প্রয়াত সাহিত্যিক প্রফুল্ল রায়: বাংলা সাহিত্যের এক নিঃশব্দ বিপ্লবী

প্রফুল্ল রায় ছিলেন সমাজমনস্ক লেখক। তাঁর কলম বারবার ফিরে গেছে সেইসব মানুষের কাছে, যারা ইতিহাসের প্রান্তে পড়ে থাকে—ভূমিহীন কৃষক, দলিত শ্রমিক, নারী, উদ্বাস্তু।

প্রফুল্ল রায় ছিলেন সমাজমনস্ক লেখক। তাঁর কলম বারবার ফিরে গেছে সেইসব মানুষের কাছে, যারা ইতিহাসের প্রান্তে পড়ে থাকে—ভূমিহীন কৃষক, দলিত শ্রমিক, নারী, উদ্বাস্তু।

বাংলা সাহিত্যের প্রগাঢ় স্বর, প্রফুল্ল রায় আর নেই। জীবন ও বাস্তবতার নির্মম, কিন্তু সংবেদনশীল বর্ণনায় যিনি পাঠকসমাজকে চমকে দিয়েছিলেন একাধিকবার, সেই শক্তিশালী কথাসাহিত্যিক প্রফুল্ল রায়ের প্রয়াণ বাংলা সাহিত্যের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টে ১৫ মিনিট নাগাদ দক্ষিণ কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯১ বছর।

প্রফুল্ল রায় ছিলেন মূলত সাধারণ মানুষের লেখক। তাঁর কলমে উঠে এসেছে ছিন্নমূল, দরিদ্র, লাঞ্ছিত মানুষের বাস্তবতা। তাঁর লেখায় কখনও নেই অকারণ অলঙ্কার, নেই বাহুল্য। আছে শুধুই নির্ভেজাল, নির্মম সত্য। সেই জন্যই ভাতের গন্ধ সীমারেখা মুছে যায়, মানুষের যুদ্ধ, স্বর্গের এক বাসিন্দা, কেয়াপাতার নৌকো, শতধারায় বয়ে যায়, উত্তাল সময়ের ইতিকথা-র র মতো উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে এক অন্য মাত্রা এনেছিল। বিশেষ করে তাঁর কালজয়ী উপন্যাস ‘গঙ্গাস্নান’, যা পরবর্তীতে ধারাবাহিক ও টেলিফিল্মেও রূপ পায়, গ্রামীণ ভারতের গরিব সমাজ ও দলিত শ্রেণীর এক অমোঘ দলিল হয়ে উঠেছে।

প্রফুল্ল রায় ছিলেন সমাজমনস্ক লেখক। তাঁর কলম বারবার ফিরে গেছে সেইসব মানুষের কাছে, যারা ইতিহাসের প্রান্তে পড়ে থাকে—ভূমিহীন কৃষক, দলিত শ্রমিক, নারী, উদ্বাস্তু। দেশভাগের বেদনা, জাতপাতের নির্মমতা, রাজনৈতিক শোষণ—সবই ছিল তাঁর লেখার মূল উপজীব্য। তিনি কখনওই ‘নিরপেক্ষ’ ছিলেন না; বরং সাহিত্যের মাধ্যমে প্রশ্ন তুলেছেন, প্রতিবাদ করেছেন, শেকড়ে ফিরে যাওয়ার ডাক দিয়েছেন।

সাহিত্যজগতে তাঁর অবদান অসামান্য। তিনি একাধারে লিখেছেন উপন্যাস, ছোটগল্প, আত্মজীবনী, এবং নাটক। তাঁর লেখা বহু গ্রন্থ পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বাংলা সাহিত্যে তিনি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন, কিন্তু অবহেলিত রেখেছে মূল ধারার প্রতিষ্ঠানে। তবু তিনি থেমে থাকেননি। তিনি জানতেন, সাহিত্য শুধু শিল্প নয়—এটি এক সামাজিক দায়বদ্ধতা। প্রফুল্ল রায় অবিভক্ত ভারত, অধুনা বাংলাদেশের ঢাকা জেলায়, বিক্রমপুরের আটপাড়া গ্রামে ১১ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন। স্বাধীনতার পর ১৯৫০ সালে তিনি ভারতে চলে আসেন। পরে তিনি কলকাতার স্থায়ী বাসিন্দা হন।

মৃত্যুর আগ পর্যন্তও তিনি লেখালেখিতে সক্রিয় ছিলেন। সাম্প্রতিক সময়েও তাঁকে দেখা গেছে ছোট পত্রিকায়, বিভিন্ন সাহিত্যসভায়, তরুণ লেখকদের উৎসাহ দিতে। তাঁর মত, অভিজ্ঞতা ও জীবনবোধ অনুপ্রাণিত করেছে নতুন প্রজন্মকেও। প্রফুল্ল রায় নেই, কিন্তু বাংলা সাহিত্যের পাতায় পাতায় তিনি রয়ে গেলেন। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন—সাহিত্য হতে পারে শ্রদ্ধার, ত্যাগের, প্রতিবাদের ভাষা। তাঁর প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা। বাংলা সাহিত্যের এই নিঃশব্দ বিপ্লবীকে প্রণাম জানাই।

প্রফুল্ল রায় থাকবেন বইয়ের পাতায়, মননের গভীরে। তাঁর জীবন ও সাহিত্য চর্চা, ভবিষ্যতের পথপ্রদর্শক হয়ে থাকুক।

সাহিত‌্য সৃষ্টির জন্য প্রফুল্ল রায় সারা জীবন অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। ২০০১ সালে 'মুক্তিযোদ্ধা কাজি ফয়জল' উপন্যাসের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে দিয়েছে একুশে সাহিত্য পদক। 'ক্রান্তিকাল'-এর জন্য ২০০৩ এ সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার। 'আকাশের নিচে মানুষ'র জন্য ১৯৮৫-তে 'বঙ্কিম পুরস্কার', এছাড়াও 'রামকুমার ভুয়ালকা', পাবলিশার্স এন্ড বুক সেলার্স গিল্ড এর 'লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট', 'শরৎস্মৃতি', 'বি কে জে এ' ইত্যাদি সম্মানে ভূষিত হয়েছেন।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন