্ত। আর অনেক ক্ষেত্রেই শেষটুকু যেন অসমাপ্ত। লেখক যেন ইতি টানার ব্যপারটা পাঠকের উপরেই ছেড়ে দিয়েছেন। তাই গল্পগুলো পড়া শেষ করেও পাঠক অনেকটা সময় ধরে এর পরিণতি নিয়ে নিজের মধ্যেই চিন্তা করতে থাকেন। আরও একটা দিক হল গল্পগুলোর কোনও কাল্পনিক ইতি নেই। যেমন একটা গল্প উল্লেখ করে শেষ করবো। ‘দুলেচাঁদ’। এমন গল্প আপনারা অনেক পড়েছেন। বৃদ্ধা মাকে ছেলে স্টেশনে ছেড়ে চলে আসে। সেই হারিয়ে যাওয়া বুড়িদের শেষ পরিণতি কী হয়? সাধারণত গল্পে তাঁকে কোনও পিতৃ-মাতৃহীন বড়লোক পরিবার যত্ন করে তুলে যায়। কোনও কর্পোরেট ধাঁচের এনজিও তাঁকে তাদের বৃদ্ধাশ্রমে ঠাঁই দেয়। নতুন সাচ্ছন্দ্যের জীবন পান সেই বুড়ি। কিন্তু, দেবাশিসের গল্পটি শেষ হচ্ছে না। শুধু একটি নির্মম ইঙ্গিত দিচ্ছে। সে বুড়ি বাঁচবে। বাঁচবে শুধু ‘অভ্যাসে’।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন