এই প্রবণতার নজির পাওয়া গেছে মধ্যপ্রদেশের ধারা ও বিদিশা, উত্তরপ্রদেশের এটাহ, ঝাঁসি ও কৌশাম্বী, রাজস্থানের বহজ, কিংবা দিল্লির মেহরৌলি পার্কের মতো অঞ্চলগুলির সাম্প্রতিক খনন কাজে।
সম্প্রতি ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া (ASI)-র খনন কার্যে যে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক অভিমুখ স্পষ্ট হয়ে উঠছে, তা শুধুমাত্র একাডেমিক বা ঐতিহাসিক বিতর্কের বিষয় নয়, বরং দেশের সামাজিক সংহতি ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের পক্ষেও তা গভীর উদ্বেগের ইঙ্গিত বহন করে। প্রত্নতত্ত্ব কোনও নিছক ধ্বংসাবশেষ বা মৃত অতীতের খোঁজ নয়—এ এক জীবনধারার, বহুস্তরীয় সমাজ-ইতিহাসের স্তবক, যা মানুষকে তার শিকড় ও বহুত্বের সঙ্গে পরিচিত করায়। কিন্তু সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে, কেন্দ্রের মদতে এবং নির্দিষ্ট ভাবাদর্শে চালিত কিছু মহলের সক্রিয় চেষ্টায় এই প্রত্নতাত্ত্বিক খনন এখন যেন ইতিহাস নয়, হিন্দু অতীতের কেবলমাত্র একচ্ছত্র মহিমা প্রতিপাদনের ‘যন্ত্র’ হয়ে উঠছে।
এই প্রবণতার নজির পাওয়া গেছে মধ্যপ্রদেশের ধারা ও বিদিশা, উত্তরপ্রদেশের এটাহ, ঝাঁসি ও কৌশাম্বী, রাজস্থানের বহজ, কিংবা দিল্লির মেহরৌলি পার্কের মতো অঞ্চলগুলির সাম্প্রতিক খনন কাজে। প্রতিবারই সংবাদমাধ্যমে প্রচার করা হয়েছে, “এখানে হিন্দু মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গিয়েছে”, “মুসলিম শাসকরা মন্দির ভেঙে মসজিদ তৈরি করেছিল”—এই ধরনের ভাষ্য। অথচ, প্রত্নতত্ত্ব মানে কেবল ধর্মীয় স্থাপত্যের ভগ্নাবশেষ নয়, বরং অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, বসবাসের ধরণ, কৃষি ও বাণিজ্যচর্চা, বহিরাগতদের আগমন, স্থানীয় জনগোষ্ঠীর প্রতিক্রিয়া—এই সমস্ত কিছুর সম্মিলিত পঠন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, এই খনন কাজে তার অনেকটাই অনুপস্থিত। ইতিহাসের বহুমাত্রিকতা একদিকে সরিয়ে রেখে যেন একরৈখিক ‘সত্য’ প্রতিষ্ঠার নিরন্তর চেষ্টা চলছে।
এই প্রবণতা কিন্তু বিচ্ছিন্ন নয়। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (RSS)-এর দীর্ঘদিনের অভীষ্ট ছিল—‘ভারত মানেই হিন্দু ভারত’। সেই লক্ষ্যেই চলছে পাঠ্যপুস্তকের পুনর্লিখন, মুঘলদের অবদানকে মুছে দেওয়া, এবং সাম্প্রদায়িক ভেদরেখা আরও ঘনীভূত করা। প্রত্নতত্ত্বের মতো একটি শাস্ত্রীয়, বৈজ্ঞানিক শাখাকে সেই রাজনৈতিক প্রোজেক্টের হাতিয়ারে পরিণত করার প্রয়াস কেবল উদ্বেগজনক নয়, মারাত্মক। কারণ, ইতিহাস যখন উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিকৃত হয়, তখন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিজেদের অতীতকে ভুলভাবে জানে, এবং সেই ভুল চেতনার উপর দাঁড়িয়ে সমাজে বিভাজন আরও গভীর হয়।
ASI- এর যদিও বৈজ্ঞানিকভাবে নিরপেক্ষ থাকার কথা, তবু তার সাম্প্রতিক কার্যকলাপে বারবার প্রশ্ন উঠেছে। একদিকে সংখ্যালঘুদের আশঙ্কা বেড়েছে, অন্যদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠদের এক শ্রেণির মধ্যে একধরনের জয়োল্লাস তৈরি করা হচ্ছে—যেন প্রাচীন ভারতের হিন্দু পরিচয় প্রতিষ্ঠার প্রতিটি খোঁজ কোনও বিজয়গাথা। অথচ ভারতের ইতিহাস মূলত এক বহুত্ববাদী মিলনক্ষেত্র, যেখানে আর্য, দ্রাবিড়, মৌর্য, গুপ্ত, মুসলিম, ব্রিটিশসহ বহু শাসক, সংস্কৃতি, ভাষা ও ধর্ম একে অপরকে ছুঁয়ে গেছে, মিশে গেছে, কখনও সংঘর্ষ করেছে, আবার কখনও সহাবস্থান করেছে।
এইভাবে প্রত্নতত্ত্বকে রাজনীতির হাতে তুলে দিলে একদিন হয়তো এমন দিন আসবে, যখন কোনও মসজিদ বা গির্জা সংলগ্ন অঞ্চলে কেবল ‘পুরানো মন্দিরের ভিত্তি’ খুঁজে পাওয়া যাবে, এবং তার ভিত্তিতে তৈরি হবে নতুন আইন, অথবা জনমত প্রভাবিত করে তৈরি হবে নির্বাচনমুখী বিবরণ। এটা শুধু ইতিহাসের অপব্যবহার নয়, এটা দেশের ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তির উপর আঘাত।
প্রয়াসটা কিসের? উদ্দেশ্যটা কেবল অতীতের 'হিন্দু গৌরব' পুনরুদ্ধার নয়। আসল লক্ষ্য, বর্তমান ও ভবিষ্যতের একরৈখিক জাতীয়তাবাদের ভিত গড়ে তোলা—যেখানে ভিন্নমত, ভিন্ন ধর্ম, ভিন্ন ইতিহাস—সবকিছুকে প্রশ্নবিদ্ধ করা যায়। এই 'সাংস্কৃতিক আধিপত্য' কেবল একটি ধর্মীয় পরিচয়ের পুনরুজ্জীবন নয়, বরং রাজনৈতিক ক্ষমতার টিকে থাকার কৌশল।
ভারতের ইতিহাস এক সরল রেখায় লেখা যায় না। তাই প্রত্নতত্ত্বের খননও হওয়া উচিত নিরপেক্ষ, বৈজ্ঞানিক, ও বহুত্বের দর্শনকে সঙ্গে রেখে। অন্যথায়, আমরা শুধু অতীতের ধ্বংসস্তূপ খুঁড়ে দেখব না—আমাদের ভবিষ্যতের সহাবস্থানকেও সেখানে চাপা দিয়ে ফেলব। আর একবার ইতিহাস রাজনীতির হাতে বন্দি হয়ে গেলে, গণতন্ত্রের সবচেয়ে প্রাজ্ঞ ভিত্তি—সত্য, বৈচিত্র্য ও সহিষ্ণুতা—সেই জীর্ণভবনে চিরতরে চাপা পড়ে যাবে।
সম্প্রতি ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া (ASI)-র খনন কার্যে যে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক অভিমুখ স্পষ্ট হয়ে উঠছে, তা শুধুমাত্র একাডেমিক বা ঐতিহাসিক বিতর্কের বিষয় নয়, বরং দেশের সামাজিক সংহতি ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের পক্ষেও তা গভীর উদ্বেগের ইঙ্গিত বহন করে। প্রত্নতত্ত্ব কোনও নিছক ধ্বংসাবশেষ বা মৃত অতীতের খোঁজ নয়—এ এক জীবনধারার, বহুস্তরীয় সমাজ-ইতিহাসের স্তবক, যা মানুষকে তার শিকড় ও বহুত্বের সঙ্গে পরিচিত করায়। কিন্তু সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে, কেন্দ্রের মদতে এবং নির্দিষ্ট ভাবাদর্শে চালিত কিছু মহলের সক্রিয় চেষ্টায় এই প্রত্নতাত্ত্বিক খনন এখন যেন ইতিহাস নয়, হিন্দু অতীতের কেবলমাত্র একচ্ছত্র মহিমা প্রতিপাদনের ‘যন্ত্র’ হয়ে উঠছে।
এই প্রবণতার নজির পাওয়া গেছে মধ্যপ্রদেশের ধারা ও বিদিশা, উত্তরপ্রদেশের এটাহ, ঝাঁসি ও কৌশাম্বী, রাজস্থানের বহজ, কিংবা দিল্লির মেহরৌলি পার্কের মতো অঞ্চলগুলির সাম্প্রতিক খনন কাজে। প্রতিবারই সংবাদমাধ্যমে প্রচার করা হয়েছে, “এখানে হিন্দু মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গিয়েছে”, “মুসলিম শাসকরা মন্দির ভেঙে মসজিদ তৈরি করেছিল”—এই ধরনের ভাষ্য। অথচ, প্রত্নতত্ত্ব মানে কেবল ধর্মীয় স্থাপত্যের ভগ্নাবশেষ নয়, বরং অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, বসবাসের ধরণ, কৃষি ও বাণিজ্যচর্চা, বহিরাগতদের আগমন, স্থানীয় জনগোষ্ঠীর প্রতিক্রিয়া—এই সমস্ত কিছুর সম্মিলিত পঠন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, এই খনন কাজে তার অনেকটাই অনুপস্থিত। ইতিহাসের বহুমাত্রিকতা একদিকে সরিয়ে রেখে যেন একরৈখিক ‘সত্য’ প্রতিষ্ঠার নিরন্তর চেষ্টা চলছে।
এই প্রবণতা কিন্তু বিচ্ছিন্ন নয়। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (RSS)-এর দীর্ঘদিনের অভীষ্ট ছিল—‘ভারত মানেই হিন্দু ভারত’। সেই লক্ষ্যেই চলছে পাঠ্যপুস্তকের পুনর্লিখন, মুঘলদের অবদানকে মুছে দেওয়া, এবং সাম্প্রদায়িক ভেদরেখা আরও ঘনীভূত করা। প্রত্নতত্ত্বের মতো একটি শাস্ত্রীয়, বৈজ্ঞানিক শাখাকে সেই রাজনৈতিক প্রোজেক্টের হাতিয়ারে পরিণত করার প্রয়াস কেবল উদ্বেগজনক নয়, মারাত্মক। কারণ, ইতিহাস যখন উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিকৃত হয়, তখন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিজেদের অতীতকে ভুলভাবে জানে, এবং সেই ভুল চেতনার উপর দাঁড়িয়ে সমাজে বিভাজন আরও গভীর হয়।
ASI- এর যদিও বৈজ্ঞানিকভাবে নিরপেক্ষ থাকার কথা, তবু তার সাম্প্রতিক কার্যকলাপে বারবার প্রশ্ন উঠেছে। একদিকে সংখ্যালঘুদের আশঙ্কা বেড়েছে, অন্যদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠদের এক শ্রেণির মধ্যে একধরনের জয়োল্লাস তৈরি করা হচ্ছে—যেন প্রাচীন ভারতের হিন্দু পরিচয় প্রতিষ্ঠার প্রতিটি খোঁজ কোনও বিজয়গাথা। অথচ ভারতের ইতিহাস মূলত এক বহুত্ববাদী মিলনক্ষেত্র, যেখানে আর্য, দ্রাবিড়, মৌর্য, গুপ্ত, মুসলিম, ব্রিটিশসহ বহু শাসক, সংস্কৃতি, ভাষা ও ধর্ম একে অপরকে ছুঁয়ে গেছে, মিশে গেছে, কখনও সংঘর্ষ করেছে, আবার কখনও সহাবস্থান করেছে।
এইভাবে প্রত্নতত্ত্বকে রাজনীতির হাতে তুলে দিলে একদিন হয়তো এমন দিন আসবে, যখন কোনও মসজিদ বা গির্জা সংলগ্ন অঞ্চলে কেবল ‘পুরানো মন্দিরের ভিত্তি’ খুঁজে পাওয়া যাবে, এবং তার ভিত্তিতে তৈরি হবে নতুন আইন, অথবা জনমত প্রভাবিত করে তৈরি হবে নির্বাচনমুখী বিবরণ। এটা শুধু ইতিহাসের অপব্যবহার নয়, এটা দেশের ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তির উপর আঘাত।
প্রয়াসটা কিসের? উদ্দেশ্যটা কেবল অতীতের 'হিন্দু গৌরব' পুনরুদ্ধার নয়। আসল লক্ষ্য, বর্তমান ও ভবিষ্যতের একরৈখিক জাতীয়তাবাদের ভিত গড়ে তোলা—যেখানে ভিন্নমত, ভিন্ন ধর্ম, ভিন্ন ইতিহাস—সবকিছুকে প্রশ্নবিদ্ধ করা যায়। এই 'সাংস্কৃতিক আধিপত্য' কেবল একটি ধর্মীয় পরিচয়ের পুনরুজ্জীবন নয়, বরং রাজনৈতিক ক্ষমতার টিকে থাকার কৌশল।
ভারতের ইতিহাস এক সরল রেখায় লেখা যায় না। তাই প্রত্নতত্ত্বের খননও হওয়া উচিত নিরপেক্ষ, বৈজ্ঞানিক, ও বহুত্বের দর্শনকে সঙ্গে রেখে। অন্যথায়, আমরা শুধু অতীতের ধ্বংসস্তূপ খুঁড়ে দেখব না—আমাদের ভবিষ্যতের সহাবস্থানকেও সেখানে চাপা দিয়ে ফেলব। আর একবার ইতিহাস রাজনীতির হাতে বন্দি হয়ে গেলে, গণতন্ত্রের সবচেয়ে প্রাজ্ঞ ভিত্তি—সত্য, বৈচিত্র্য ও সহিষ্ণুতা—সেই জীর্ণভবনে চিরতরে চাপা পড়ে যাবে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন