শীতল যুদ্ধের ছায়ায় নেপাল ও শ্রীলঙ্কা যেভাবে আমেরিকার কাছে ‘নতুন কিউবা’ হয়ে ওঠে

১৯৬০-এর দশকে মার্কিন সংবাদমাধ্যম কীভাবে নেপাল ও শ্রীলঙ্কাকে ‘ইন্ডিয়ার কিউবা’ আখ্যা দিয়েছিল এবং কিউবার ছায়ায় এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে কীভাবে সন্দেহ ও উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছিল, তা নিয়ে এক ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ।

শীতল যুদ্ধের ছায়ায় নেপাল ও শ্রীলঙ্কা যেভাবে আমেরিকার কাছে ‘নতুন কিউবা’ হয়ে ওঠে


রাজীবাক্ষ
১৯৬০-এর দশকের গোড়ার দিকে বিশ্ব রাজনীতির মানচিত্রে এক অদ্ভুত উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক ও সংবাদমাধ্যমের মধ্যে। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব ক্রমশ লাতিন আমেরিকা ছাড়িয়ে এশিয়ার দিকে বাড়ছে—এই আশঙ্কায় তারা তাকিয়ে থাকে দক্ষিণ এশিয়ার দিকে। সেই সময় কিউবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চোখে ‘কমিউনিস্ট হুমকি’র প্রতীক হয়ে উঠেছিল। হাভানার বিপ্লব এবং ফিদেল কাস্ত্রোর সোভিয়েতপন্থী অবস্থান মার্কিন বিদেশনীতিকে ত্রস্ত করে তোলে। সেই ছায়াতেই জন্ম নেয় এক নতুন আতঙ্ক—এশিয়ায় কোনও ‘নতুন কিউবা’ কি গড়ে উঠছে?

এই প্রশ্নই মার্কিন সংবাদমাধ্যম ও কূটনৈতিক বৃত্তে ঘুরপাক খেতে থাকে যখন হিমালয়ের কোলে নেপাল এবং ভারত মহাসাগরের দ্বীপ শ্রীলঙ্কা (তৎকালীন সিলোন) এক নতুন ধরনের রাজনৈতিক পথ অনুসরণ করতে শুরু করে। নেপালে সেই সময় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বিপি কৈরৈলৈ। তিনি ভারতের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চিনের সঙ্গে একটি স্বাধীন কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করছিলেন। এমনকি তিনি বেজিং সফরও করেন। ভারতের দৃষ্টিভঙ্গিতে এই পদক্ষেপ ছিল সন্দেহজনক, আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিতে তা একপ্রকার বিপজ্জনক।

এই সময়েই রাজা মহেন্দ্র এক নির্বাহী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে কৈরালাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেন এবং সংসদ ভেঙে দেন। ভারত এই পদক্ষেপের তীব্র বিরোধিতা করে। কিন্তু রাজতন্ত্রের ঘনিষ্ঠ চিন এই পরিস্থিতিকে ব্যবহার করে কূটনৈতিক প্রভাব বিস্তারের সুযোগ খুঁজতে থাকে। মার্কিন সাংবাদিক প্যাট্রিক কিলেন তখন এক প্রবন্ধে নেপালকে আখ্যা দেন ‘ইন্ডিয়ার কিউবা’ হিসেবে। তার মতে, এই পাহাড়ি রাষ্ট্রটি হয়তো খুব তাড়াতাড়িই চিনা প্রভাবের অধীনে চলে যেতে পারে এবং সেখানে নতুন এক ধরনের ‘কমিউনিস্ট বিপ্লব’ ঘটতে পারে।

অন্যদিকে, শ্রীলঙ্কায় সিরিমাভো বন্দরনায়েকের নেতৃত্বে ক্ষমতায় আসে এক বাম-ঘেঁষা সরকার। তারা তেল ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ রাষ্ট্রীয়করণের পথে হাঁটে, বিদেশি সংস্থাগুলিকে নিয়ন্ত্রণে আনে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একটি নিরপেক্ষ ও আত্মনির্ভরশীল অবস্থান নিতে থাকে। আমেরিকার পক্ষে এই অবস্থান ছিল অস্বস্তিকর। ‘নিউ ইয়র্ক হেরাল্ড ট্রিবিউন’-এ ভিক্টর রাইজেল তখন সিলোনকেও একইভাবে ‘ইন্ডিয়ার কিউবা’ বলে বর্ণনা করেন। তাঁর মতে, এই দ্বীপরাষ্ট্রটির রাজনৈতিক চলন ও আমেরিকাবিরোধী মনোভাব একে একটি বিপজ্জনক কৌশলগত বিন্দুতে দাঁড় করাচ্ছে।

এই সময়ে মার্কিন বিদেশনীতি মূলত ঠান্ডা যুদ্ধের ছায়ায় আবৃত। যে কোনও দেশে সমাজতান্ত্রিক বা বামমুখী আন্দোলন মানেই তা হয়ে উঠছিল ‘কমিউনিজমের ঘাঁটি’। সেই অবস্থান থেকেই ভারত মহাসাগরের ও হিমালয়ের কিছু রাষ্ট্রকে তারা সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করে। ভারত নিজেই তখন ‘নন অ্যালায়ন্ড মুভমেন্ট’-এর অন্যতম মুখ, যা মার্কিন বা সোভিয়েত দুই শিবিরেরই মধ্যে না থেকে স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি গড়তে চায়। এই পরিস্থিতিতে ভারতের প্রতিবেশীদের দিকে নজর রাখা ছিল আমেরিকার একপ্রকার অপরিহার্য দায়।

তবে নেপাল বা শ্রীলঙ্কা কোনওটাই শেষ পর্যন্ত ‘নতুন কিউবা’ হয়ে ওঠেনি। তারা উভয়েই নিজেদের রাজনৈতিক অক্ষ রেখায় থেকে গণতান্ত্রিক বা আধা-গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে আগায়। চিনের প্রভাব নেপালে বেড়েছিল ঠিকই, কিন্তু সেটা ভারত-চিন সম্পর্কের টানাপোড়েনের একটি দিকমাত্র ছিল। আর শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক রাষ্ট্রীয়করণ ও নিরপেক্ষ কূটনীতি কোনও সময়েই কিউবার মতো খোলাখুলি মার্কিনবিরোধিতা নয়।

এখানেই দেখা যায় আন্তর্জাতিক রাজনীতির এক সূক্ষ্ম বাস্তবতা। যখন কোনও রাষ্ট্র পশ্চিমের প্রভাববলয় থেকে একটু সরে গিয়ে নিজস্ব পথে হাঁটে, তখন সেটিকে সহজেই বিপজ্জনক বলে চিহ্নিত করা হয়। কিউবা তখন ছিল এক ছায়া—যা দিয়ে মাপা হচ্ছিল এশিয়ার অন্য যেকোনও দেশের রাজনৈতিক অবস্থান। ‘ইন্ডিয়ার কিউবা’ বলে তকমা দেওয়া মানে শুধু সন্দেহ নয়, বরং স্নায়ুযুদ্ধের চূড়ান্ত অবিশ্বাস ও একতরফা ধারণা।

আজ, ছয় দশক পরে, সেই ভয় আর নেই। কিন্তু এই ঘটনাগুলি আমাদের মনে করিয়ে দেয়—কীভাবে আন্তর্জাতিক মিডিয়া, কূটনীতি ও গোপন অজানা ভয় একসঙ্গে জটিল করে তোলে ছোট দেশগুলির অবস্থানকে। কিউবার ছায়া থেকে আজ আর কেউ ত্রস্ত নয়, কিন্তু তার প্রতিচ্ছবি এখনও ইতিহাসের পাতায় জ্বলজ্বল করে।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন