স্টেট বনাম নানাবতী: গল্প-উপন‌্যাসকেও হার মানায় যে ঐতিহাসিক হত্যা মামলা

মামলা কাচের মতো স্পষ্ট ছিল। একজন লোক বাড়িতে ঢুকে একজনকে গুলি করে খুন করছে। নিজেই থানায় গিয়ে আত্মসমর্পণ করছে। স্বীকার করছে খুনের কথা। কিন্তু...

স্টেট বনাম নানাবতী: গল্প-উপন‌্যাসকেও হার মানায় যে ঐতিহাসিক হত্যা মামলা

ভারতের আইনি ইতিহাসে ‘স্টেট বনাম কে.এম. নানাবতী’ মামলা একটি মাইলফলক। যা যে কোনও গল্প-উপন‌্যাসকে হার মানায়। ১৯৫৯ সালের এই হত্যা মামলা শুধু আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, সামাজিক ও মিডিয়া দৃষ্টিকোণ থেকেও অসাধারণ আলোড়ন তুলেছিল। এটি সেই প্রথম কয়েকটি মামলার একটি যা জনমানসকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছিল। দেশের সমস্ত মূল ধারার সংবাদপত্র তো বটেই, বিদেশের কিছু সংবাদপত্রেও নিয়মিতভাবে এই মামলার সংবাদ প্রকাশিত হত।

কে.এম. নানাবতী ছিলেন ভারতীয় নৌবাহিনীর একজন অফিসার। তাঁর স্ত্রী, একজন বিদেশী, সিলভিয়া নানাবতী একটি বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন প্রেম আহুজার সঙ্গে, যিনি একজন বিখ‌্যাত  পার্সি ব্যবসায়ী। সিলভিয়া যখন এই সম্পর্কের কথা স্বামীকে জানান, তখন নানাবতী একটি রিভলভার নিয়ে আহুজার বাড়িতে যান এবং সেখানেই আহুজাকে গুলি করে হত্যা করেন।

ঘটনার পর নানাবতী নিজেই পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেন এবং হত্যার দায় স্বীকার করেন।

নিম্ন আদালতে ‘ডিফেন্স’ আইনজীবী জানান, নাভাল অফিসার নানাবতী ও সিলভিয়ার বিয়ের দশবছর পার হয়ে গেছিল। তাদের দুই সন্তানও আছে। একদিন লম্বা ডিউটির শেষে বাড়ি ফেরেন নানাবতী। তিনি লক্ষ‌্য করেন তাঁর স্ত্রী তাঁর থেকে বেশ দূরত্ব রেখে চলছে। সিলভিয়াকে এর কারণ জানতে চান নানবতী। তখন সিলভিয়া প্রেম আহুজা নামে এক ব‌্যক্তির সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কথা জানান নানাবতীকে।

নিম্ন আদালতে নানবতীর আইনজীবী জানান, সেদিন নানাবতী পরিবার নিয়ে নাইটশোয়ে সিনেমা দেখতে যান। কিন্তু, স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের হলে রেখেই মাঝপথে সিনেমা ছেড়ে নাভাল হেডকোর্য়ার্টারে পৌঁছন। তিনি নিজের নামে সার্ভিস রিভলবার ইস‌্যু করান। নানাবতী আত্মহত‌্যা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু, তাঁর মনে হয় তার আগে তিনি একবার প্রেম আহুজার সঙ্গে কথা বলবেন। 

এই মনে করে নানাবতী পৌঁছন আহুজার বাড়ি। নানাবতী পুলিশকে যেমনটা জানিয়েছিলেন, তিনি আহুজাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে তাঁর অবর্তমানে তিনি কি সিলভিয়া ও তাঁর ছেলেমেয়েদের দায়িত্ব নেবেন? জবাবে আহুজা বলেন, যে মহিলাদের সঙ্গে তিনি শুয়েছেন তাদের সবার দায়িত্ব নিতে গেলে তাঁর স্ত্রীর সংখ‌্যা একশো ছাড়িয়ে যাবে। এরপর, সিলভিয়া সমপ্রেকে কটুক্তি করতে থাকেন আহুজা। স্ত্রীর সম্পর্কে যে কথা কোনও স্বামীই সহ‌্য করতে পারেন না। নানবতী রিভলবার থেকে আহুজাকে গুলি করেন। ঘটনাস্থেলেই মৃত‌্যু হয় আহুজার। আহুজার পরিচারক গুলির শব্দে ছুটে এসে দেখেন আহুজা রক্তাক্ত অবস্থায় ঘরের মেঝেতে পড়ে রয়েছে। এই জায়গায় আদালতে ডিফেন্স জানান, এটি খুন নয় একটা দুর্ঘটনা। নানাবতীর হাত থেকে আচমকা রিভলবার পড়ে গিয়ে গুলি ছুটে আহুজার শরীরে ঢুকে যায়। তাতেই আহুজার মৃত‌্যু হয়েছে।


এই মামলাটি সে সময়ে জনমানসে একটি বিশেষ প্রভাব ফেলে। প্রথমত, তখন সবে সবে দেশ স্বাধীন হয়েছে। ফলে সেনা জওয়ানদের প্রতি জনতার শ্রদ্ধা রয়েছে। আর নানাবতী একজন নাভাল অফিসার। দ্বিতীয়ত, এর সঙ্গে রামায়নের সাদৃশ‌্য টেনে আনেন কেউকেউ। একজন বিবাহিত মহিলার সঙ্গে প্রেম করে আহুজা খলনায়ক হয়ে ওঠেন, আর তাকে মেরে নানবতী ‘হিরো’ হয়ে ওঠেন। তাকে সমর্থনে নেমে পড়ে মানুষ। শুনানি চলার সময় প্রতিদিনই আদালতের বাইরে বহু মানুষের ভীড় থাকতো। এমনকী, কিছু সমবাদপত্রও নানাবতীর পক্ষ নিয়ে ফেলে।

সেই সময় আমাদের দেশে বিচার ব‌্যবস্থায় জুরি সিস্টেম ছিল। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশিষ্টদের নিয়ে এই জুরি গঠিত হত। তারা অভিযুক্ত দোষী না নির্দোষ– সেই মত জানাতে পারতো। রায় দেওয়ার অধিকারী জুরি ছিল না। রায় একমাত্র বিচারপতিই দিতে পারতেন।

এই স্পষ্ট মামলাতে সেই জুরি নানাবতীকে ‘নট গিল্টি’ বলে মত দেয়। আদালতের বাইরে অপেক্ষারত জনতা প্রায় উৎসবে মেতে ওঠে। কিন্তু, জুরির এই সিদ্ধান্ত শোনার পর বিচাপতির পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যায়। তিনি রায় না দিয়ে মামলাটি সরাসরি হাই কোর্টে পাঠিয়ে দেন।

হাই কোর্টে ডিফেন্স তাদের বয়ান একটু পরিবর্তন করে। তাঁরা বলেন, সেই রাতে নানাবতী আহুজার বেডরুমে গেলে, সেই সময় আহুজা বাথরুমে ছিল। তিনি একটি সাদা টাওয়েল জড়িয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসেন। নানবতীর সঙ্গে তাঁর তপ্ত বাক‌্য বিনিময় হয়। সেই সময় উত্তেজিত হয়ে আহুজাকে লক্ষ‌্য করে গুলি চালান নানবতী। এখানে দুর্ঘটনা তত্ত্ব থেকে সরে আসেন ডিফেন্স আইনজীবী। 

হাই কোর্টে দোষী সাব‌্যস্ত হন নানাবতী। তাঁকে যাবজ্জীবন কারদণ্ড দেওয়া হয়। এই রায়ে প্রচণ্ড মর্মাহত হয় জনতা। কিন্তু, সুপ্রিম কোর্টেও এই রায় বহাল থাকে। মামলাটিতে সাম্প্রদায়িক রংও চড়েছিল। পার্সি বনাম সিন্ধি সম্প্রদায়ের লড়াইয়ের রূপ পেয়েছিল। তিন বছর কারাবাসের পর নানবতীকে জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। তিনি ক্ষমা চেয়ে আহুজার বোনকে চিঠি লেখেন।

এই মামলাটি ‘ভারতীয় দণ্ডবিধির ধারা ৩০২’ (নরহত‌্যা) এবং ‘ধারা ৩০৪’ (গুরুতর আঘাতে মৃত্যু ঘটানো)-র মধ্যে পার্থক্য এবং তা প্রয়োগ নিয়ে ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি করে। এই প্রশ্নও ওঠে —একজন সম্মানিত অফিসার আবেগের বশে খুন করলে সেটা কি আইনের চোখে আলাদা দৃষ্টিতে দেখা উচিত? শুধু তা-ই নয়, এই মামলাটি ভারতীয় সমাজে পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধ, নারীর স্বাধীনতা, ও মিডিয়ার প্রভাব নিয়ে ব্যাপক আলোচনা সৃষ্টি করে। পার্সি সম্প্রদায় ও নৌবাহিনীও এতে আলোচনায় উঠে আসে।

এই মামলার ভিত্তিতে ১৯৭৩ সালে ‘অচানক’ নামে একটি সিনেমা এবং পরবর্তীতে আরও কয়েকটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়, যার মধ্যে ২০১৬ সালের ‘রুস্তম’ অন্যতম।

‘স্টেট বনাম নানাবতী’ শুধুমাত্র একটি খুনের মামলা নয়—এটি আইন, নৈতিকতা, সামাজিক মনোবিজ্ঞান, মিডিয়া এবং রাজনীতির জটিল সংমিশ্রণ। এটি দেখিয়ে দেয় কীভাবে আইনের প্রয়োগে আবেগ, মর্যাদা, এবং জনমত প্রভাব ফেলতে পারে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিচারবিভাগ আইনের পথেই চলে।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন