টিস্যু পেপারের পানসি: কবিতার অলীক ভুবনে নিয়ে যায় কিছু গল্প

আপাত সম্পর্কহীন ন্যারেটিভ এলিমেন্টগুলি ক্রমাগত লেখক  মিলিয়ে দেন অনায়াসে, যা মনে হয় বিক্ষিপ্ত, পরমুহুর্তে নিটোল হয়ে ওঠে।

টিস্যু পেপারের পানসি: কবিতার অলীক ভুবনে নিয়ে যায় কিছু গল্প
K
সোম রায়চৌধুরী
টিস্যু পেপার দিয়ে তৈরি করা পানসি চিলকার জলে ডুবে যাওয়ায় লেখকের প্রথম কবিতার বই আলো দেখেনি। কিন্তু এখন 'টিস্যু পেপারের পানসি' এই সদ্য প্রকাশিত গল্পের বইটি পড়তে পড়তে মনে হল অবচেতনে লেখক একটি দীর্ঘ কবিতাই কি লিখে যাননি গল্পগুলি জুড়ে জুড়ে! দীর্ঘ সময় ধরে সযত্নে  লালন করে গেছেন নামটিকেই  আর ছোট গল্পগুলি দেখি লেখকের প্রথম ইচ্ছের কবিতার আলো হয়ে থোকা থোকা ফুটে আছে অনন্ত চরাচরে ...

প্রতিদিনের যে জীবন, দিনপ্রতি যে যাপন, তার  সর্বস্ব শরীরে ধারণ করেও, প্রাত্যাহিকতার সকল উদযাপনকে সাড়ম্বরে তার শব্দ শ্রুতি দৃশ্য সমেত রচনা করেও, প্রচলিত ন্যারেটিভ আর  সুররিয়ালিজম একসঙ্গে সেলাইয়ের নিপুণ ফোঁড়ে তুলে জাদুবাস্তবতার যে নির্মাণ লেখক করেন, সেই ম্যাজিক রিয়ালিজমই এই গল্পগুলিকে কবিতার অলীক ভুবনের দিকে নিয়ে যায়... 

বয়স্ক পুরুষ গৌরাঙ্গ, অবিবাহিত। তার সাড়ে চার হাজার টাকা বেতনের দমবন্ধ করা চাকরিতে ও স্নান ঘরে জুহি চাওলা আর অজস্র জুঁই ফুল লাক্স সাবানের সঙ্গে ঝরে পড়ে, ক্রমাগত বিয়ে ভেঙে যায় তার এবং শেষে একটি মেয়ে, শুধুমাত্র একটি মেয়ে হলেই যখন চলবে, তখন সেই স্বপ্ন দৃশ্যের উপরে করবী, যার ঠোঁটের উপর তিল সে এসে বসে, উন্মাদের মতো তিলের উপর আঙ্গুল ঘষে গৌরাঙ্গ, সদ্য কৈশোরের মতো বিছানা ভিজে যাওয়ার অনুষঙ্গে সে আবিষ্কার করে ফুরিয়ে যায়নি সে, ছোট বোন টুম্পা আরেকটি ভেঙে যাওয়া ছবি নিয়ে এলে, সেই মেয়েটির থুতনির তিলে সজোরে জ্বলন্ত বিড়ি ঠেসে ধরে গৌরাঙ্গ ....

কখনও কোনও গল্প শুরুই হয় এইভাবে - 'আমাদের ট্রেন ক্রমে বসন্তের মধ্যে প্রবেশ করে...'। ট্রেনের পরিচিত দৃশ্যের অজস্র মন্তাজ তৈরি হয়, যেমন নিপুণ সিনেমায় হয়, সব চরিত্রের ডিটেলের মধ্যে ঘুরে ফিরে মোবাইল চার্জের প্রসঙ্গ আসে। প্রান্তিক মেয়েটির মুড়ি খাওয়ার ডিটেল, বাঁশিওয়ালার প্রপাতের মতো পাঞ্জাবি, মেঘের কোলে বকের পাখার মতো ঠোঁট যার, সেই ঠোঁট বাঁশিতে ফুঁ দেয় আর গানহীন চৈত্র থেকে উঠে আসা মেয়েটি বাঁশিওয়ালাকে দ্যাখে, বাঁশিওয়ালার মেঘের মতো রঙ, লাল পাঞ্জাবি, যেন চৈত্রের বনে আগুন-  এই পর্যন্ত ভেবে যে মেদুর রোমান্টিক বাতাবরণের সৃষ্টি হয় তাকে নির্মমভাবেই লেখক ভেঙে দেন, যখন  মেয়েটির সঙ্গী  জল নিয়ে এসে বলে  'আরে রেন্ডি জলদি খা লে' এবং এই রেন্ডি শব্দটির কনট্রাস্ট এ মুহূর্তে সফল জাক্সটাপজিশন তৈরি হয় ।

প্লাগ পয়েন্ট , ফোন চার্জের প্রসঙ্গ, টাওয়ার না পাওয়া, তুমুল চলভাষ, নেটওয়ার্ক চলে যাওয়ার প্রবাহের মাঝেই  যতিচিন্থের মতো আসতে থাকে রংবেরঙের নানা মেয়ের দল, দ্বারভাঙা জিলা, পনির পকোড়া, ট্রেনের বিবিধ ফেরিওয়ালা, দশ টাকায় তিনটে পেন, আবারও ঘুরে আসে টপ আপ , লাইফ টাইম আর ছোট রিচার্জ ! কিন্তু কেন? কেন জীবনের বহতা স্রোতের একফালি ছবির মাঝে এত এত শব্দ ব্যবহার করেন লেখক যা শুধু ক্রমাগত আমাদের মোবাইলে অনর্গল কথার জন্ম দেয়, মোবাইল প্রবণতা বা শুধুই  অনন্ত কথার দিকে ঠেলে দেয় ...

না, শেষ টুকু ক্লাইম্যাক্স, জানতে গেলে আপনাকে পড়তে হবে 'আউট অফ রিচ' গল্পটি ...

' অঙ্ক ঘোড়া এবং ব্রহ্মকমল' গল্পে মেয়েটি বন্ধুকে বলে সে এমনি এমনিই অঙ্ক করে, কারণ অঙ্ক বৈরাগী মাছের টকের মতোই, একদিন না করলে মুখে রোচে না , আবার বিয়ের পর শাশুড়ি খোঁটা দিলে সে স্থানাঙ্ক জ্যামিতির মতোই  কাপড়ে পাকা ফোঁড় তুলে সেলাই করে ফেলে আস্ত আস্ত বেড কভার, এমব্রয়ডারি করে শাশুড়ির সাত বোনের গুষ্টিশুদ্ধু ব্লাউজ, অঙ্কই যে সে করে এভাবে সে তো বাকিরা জানতে পারে না, সেই মেয়ে জানে কোথায় ব্রহ্মকমল ফুল ফোটে আর কোথায় আটকাতে হয় অশ্বমেধ এর  ঘোড়া ...

একদমই সামান্য নয় ,আপাত সম্পর্কহীন ন্যারেটিভ এলিমেন্ট গুলি ক্রমাগত লেখক  মিলিয়ে দেন অনায়াসে, যা মনে হয় বিক্ষিপ্ত, পরমুহুর্তে নিটোল হয়ে ওঠে । 

আঘাত গল্পে দীপিকা, মল্লিকার মনে ভয় ধরিয়ে দেয় যে তৃণা একদিন তাকে চরম আঘাত করবে, মিষ্টি চেহারার ছোটখাটো মেয়েটি যে এমন কাজ করতে পারে দীপিকার ধারণাই ছিল না, মল্লিকা একদিন আঘাত পাবেই তৃণার থেকে এই ভয় নিয়ে গল্পটি শুরু হয়, তৃণাকে প্রতি মুহূর্তে পরীক্ষা করতে থাকেন মল্লিকা, প্রতিমুহূর্তে অপেক্ষা করেন তৃণা হয়তো তুমুল অপমান করবে বা রাগে ফেটে পড়বে কিন্তু একবারও তৃণার ব্যবহারে টাল পড়ে না, মল্লিকা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন, এমন পরিস্থিতি নির্মাণ করেন যেখানে মল্লিকা তৃণার ধিক্কারই প্রত্যাশা করছেন কিন্তু প্রতিবারই সেটি হয় না, আরও বেশি উন্মাদের মতো হয়ে উঠে মল্লিকা ক্লাইম্যাক্স-এ যা করেন এবং তৃণা যা করে সেটি আবারও একটি ম্যাজিক রিয়ালিজমের সুররিয়াল পরাবাস্তবতার সামনে আমাদের বাকরুদ্ধ  করে দেয়।

জাদু বাস্তবতার শীর্ষ ছুঁয়ে থাকে পিয়ানো গল্পটি। দুটি স্টেশন মধ্যবর্তী কিছু প্রান্তিক মানুষ এর একটি স্টেশনকে কেন্দ্র করে যে প্রায় অলৌকিক একটি আবহ তৈরি হতে পারে এই গল্পটি না পড়লে অবিশ্বাস্য লাগতে পারে। মিলান কুন্দেরার যে অবহ ভারহীনতা, তার দর্শন, মেটাথিম, যৌনতা আর স্যাটায়ার এবং জীবনের বহুমাত্রিকতা স্পর্শ করে যে অলীক জাদু বাস্তবতা মার্কেজের সিগনেচার, এই দুই বহতা স্রোত মিশে নির্মিত হয় তৃষ্ণার নিজস্ব চরাচর, যে চরাচরে জ্যোৎস্নায় ভেসে যাওয়া চিল্কার স্রোত থেকে তিনি তুলে নিয়ে আসছেন এক অপূর্ব  পানসি, টিস্যু পেপারের।

টিস্যু পেপারের পানসি (গল্প সংকলন)। তৃষ্ণা বসাক। প্রকাশক 'এবং অধ্যায়'।

1 মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন