সাহিত্যে যৌনতা: আত্মপরিচয় ভাঙার ও গড়ার রহস্যময় অন্বেষণ

মানুষ আজ পরিচয় নির্মাণ করছে যৌনতা দিয়েই—স্ট্রেট, কুইয়ার, ইনসেল কিংবা প্যানসেক্সুয়াল—এবং আবার সেই যৌনতাই পরিচয়ের সংকটকেও উসকে দিচ্ছে।

সাহিত্যে যৌনতা: আত্মপরিচয় ভাঙার ও গড়ার রহস্যময় অন্বেষণ

ডাচ লেখিরা ইয়ায়েল ভান ডের ওয়াউডেন-এর প্রথম উপন্যাস The Safekeep যখন মহিলাদের জন্য বরাদ্দ সাহিত্য পুরস্কার (
2025 Women's Prize for Fiction) জিতে নেয়, বিচারকেরা শুধু সাহসী যৌনদৃশ্যযুক্ত এক লেখাকে পুরস্কৃত করেননি, তাঁরা স্বীকৃতি দিয়েছেন এমন এক কণ্ঠস্বরকে, যা যৌনতাকে ইতিহাস, পরিচয়, এবং সমকালীন মানব-মনস্তত্ত্বের অন্তরাত্মায় মিশিয়ে এক ব্যতিক্রমী আখ্যান নির্মাণ করে। যৌনতা এই উপন্যাসে কেবল উত্তেজনা নয়—এটা অস্তিত্বের বুননে ঢুকে পড়ে, সত্ত্বাকে ভেঙেচুরে নতুন করে গড়ে তোলে।

আধুনিক সাহিত্যের এই মোড় ঘোরানো সময়টা এক অদ্ভুত দ্বৈততায় আক্রান্ত—একদিকে পরিচয় রাজনীতি, অন্যদিকে সর্বব্যাপী পর্নগ্রাফি। মানুষ আজ পরিচয় নির্মাণ করছে যৌনতা দিয়েই—স্ট্রেট, কুইয়ার, ইনসেল কিংবা প্যানসেক্সুয়াল—এবং আবার সেই যৌনতাই পরিচয়ের সংকটকেও উসকে দিচ্ছে। এই দ্বন্দ্বের ভিতরে দাঁড়িয়ে কিছু লেখক সাহিত্যে যৌনতাকে রূপ দিয়েছেন এক গভীর, প্রজ্ঞাবান অভিযাত্রায়। ইয়ায়েল, মিরান্ডা জুলাই, স্যালি রুনি, কিংবা গার্থ গ্রিনওয়েল—তাঁদের লেখায় যৌনতা চমক নয়, আত্ম-উন্মোচন। আর সেই উন্মোচন কখনও কখনও আত্মাবিলয় পর্যন্ত পৌঁছায়।

তবু এই ধারা নতুন নয়। উনবিংশ শতকের শেষ থেকে যৌনতা সাহিত্যে প্রবেশ করেছে ‘মনুষ্যত্বের মুক্তি’ হিসেবে। Lady Chatterley’s Lover-এ ডি.এইচ. লরেন্স যে বিকারহীন কামজ মুহূর্তে মানবমন খুঁজে পেয়েছিলেন, তারই পথ বেয়ে এসেছে হেনরি মিলার, আনাইস নিন, জর্জ বাতাইয়ের মত লেখকদের লেখনী। কখনও উগ্র, কখনও দার্শনিক। সত্তরের দশকে এর বিরুদ্ধে উঠেছিল নারীবাদী কলম—কেট মিলেটের Sexual Politics, এরিকা জংয়ের Fear of Flying—যেখানে যৌনতাকে ভেঙে দেখা শুরু হল, মহিমাকীর্তন নয়, বিশ্লেষণ। কিন্তু এরপর নিজ নারীবাদী ঘরেই সেই দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এল। সুসান সনট্যাগ এবং অ্যাঞ্জেলা কার্টারের মতো লেখক যৌনতাকে চিনলেন এক আত্মানুসন্ধানী, র‌্যাডিক্যাল অভিজ্ঞতা হিসেবে—যেখানে কামনা বাস্তবতাকে ভেঙে দেয়, এবং আত্মপরিচয় নতুন করে গড়ে ওঠে।

এই ঘরানায় বর্তমানে কাজ করছেন যাঁরা, তাঁরা সাহিত্যে যৌনতাকে পুনরাবিষ্কার করছেন—এবার অধিকতর স্পষ্টতা ও ভিন্নভাষ্য দিয়ে। গ্রিনওয়েলের BDSM দৃশ্য হোক, বা জেন বিগিন ও কে প্যাট্রিক-এর লেখায় লেসবিয়ান কামনার বর্ণনা—সবখানেই যৌনতা একটা অন্তর্লীন রূপান্তরের ইশারা। দেহ আর মন পরস্পরকে অতিক্রম করে যায়, এবং পাঠক শুধু একজন কাহিনির দর্শক নয়—সে সেই আত্মপরিবর্তনেরও সহযাত্রী হয়ে ওঠে।

কিন্তু এই পুনরাবিষ্কারের সবচেয়ে সাহসী প্রয়াস সম্ভবত মিরান্ডা জুলাইয়ের All Fours-এ। যৌনতা এখানে না শুধু কামনা, বরং মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষাগার, যেখানে নারী তার মধ্যবয়সে এসে খুঁজে পায় যৌনতা ও স্বপ্নের অন্বয়। কোনও রূপক নয়, কোনও লুকোনো ইঙ্গিত নয়—বরং মাতৃত্বে জর্জর এক নারীর নিজের শরীরের অন্ধকার চৌহদ্দিতে প্রবেশ করে সে। পেরিমেনোপজাল কামনা, একলা হোটেল ঘরে ফ্যান্টাসির নির্মাণ, পুরুষহীন যৌন পরিতৃপ্তির সন্ধান—সব মিলিয়ে এই উপন্যাস সাহিত্যের প্রথাগত যৌনতাকে ছাপিয়ে যায়।

আশ্চর্যজনকভাবে, এই লেখকদের অধিকাংশই সমকামী যৌনতাকে তাদের উপন্যাসের ভিত্তি করেছেন। হয়তো কারণ এই যে, এখানেই সবচেয়ে অকপট ও আন্তরিকভাবে যৌনতাকে উপস্থাপন করা যায়—যেখানে পরিচয় নির্ধারিত নয়, বরং প্রতিনিয়ত নির্মাণশীল। The Safekeep-এ যেমন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে এক ইহুদি নারী ও এক গোঁড়া খ্রিস্টান নারীর সম্পর্ক যেভাবে শরীর ঘণিষ্ঠতা ও ক্ষমতা-রাজনীতির মধ্যে দোদুল্যমান—তাতে ইতিহাসও যেন কামনায় বিলীন হয়।

হেটারোসেক্সুয়াল লেখায় যৌনতা লেখার সাহসিকতা এখন অধিক জটিল। কারণ এইখানে এখনও 'পুংচিন্তায়িত' কামনার এক ছায়া পড়ে থাকে। তা সত্ত্বেও স্যালি রুনি ও ইমার ম্যাকব্রাইড সাহিত্যে এমনভাবে যৌন দৃশ্য নির্মাণ করেছেন, যা গভীর আত্মজিজ্ঞাসা ও দেহানুভূতির কোলাহলে পাঠককে গ্রাস করে নেয়। তাঁদের লেখায় যৌনতাও যেন চিন্তার অংশ, চরিত্র বিশ্লেষণের হাতিয়ার।

সবশেষে, সাহিত্যে যৌনতা যেন এক অন্তহীন দরজা, যেটা খোলে আত্মপরিচয়ের নতুন নতুন স্তরে। বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গে যেখানে প্রবেশ করে অন্য এক স্তর—রূপক, স্বপ্ন, সম্ভাবনা। সেখানে শরীরও ভাষা হয়ে ওঠে। কামনাও হয়ে ওঠে জ্ঞানের নতুন তত্ত্ব। আমরা হয়তো পর্নো যুগে বাস করছি, কিন্তু সাহিত্যে যৌনতাই এখনও একমাত্র দরজা—যার ভিতর দিয়ে আমরা আমাদের চেনা সীমারেখা মুছে ফেলতে পারি। এবং নতুন করে সৃষ্টি করতে পারি আমাদের নিজস্বতা।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন