বাংলা, বাঙালি ও বাংলাভাষী - গুলিয়ে যায় না যেন

নিছক প্রশাসনিক ভুল নয়, বরং একটি বৃহত্তর সাংস্কৃতিক অজ্ঞতার প্রতিফলন। 

বাংলা, বাঙালি ও বাংলাভাষী - গুলিয়ে যায় না যেন

বাংলাভাষী মানেই বাংলাদেশী—এই ধারণা আবারও আমাদের জাতীয় মননে এক অস্বস্তিকর প্রশ্ন তুলে দিল। সাম্প্রতিক ঘটনাবলির দিকে তাকালে মনে হয়, ‘বাংলা’ ভাষাটি যেন ভারতের নিজস্ব সংস্কৃতির নয়, বরং প্রতিবেশী রাষ্ট্রের কোনও 'গোপন সংকেত'! অথচ বাস্তব হল, বাংলাভাষা ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন ও সমৃদ্ধ ভাষা। এই ভাষায় কথা বলেন কেবল বাংলাদেশ নয়, ভারতের অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, অসমের বড় অংশ এবং এমনকি ঝাড়খণ্ড, ওড়িশার সীমান্তবর্তী অঞ্চলেও বহু মানুষ। তবুও, যখন বাংলাভাষী কোনও মানুষ দিল্লির রাস্তায় হাঁটেন বা রাজস্থানের কোনও কাজের সাইটে শ্রমিক হিসেবে থাকেন, তখন তাঁকে সন্দেহের চোখে দেখা হয়, বলা হয়—“বাংলাদেশী”।

খবরে প্রকাশ, প্রায় ৩০০–৪০০ বাংলা ভাষাভাষী শ্রমিককে বেআইনি অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত করে পুলিশ তাঁদের আটক করেছে। তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগের কাছেই ছিল আধার, ভোটার আইডি কিংবা নথিভুক্ত ঠিকানা—যা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করত, তাঁরা ভারতেরই নাগরিক। কিন্তু ভাষার ভিত্তিতে তাঁদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হল এক প্রকার রাষ্ট্রীয় সন্দেহ। একইসঙ্গে দিল্লিতে ঘটে গেল আরও মারাত্মক ঘটনা—বীরভূম জেলার ৬ জনকে গ্রেফতার করে বাংলাদেশ সীমান্তে ধাক্কা দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হল। এই ৬ জনের মধ্যে ছিল তিনটি শিশু। কোনও রকম পূর্বসতর্কতা ছাড়াই তাঁদের ‘বাংলাদেশী’ আখ্যা দিয়ে নির্বাসিত করা হল।

এইসব ঘটনা নিছক প্রশাসনিক ভুল নয়, বরং একটি বৃহত্তর সাংস্কৃতিক অজ্ঞতার প্রতিফলন। ভারতীয় গণতন্ত্রে আমরা যে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের কথা বলে থাকি, সেখানে আজ বাংলা ভাষা যেন এক উদ্বাস্তু পরিচয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। সিনেমা, সাহিত্য, ইতিহাস— সর্ব ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের অবদান অনস্বীকার্য। তবুও গোটা ভারতে আজও একটা বড় অংশ জানে না যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, সত্যজিৎ রায়, বিবেকানন্দ—সবাই পশ্চিমবঙ্গের সন্তান। বাইরে থেকে বাংলাভাষা শুনলেই “বাংলাদেশী” বলে ফিসফিস শুরু হয়। এটা কেবলমাত্র অজ্ঞতা নয়, বরং আমাদের নিজেদের ব্যর্থতাও—আমরা আমাদের পরিচয় সারা ভারতে জোরালোভাবে তুলে ধরতে পারিনি।

এই সাংস্কৃতিক বিভ্রান্তি আরও বেড়েছে যখন রাজনৈতিক দলগুলি ভাষার সঙ্গে জাতীয়তাবাদ গুলিয়ে দিয়ে রাজনীতি করতে শুরু করেছে। বিজেপি বনাম তৃণমূল—এই দ্বন্দ্বে বাংলাভাষী পরিচয় মাঝখানে পড়ে বিপন্ন হয়ে পড়েছে। তৃণমূল যখন বলে বাংলাভাষী শ্রমিকদের হেনস্থা করা হচ্ছে, বিজেপি পাল্টা বলে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী রুখতেই প্রশাসন সক্রিয়। এই কাদা ছোঁড়াছুঁড়িতে ভাষার আসল মর্যাদাটাই যেন চাপা পড়ে যায়।

বাংলা ভাষা আজ ভারতের অভ্যন্তরে একটি প্রশ্নবিদ্ধ পরিচয়ে পরিণত হয়েছে। প্রশাসন যদি বৈধ নথি থাকা সত্ত্বেও কাউকে ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে দেগে দেয়, তবে সেটি রাষ্ট্রের নৈতিক ব্যর্থতা। একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে, যেখানে আমরা AI আর চন্দ্রযাত্রার গল্প বলি, সেখানে ভাষা শুনে নাগরিকতা বিচার করা নিছক অন্ধতা।

এই মুহূর্তে প্রয়োজন একটি সর্বভারতীয় সচেতনতা, যা স্পষ্ট করবে—ভাষা জাতীয় পরিচয়ের একমাত্র মানদণ্ড নয়। একই ভাষা বহু দেশে থাকতে পারে, যেমন ইংরেজি, ফরাসি বা স্প্যানিশ। বাংলাও তেমনই এক ভাষা, যা বাংলাদেশ এবং ভারতের মাঝে সাংস্কৃতিক সেতু হয়ে আছে। এই সেতুকে আমরা যদি শত্রুতা দিয়ে ভাঙি, তবে হারবে শুধু মানবিকতা।

পশ্চিমবঙ্গের মানুষদের উচিত এখন নিজেদের পরিচয়কে আরও জোরালোভাবে জাতীয় পরিসরে তুলে ধরা। তাদের ইতিহাস, সংগ্রাম, সাহিত্য, সংস্কৃতি যেন শুধু বাংলা চ্যানেলে আটকে না থাকে। আমাদের দরকার এমন একটি জাতীয় বিবেক, যা বাংলা ভাষাকে আলাদা দেশ হিসেবে দেখে না, বরং ভারতের বহু ভাষার মাঝে একটি গর্বিত ভাষা হিসেবে গ্রহণ করে। নয়তো বাংলাভাষী ভারতীয়দের অস্তিত্ব নিয়েই প্রশ্ন উঠতে থাকবে, এবং একদিন হয়তো এই প্রান্তিকতা চরম অসন্তোষের জন্ম দেবে—যার পরিণতি কোনও রাজনৈতিক দল চাইবে না।

এটি এখন কেবল ভাষা-পরিচয়ের লড়াই নয়, বরং একটি জাতিগত মর্যাদার প্রশ্ন। বাংলা ভাষা ভারতের, বাঙালিও ভারতীয়—এ সত্য প্রতিষ্ঠা করাই এখন সময়ের দাবি।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন